ঢাকা, ২৫ নভেম্বর সোমবার, ২০২৪ || ১০ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
৭৩০

‘আবার আসিব ফিরে এই বাংলায়’

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১২:৫৫ ১৭ মার্চ ২০২০  

তোফায়েল আহমেদ : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একটি নাম নয়, একটি ইতিহাস। আজ থেকে শতবর্ষ আগে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করে, মাতৃক্রোড়ে যে শিশু প্রথম চোখ মেলেছিল, পরবর্তীকালে সে শিশুর পরিচিতি দেশের গ-িরেখা অতিক্রম করে পরিব্যাপ্ত হয়েছে বিশ্বব্যাপী। মা-বাবার আদরের ‘খোকা’, রাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের সুপ্রিয় ‘মুজিব ভাই’, সমসাময়িকদের প্রিয় ‘শেখ সাহেব’ থেকে মুক্তিকামী বাঙালির ভালোবাসায় অভিষিক্ত হয়ে অর্জন করেন ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি এবং শেষত কায়েমি স্বার্থবাদীদের প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে হয়ে ওঠেন জাতির অবিসংবাদিত নেতা- জাতির পিতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। যে জন্য সতেরোই মার্চ আমাদের জাতীয় জীবনে এক ঐতিহাসিক দিবস।

বাঙালি জাতির জীবনে ‘মার্চ’ এক ঘটনাবহুল মাস হিসেবে চিহ্নিত। ১৯২০-এর সতেরোই মার্চ জাতির পিতা এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন; ’৪৮-এর এগারোই মার্চ অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে সফল ধর্মঘট পালন; ’৭১-এর পহেলা মার্চ বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুরু হওয়া সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন ছিল বিশে^র বিস্ময়; ’৭১-এর তেসরা মার্চ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক ‘স্বাধীনতার ইশতেহার’ পাঠ; রেসকোর্স ময়দানে ’৭১-এর সাতই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভুবনবিজয়ী ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান; পঁচিশে মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক গণহত্যা শুরুর পর পরই ছাব্বিশে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ প্রদান;-অর্থাৎ এই মার্চেই এক নেতার অঙ্গুলি হেলনে কোটি কোটি মানুষ সাড়া দিল, এক নেতার কণ্ঠের ধ্বনি কোটি কণ্ঠে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হলো, একক নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ব্যক্তির সীমা অতিক্রম করে জাতির প্রতীক হয়ে উঠলেন। আমরা স্লোগান দিতাম, ‘এক নেতার এক দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ।’ একদিনে এটি সম্ভব হয়নি। তিলে তিলে, ধাপে ধাপে তার একচ্ছত্র নেতৃত্বের বিকাশ ঘটেছে। জেল-জুলুম-নির্যাতন আর ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে জাতির পিতার সংগ্রামী জীবন। যে নেতার জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না, সেই নেতার শততম শুভ জন্মবার্ষিকীতে সমগ্র জাতি আজ কৃতজ্ঞচিত্তে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করছে- দেশব্যাপী ‘মুজিববর্ষ’ সগৌরবে উদ্যাপিত হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু সব সময় ছোটকে বড় করে তুলতেন। যেসব জায়গায় সফর করতেন, বক্তৃতায় সেখানকার নেতাকর্মীদের বড় করে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতেন। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতাকে থানার, থানা আওয়ামী লীগের নেতাকে জেলার এবং জেলা আওয়ামী লীগের নেতাকে জাতীয় নেতায় রূপান্তরিত করে তিনি জাতির পিতা হয়েছেন। ফলত, সারা বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজও বঙ্গবন্ধুর চেতনা ধারণ করে টিকে আছে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশাল হৃদয়ের মহান নেতা। সবাইকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। মুহূর্তেই পরকে আপন করে নিতেন। কারও দুঃখ সহ্য করতে পারতেন না। যারা বিরোধী ছিলেন তাদেরও কাছে টেনে নিতেন। যখন বলতেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না’, মানুষ তাই বিশ^াস করত। ক্ষমতার জন্য, ক্ষমতায় থাকার জন্য, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য তিনি রাজনীতি করেননি। প্রিয় মাতৃভূমিকে পাকিস্তানের শোষণ-বঞ্চনার হাত থেকে রক্ষা করে বাঙালিরা যাতে বাংলাদেশের ভাগ্যনিয়ন্তা হতে পারে সেজন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতেই তিনি রাজনীতি করেছেন। ’৬৭-এর সতেরোই মার্চ নিজের জন্মদিনে কারাগারের রোজনামচায় লিখেছেন, “আজ আমার ৪৭তম জন্মবার্ষিকী। এই দিনে ১৯২০ সালে পূর্ববাংলার এক ছোট্ট পল্লীতে জন্মগ্রহণ করি। আমার জন্মবার্ষিকী আমি কোনোদিন নিজে পালন করি নাই- বেশি হলে আমার স্ত্রী এই দিনটাতে আমাকে ছোট্ট একটি উপহার দিয়ে থাকত। এই দিনটিতে আমি চেষ্টা করতাম বাড়িতে থাকতে। খবরের কাগজে দেখলাম ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ আমার জন্মবার্ষিকী পালন করছে। বোধহয়, আমি জেলে বন্দি আছি বলেই। ‘আমি একজন মানুষ, আর আমার আবার জন্মদিবস’।” পৃষ্ঠা-২০৯। এই উক্তিটির সূত্রে মনে পড়ছে, ’৭১-এর রক্তঝরা মার্চের সতেরো তারিখের কথা। সেদিন ছিল বঙ্গবন্ধুর ৫২তম জন্মদিন। দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলন চলছে। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা শেষে তখনকার প্রেসিডেন্ট ভবন অর্থাৎ পুরাতন গণভবন সুগন্ধা থেকে দুপুরে যখন তিনি ধানম-ি ৩২ নম্বরের বাসভবনে ফিরে এলেন তখন বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে ঘরোয়া আলোচনাকালে একজন সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন, ‘৫২তম জন্মদিনে আপনার সবচেয়ে বড় ও পবিত্র কামনা কী?’ উত্তরে স্বভাবসুলভ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘জনগণের সার্বিক মুক্তি।’ এর পর সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জ্ঞাপনকালে বেদনার্ত স্বরে বলেছিলেন, ‘আমি জন্মদিন পালন করি না, আমার জন্মদিনে মোমের বাতি জ্বালি না, কেকও কাটি না। এ দেশে মানুষের নিরাপত্তা নাই। আপনারা আমাদের জনগণের অবস্থা জানেন। অন্যের খেয়ালে যে কোনো মুহূর্তে তাদের মৃত্যু হতে পারে। আমি জনগণেরই একজন, আমার জন্মদিনই কী, আর মৃত্যুদিনই কী? আমার জনগণের জন্য আমার জীবন ও মৃত্যু। আমি তো আমার জীবন জনগণের জন্য উৎসর্গ করেছি।’ জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে আসা জনসাধারণকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা থেকে আবৃত্তি করে বলতেন, ‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক।’ বিশাল হৃদয়ের মহৎ মনের সহজ মানুষ ছিলেন তিনি। নিজের সবকিছুই জনগণের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। অতি সাধারণ জীবন ছিল তার। রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়েও সরকারি বাসভবনে থাকতেন না। নিরাভরণ, ছিমছাম ৩২ নম্বরের বাড়িটিতেই আমৃত্যু থেকেছেন।

