ঢাকা, ১২ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার, ২০২৪ || ২৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
৫৬০

করোনা, অ্যাম্বুলেন্স ও মানবিকতা

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২০:৩৯ ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০  

আমার বাসাটি মিরপুর রোডের একদম কাছাকাছি। গত পাঁচ মাস ধরে করোনার ভয়ে ঘরে লুকিয়ে আছি। আমার চল্লিশ বছরের বৈকালিক হাঁটার অভ্যাসটি আর বেশি টেনে নেয়া যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে সামনের রাস্তা দিয়ে বা পার্কিং লটে একটু এদিক সেদিক করে শরীরটাকে সামান্য হলেও সচল রাখার চেষ্টা করি। তবে মাস্ক না পরে একদম ঘর থেকে বের হই না, দূরত্ব বজায় রাখি, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি। 

 

মোটামুটি সারাদিন ঘরে থেকেই অনলাইনে ক্লাস নেয়াসহ অন্যান্য কাজ সারছি। এ কারণে দিন দিন মানসিক চাপ বাড়ছে। মাঝ মধ্যে একদম অস্থির লাগে। কাজে মন বসাতে পারি না। এভাবে আর কতদিন! তাও অনিশ্চিত এবং সেজন্য খারাপ লাগাটা দিনকে দিন বাড়ছে।

 

ঘরে থাকি বলে দুই ধরনের ঘটনা প্রায় আমার মনযোগ আকর্ষণ করে। একটা অজানা আতঙ্ক আমার মনকে অস্থির করে তোলে। আমার বাসার কাছাকাছি প্রায় চার থেকে পাঁচটি মসজিদ আছে। আমি দুয়েক দিন অন্তর কোনো না কোনো মসজিদ থেকে মাইকে ‘একটি শোক সংবাদ’ প্রচার হতে শুনি। কেউ না কেউ মারা যায়। 

 

এত ঘন ঘন মৃত্যু সংবাদ করোনা সংক্রমণের আগে শুনিনি। কীভাবে মারা গেলেন ওই মানুষটি! হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, ক্যান্সার, ডেঙ্গু, কিডনি ফেলিয়ার, না অন্য কিছু! আজকাল এসব মৃত্যু ছাড়িয়ে শুধু একটি মৃত্যুকেই আমরা চিন্তায় ধারণ করি। আর তা হলো করোনা। প্রাণঘাতী ভাইরাসে মৃত্যুহার এভাবে বেড়ে গেল কেন? এসব মৃত্যুর জন্য আমরাই কি কোনো না কোনোভাবে দায়ী নই? 

 

দ্বিতীয় ঘটনাটি হলো অ্যাম্বুলেন্সের তৎপরতা। রাত নেই দিন নেই, মিরপুর রোডে কয়েক ঘণ্টা পর পর এর সাইরেনের মতো বিকট শব্দ শুনে আঁতকে উঠি গত কয়েক মাস ধরে। কোনো সংকটাপন্ন রোগীকে নিয়ে হাসপাতালের দিকে ছুটে চলেছে অ্যাম্বুলেন্স। এর বিশাল তৎপরতা আমি আগে কোনোদিন দেখিনি। অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ শুনলেই মানসপটে ভেসে আসে একজন সংকটাপন্ন রোগীর কথা। আর সঙ্গে থাকা ব্যাকুল আত্মীয়স্বজনের আহাজারি। 

 

ভাবি- কেমন আছে এ রোগী? অবস্থা বেশি খারাপ নয় তো? বাঁচবে তো? নাকি হাসপাতালে পৌঁছার আগেই সব শেষ হয়ে যাবে। আমি কয়েক মাস আগে হাসপাতালে ভর্তি না করানোর কারণে এক করোনা রোগীকে অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যেই খুব বিপন্ন অবস্থায় মারা যেতে দেখলাম। অনেক সিরিয়াস রোগীকে হাসপাতালের সামনে অবজ্ঞা অবহেলায় পড়ে থাকতেও দেখছি। কি মর্মান্তিক এসব দৃশ্য!

 

আমি শুধু অ্যাম্বুলেন্সের রোগীর কথা ভাবি না। ভাবি সার্ভিসের কথা। ব্যবসা হলেও কত বড় মহৎ একটি মানবিক সেবা দিয়ে যাচ্ছে এ অ্যাম্বুলেন্স। ভাবি গাড়িটির ড্রাইভার ও তার সহযোগীদের কথা। রাত নেই, দিন নেই, ঘুমের বালাই নেই, সময়ের বালাই নেই। নিজ পরিবারের স্ত্রী সন্তানের সঙ্গে কিছু সময় কাটানোর ফুরসত নেই। 

 

সর্বক্ষণ অতন্দ্র প্রহরীর মতো জেগে বা সজাগ হয়ে অপেক্ষা করছে এ লোকগুলো। ব্যবসার কথাটা আসলেও এখানে অ্যামবুলেন্স সার্ভিসের মাধ্যমে মানুষগুলো কত বড় মানবিক ধর্ম পালন করে যাচ্ছে, তা কি আমরা কোনো সময় ভেবে দেখেছি?

 

এ মহামারি আমাদের কতভাবে বিপদগ্রস্ত করছে তা বেশিরভাগ মানুষ নয় শুধু, সরকারও উপলব্ধি করছে না, উপলব্ধির গরজও নেই। কোত্থেকে আমরা কোথায় চলে আসলাম। আমি আমার বারান্দা থেকে বাইরে তাকালে দেখি- সব ফ্রি স্টাইলে চলছে। বেশিরভাগ মানুষ মাস্ক পরে না, দূরত্ব বজায় রাখে না, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে না। মানুষ এত ডেস্পারেট হয় কি করে? 

 

করোনায় আক্রান্ত অসংখ্য রোগী দুই/তিন দিনের মধ্যে মারা যাওয়ার ঘটনা বিরল নয়। আমরা একটুও ভাবি না, আমার কারণে একজন নিরীহ মানুষ মারণ এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে না তো বা মারা যাচ্ছে না তো? আমার ডেস্পারেট আচরণ ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলার কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটতেও তো পারে। তাহলে আমি নিজকে রক্ষা করার পাশাপাশি অন্যকেও সুস্থ রাখার জন্য একটু দায়িত্বশীল আচরণ কেন করছি না। 

 

সবাই মাস্ক পরে ঘর থেকে বের হলে, যতটুকু সম্ভব দূরত্ব বজায় রাখলে এবং যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে কি এমন কষ্ট হয়? না মাস্ক পরে থাকা অস্বস্তিকর। কি ঠেকা পড়েছে আমার মাস্ক পরার। আমি করোনায় আক্রান্ত হব না, আর আমার কারণে অন্য কেউ করোনায় আক্রান্ত হলেই বা আমার কি আসে যায়? এসব নষ্ট চিন্তা আমাদের অনেকের মাথায়ই আসে। এসব কোনো সভ্য মানুষের চিন্তা হতে পারে না। আমরা এখনো বেশি সভ্য হতে পারিনি। আমরা স্বার্থপর, চরম স্বার্থপর।

 

সরকার তো হাত পা ছেড়ে দিয়ে দিব্বি হাওয়া খাচ্ছে। ধারণাটা এরকম- চলুক যেভাবে চলছে, যার কপাল খারাপ সে মরুক, মরে বেঁচে যা থাকে তা নিয়ে দেশ চলবে। অনেক হয়েছে, আর কত? করোনা এমনি এমনি এসেছে, এমনি এমনি চলে যাবে। হায়রে দেশ, হায়রে আমাদের সরকার!

 

শুরুর দিকে আর্মি, র‌্যাব, পুলিশ, বিজেবির লোকদের কত তৎপর দেখলাম। কঠোর লকডাউন দেখলাম, কত লোককে নির্মম পিটুনি খেতে দেখলাম ঘর থেকে বের হওয়া ও মাস্ক না পরার কারণে। এখন ওসবের আর বালাই নেই। এখন তারা জনগণকে মাস্ক পরার জন্য সবিনয়ে অনুরোধ জানায়। কারণ, করোনা এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। সরকার বা জনগণের এখন আর করার কিছু নেই। আর এদেশের মানুষকে দিয়ে কিছু করানো সহজসাধ্য ব্যাপারও নয়।

 

মারণঘাতী করোনার ভয়াবহ অবস্থা মনে হয় বাংলাদেশে এখনো আসেনি। সামনে হয়ত আসছে। বেশি দেরি নেই। দেশের সর্বত্র করোনা ছড়িয়ে পড়ছে। এটা আমার অনুমান। তবে আমার অনুমান যেন মিথ্যা হয়। মনে প্রাণে আল্লাহর কাছে দোয়া করছি সেই অবস্থা যেন না আসে। কিন্তু হাত পা ছেড়ে বসে থাকলে, নিয়ম কানুন না মানলে, করোনা নিয়ন্ত্রণে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ না করা হলে তা আসবেই না কেন বলুন।

 

লেখক: অধ্যাপক ড. মুনিরুদ্দিন আহমেদ
সাবেক ডিন, ফার্মেসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

মুক্তমত বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর