ঢাকা, ২৫ নভেম্বর সোমবার, ২০২৪ || ১১ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
৬৭৪

করোনা ভাইরাস: লক্ষণ, প্রতিরোধ ও আরো ১০ তথ্য

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২২:২২ ৬ মার্চ ২০২০  

একটি ভাইরাস- যা পূর্বে বিজ্ঞানীদের অজানা ছিল। এর মধ্যেই চীনে অনেক মানুষের ফুসফুসের মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করেছে এটি। অন্যান্য দেশেও ধরা পড়েছে। চীনের উহানে গেল ডিসেম্বর থেকে সনাক্ত হওয়া ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৮০ জন মারা গেছে।
এসব মৃত্যুর ব্যাপারে এর মধ্যেই নিশ্চিত হওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এ সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। রোগীদের শরীরে নিউমোনিয়া তৈরি করছে, এমন একটি ভাইরাস সবসময় উদ্বেগজনক। ফলে সারা বিশ্বের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা চরম সতর্ক অবস্থায় রয়েছেন। কিন্তু এটা কি আজকালের একটি প্রাদুর্ভাব নাকি আরো বিপজ্জনক কোনও রোগের লক্ষণ?
ভাইরাসটা কী?
চীনের কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন, করোনা ভাইরাসের কারণে সেখানে অসুস্থতা বা মৃত্যুর ঘটনাগুলো ঘটেছে। এটি এমন একটি সংক্রামক ভাইরাস- যা এর আগে কখনো মানুষের মধ্যে ছড়ায়নি।
ভাইরাসটির আরেক নাম ২০১৯-এনসিওভি। এটি এক ধরণের করোনা ভাইরাস। এর অনেক প্রজাতি আছে। কিন্তু তন্মধ্যে মাত্র ছয়টি মানুষের দেহে সংক্রমিত হতে পারে। তবে নতুন ধরণের ভাইরাসের কারণে সেই সংখ্যা এখন থেকে হবে সাতটি।
২০০২ সালে চীনে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে সার্স (পুরো নাম সিভিয়ার এ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম)। এ  ভাইরাসের সংক্রমণে পৃথিবীতে ৭৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল। আর ৮০৯৮ জন সংক্রমিত হয়েছিল। সেটিও ছিল এক ধরণের করোনা ভাইরাস।
ওয়েলকাম ট্রাস্টের চিকিৎসক জোসি গোল্ডিং বলেন, সার্সের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা এখনো আমরা ভুলতে পারিনি। ফলে নতুন ভাইরাসের প্রচণ্ড ভীতির তৈরি হয়েছে। কিন্তু এ ধরণের রোগ মোকাবেলায় আমরা এখন অনেক বেশি প্রস্তুত।
লক্ষণগুলো কতটা মারাত্মক?
জ্বর দিয়ে ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়। এরপরে শুকনো কাশি দেখা দিতে পারে। প্রায় এক সপ্তাহ পরে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়। অনেক রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দিতে হয়। প্রতি চারজনের মধ্যে অন্তত একজনের অবস্থা মারাত্মক পর্যায়ে যায় বলে মনে করা হয়।
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে হালকা ঠাণ্ডা লাগা থেকে শুরু করে মৃত্যুর সব উপসর্গ দেখা দিতে পারে। ইউনিভার্সিটি অব এডিনবরার অধ্যাপক মার্ক উলহাউজ বলেন, যখন আমরা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত কাউকে দেখতে পাই। আমরা বোঝার চেষ্টা করি লক্ষণগুলো কতটা মারাত্মক। এটা ঠাণ্ডা লাগার লক্ষণগুলোর চেয়ে একটু বেশি। সেটা উদ্বেগজনক হলেও সার্সের মতো অতটা মারাত্মক নয়। 
বিশ্বজুড়ে জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা জারির কথা ভাবছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। যেমনটি তারা করেছিল সোয়াইন ফ্লু ও ইবোলার সময়।
রোগটি কতটা মারাত্মক?
ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত ৪১ জন মারা গেছেন। রোগের প্রকোপের তুলনায় মৃত্যুর সংখ্যা কম বলে মনে হলেও এ পরিসংখ্যান নির্ভরযোগ্য নয়। কিন্তু যেহেতু সংক্রমণ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বেশ খানিকটা সময় লাগে, সেহেতু আরো অনেক রোগী মারা যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো, রোগে আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু হাসপাতাল বা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়নি। এমন রোগীদের সংখ্যা আসলে কত? সেই তথ্য কারো জানা নেই।
রোগটি কোথা থেকে এসেছে?
সবসময় নতুন ভাইরাস সনাক্ত হয়ে থাকে। কোনও একটি প্রাণী থেকে এসে এসব ভাইরাস মানব শরীরে বাসা বাঁধতে শুরু করে। নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরাস বিশেষজ্ঞ জোনাথন বল বলেন, আমরা যদি অতীতে মহামারিগুলোর দিকে তাকাই। এমনকি এটা যদি নতুন করোনা ভাইরাসও হয়। এটা কোনও একটা প্রাণীর শরীর থেকে এসেছে।
সার্স ভাইরাস প্রথমে বাদুরের শরীর থেকে খট্টাশের শরীরে। এর পরে সেটা মানব শরীরে চলে আসে। মধ্যপ্রাচ্যের ফুসফুসের রোগ মার্স ( পুরো নাম: মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম), যাতে ২৪৯৪ জন সংক্রান্ত রোগীর মধ্যে ৮৫৮ মারা গিয়েছিলেন। রোগটি নিয়মিতভাবে এক কুঁজওয়ালা উট থেকে মানব শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।
কোন প্রাণী থেকে ছড়িয়েছে করোনা ভাইরাস?
একবার যদি ভাইরাসের উৎস প্রাণীটি সনাক্ত করা সম্ভব হয়, তাহলে রোগটি মোকাবেলা করা অনেক সহজ হয়। এর সঙ্গে সম্পর্ক আছে চীনের উহায়ের দক্ষিণ সমুদ্রের খাবারের পাইকারি বাজারের সঙ্গে। বেশ কিছু সামুদ্রিক প্রাণী করোনা ভাইরাস বহন করতে পারে (যেমন বেলুগা তিমি)। ওই বাজারটিতে অনেক জীবন্ত প্রাণীও থাকে। যেমন মুরগি, বাদুর, খরগোশ, সাপ- এসব প্রাণী করোনা ভাইরাসের উৎস হতে পারে।
গবেষকরা বলছেন, চীনের হর্সশু নামের একপ্রকার বাদুরের সঙ্গে এ ভাইরাসের ঘনিষ্ঠ মিল রয়েছে।
চীনে কেন?
অধ্যাপক উলহাউজ বলেন, এর বড় কারণ চীনের বিশাল আকৃতি ও জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং যেসব প্রাণী ভাইরাসটি বহন করে, সেগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। পরবর্তী বড় মহামারি চীন বা এ অঞ্চলে হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
মানুষের মধ্যে কত সহজে রোগটি ছড়িয়ে পড়তে পারে?
রোগটির প্রাদুর্ভাবের শুরুতে চীনের কর্তৃপক্ষ বলেছিল, ভাইরাসটি মানুষের মধ্যে ছড়াচ্ছে না। কিন্তু বর্তমানে এ ধরণের রোগী পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন, একেকজন সংক্রমিত ব্যক্তি রোগটি গড়ে ১.৪ থেকে ২.৫ জন ব্যক্তির মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। 
এ সংখ্যাকে বলা হয় 'বেসিক রিপ্রোডাকশন নাম্বার অথবা মৌলিক প্রজনন সংখ্যা'- যা একের বেশি হওয়া মানে হলো রোগটি স্বনির্ভর হয়ে উঠেছে। সুতরাং আমরা এতদিনে জেনে গেছি, এটি এমন একটি ভাইরাস যা নিজে থেকে বিনষ্ট বা বিলুপ্ত হয়ে যাবে না।
শুধু চীনে গৃহীত সিদ্ধান্ত- যেমন শহরগুলো বন্ধ করে দেয়ার মতো কড়া পদক্ষেপের ফলেই মাত্র রোগটির বিস্তার ঠেকানো যেতে পারে। যদিও এসব সংখ্যা এখনো প্রাথমিক হিসাব। তবুও তারা করোনা ভাইরাসকে সার্স ভাইরাসের সঙ্গে তুলনা করছে।
এখানে আরো উদ্বেগের ব্যাপার হলো, রোগে আক্রান্ত হওয়ার কোনও লক্ষণ ছাড়া ব্যক্তিরাও ভাইরাসটি ছড়িয়ে দিতে পারেন। তবে কত তাড়াতাড়ি বা কত সহজে সেটা ঘটতে পারে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। কিন্তু এর ফলে ভাইরাসটি সংক্রমণ ঠেকানো আরো কঠিন হয়ে পড়বে।
এটা কত দ্রুত ছড়াচ্ছে?
রোগীদের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সপ্তাহে প্রায় ৪০ থেকে ৮০০ জন আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু এ পরিসংখ্যানের মধ্যেও বিভ্রান্তি আছে। বেশিরভাগ নতুন রোগী আগে থেকেই চীনে ছিল। শুধু চীন তাদের নজরদারি বাড়ানোর পর সনাক্ত হয়েছে। ফলে মহামারিটির বিস্তার সম্পর্কে খুবই কম তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব তথ্য উপাত্তের কথা বলা হচ্ছে। সম্ভবত এর চেয়ে বেশি মানুষ রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। চীনের বাইরেও যেভাবে রোগে আক্রান্তদের সংখ্যা বাড়ছে। তাই ধারণা করা হচ্ছে হচ্ছে চীনের সরকার আক্রান্তের যে সংখ্যা বলছে (প্রায় ৪০০০ রোগী), আসল রোগীদের সংখ্যা তার দ্বিগুণ। তবে এর মানে এ নয় যে, মহামারীটি দ্বিগুণ আকৃতির হয়ে গেছে।
যদিও এখনো রোগটির প্রাদুর্ভাব উহান কেন্দ্রিক। কিন্তু থাইল্যান্ড, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, ফ্রান্স, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, নেপাল ও যুক্তরাষ্ট্রে রোগী পাওয়া গেছে।
ভাইরাসটির কি পরিবর্তন ঘটতে পারে?
হতে পারে। সবসময়েই ভাইরাসের পরিবর্তন এবং বিকাল ঘটতে পারে। এর অর্থ আসলে কি? সেটা বলা কঠিন। করোনা ভাইরাস এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতিতে ছড়িয়ে পড়েছে। এটা হয়তো একজন ব্যক্তি থেকে আরেকজন ব্যক্তিতে ছড়ানোর জন্য পরিবর্তিত হতে পারে কিংবা আরো মারাত্মক উপসর্গ দেখা দিতে পারে। সেটাই ঘনিষ্ঠভাবে নজরে রেখেছেন বিজ্ঞানীরা।
ভাইরাসটি কিভাবে ঠেকানো যেতে পারে?
আমরা এখন জানি, ভাইরাসটি নিজে থেকে ধ্বংস হবে না। শুধু চীনের কর্তৃপক্ষে নেয়া পদক্ষেপই এ মহামারীর অবসান ঘটাতে পারে। ভাইরাস প্রতিরোধক করতে কোনও ভ্যাকসিন বা টিকা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। এ রোগ থেকে রক্ষার একমাত্র উপায় হলো অন্যদের মধ্যে ভাইরাসের সংক্রমণ হতে না দেয়া।
যার মানে হলো:
#মানুষজনের চলাচল সীমিত করে দেয়া।
# হাত ধুতে সবাইকে সবাইকে উৎসাহিত করা।
# স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রতিরক্ষামূলক পোশাক পরে রোগীদের আলাদা করে চিকিৎসা সেবা দেয়া।
রোগীদের ভাইরাস রয়েছে কি না তা জানতে এবং রোগীদের সংস্পর্শে আসা লোকদের সনাক্ত করার জন্যও গোয়েন্দা কর্মকাণ্ড বা নজরদারি ব্যবস্থার প্রয়োজন।
চীনা কর্তৃপক্ষ কী ব্যবস্থা নিচ্ছে?
বিশ্বের অন্য যেকোনো জায়গার তুলনায় নজিরবিহীন কিছু কাজ করেছে চীন। বিশেষ করে উহান অঞ্চলটিকে একেবারে আলাদা করে দিয়ে। আরো প্রায় এক ডজন শহরের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে।  যার মধ্যে পড়েছে প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ।
অনেক এলাকায় বড় জনসমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অনেক পর্যটন এলাকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যার মধ্যে চীনের গ্রেট ওয়াল রয়েছে। প্রাদুর্ভাবের মূল কেন্দ্রস্থল- উহানে নতুন একটি হাসপাতাল তৈরি করা হচ্ছে। যেখানে ১০০০ শয্যা হবে।
কীভাবে ব্যবস্থা নিচ্ছে বিশ্ব?
উহান থেকে আসা ভ্রমণকারীদের পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যবস্থা করেছেন দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ দেশ। রোগটির প্রাদুর্ভাবের ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুতি নিতে বলেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। উহান থেকে আসা বিমানযাত্রীদের পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যবস্থা করেছে সিঙ্গাপুর ও হংকং। একই ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। 
তবে এসব পদক্ষেপের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। রোগের লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে যদি পাঁচদিন লাগে, তাহলে কেউ একজন সহজেই অর্ধেক পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে ফেলতে পারবে এবং অসুস্থ বোধ করার আগেই এসব পরীক্ষা নিরীক্ষা পার হয়ে যাবে।
বিশেষজ্ঞরা কতটা উদ্বিগ্ন?
ড. গোল্ডিং বলছেন, আরো বেশি তথ্য পাওয়ার আগে পর্যন্ত, এ মুহূর্তে বলা কঠিন; আমাদের আসলে কতটা উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত। যতক্ষণ পর্যন্ত উৎস সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত হতে না পারছি, ততক্ষণ এটা সহজ হবে না।'
অধ্যাপক বল বলছেন, মানব শরীরের প্রথমবারের মতো ছড়িয়ে পড়ছে, এমন যেকোনো ভাইরাস নিয়েই আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত। কারণ এটা প্রথম সারির বাধা অতিক্রম করেই ছড়িয়েছে। একবার মানব কোষের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়ার এবং প্রতিলিপি তৈরির পর এটা দ্রুত রূপান্তরিত হতে শুরু করে। ফলে এটা আরো ভালোভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। এই ভাইরাসকে আমরা সেই সুযোগ দিতে চাই না।
রোগের কোন প্রতিষেধক অথবা চিকিৎসা আছে?
না, নেই। তবে রোগটির প্রতিষেধক আবিষ্কারের কাজ চলছে। আশা করা হচ্ছে, মার্স ভাইরাসের (সেটিও একটি করোনা ভাইরাস) প্রতিষেধক আবিষ্কারে যে গবেষণাটি চলছিল, সেটির কারণে এ কাজ অনেক এগিয়ে যাবে।