আজ বিশেষভাবে একাত্তরের পঁচিশে মার্চের থমথমে দিনটির কথা মনে পড়ছে। ধানম-ির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে বিদায় নেওয়ার সময় সবাই বঙ্গবন্ধুকে বলেছেন, ‘আজ তো মনে হয় তারা অবশ্যই আপনাকে গ্রেপ্তার করবে।’ দৃঢ়প্রত্যয়ী বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘করুক না। তাতে কী? ওরা আমাকে আগেও গ্রেপ্তার করেছে এবং তাতে ওদের কোনো লাভ হয় নাই। ওরা ফের আমাকে গ্রেপ্তার করতে পারে। কিন্তু এ থেকে ওরা কি সুবিধা পাবে আমি জানি না। ওরা যদি আমাকে মেরেও ফেলে তাতেও ওদের কোনো লাভ হবে না। আমার মৃত্যুর বদলা নিতে বাংলার মাটিতে হাজারো শেখ মুজিবের জন্ম হবে। ওদের দিন শেষ এটা ওরাও জানে। দীর্ঘদিনের সংগ্রামের পর আজ এই সত্যই আমার হৃদয়টাকে অনাবিল আনন্দে ভরে দিচ্ছে। সর্বত্র উড়ছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা, একটি সফল অসহযোগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সমগ্র জাতি আজ ঐক্যবদ্ধ। ইতিহাসে এই প্রথম বাঙালিরা নিজেদের ভাগ্যনিয়ন্তা হয়ে সবকিছু নিজেরা নিয়ন্ত্রণ করছে। ওরা যদি আমাকে মেরে ফেলে এবং তোমরা যদি আমার লাশ দেখার সুযোগ পাও তখন দেখবে, আমি কেমন সুখে হাসছি।’ গণহত্যা শুরুর প্রাক্কালে সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা থেকে বিষাদাচ্ছন্ন স্বরে বলেছিলেন, ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়...।’

তোফায়েল আহমেদ : আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি