ঢাকা, ২৭ নভেম্বর বুধবার, ২০২৪ || ১৩ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
৮০৫

কাটা মাথা আতঙ্কে কাঁপছে শহর-গ্রাম

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২০:২৬ ২৩ জুলাই ২০১৯  

পদ্মাসেতুতে মানুষের মাথা লাগবে। এ গুজব দেশের গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। বরগুনা শহরে এর প্রমাণ পাওয়া গেল। পেশাগত কাজে চলতি সপ্তাহে গিয়েছিলাম সেখানে। একদিন শহরের কেন্দ্রে একটি কোচিং সেন্টারে যাই বিকালে। চত্বরে ঢুকতেই বেশ কিছু নারী-পুরুষ আমাকে দেখে সতর্ক হয়ে উঠলেন। অনেকটা মারমুখী ভঙ্গিতে দুজন পুরুষ এসে আমার পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন।

নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দেয়ার পরও তারা আশ্বস্ত হতে পারেননি। আমার সঙ্গে ছিলেন বরগুনার স্থানীয় একজন সাংবাদিক। তার আত্মীয় ওই কোচিং সেন্টারের শিক্ষক। তিনি আসার পর অভিভাবকরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। ওই শিক্ষক বলেন, অভিভাবকদের কয়েকজন প্রথমে আমাকে ছেলেধরা বলে সন্দেহ করেন।

পদ্মা বহুমুখী সেতু কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে জানিয়েছে, একটি কুচক্রী মহল সেতুতে মাথা লাগার গুজব ছড়িয়েছে। এ গুজবে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্যও সবার প্রতি আহবান জানায়। এছাড়া গুজব ঠেকাতে বিশেষ অভিযানের কথা জানিয়েছে পুলিশ। তবে এসব পদক্ষেপ নেয়ার পরও পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেনি। এর প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে ছেলেধরা সন্দেহে একের পর এক গণপিটুনির ঘটনায়।

কোচিং সেন্টারে আমার পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর ছেলেধরা নিয়ে সন্দেহ আর গুজব নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন অভিভাবকেরা। জেসমিন আক্তার নামে এক অভিভাবককে জিজ্ঞেস করলাম, কেন তাদের এ সন্দেহ? জবাবে তিনি বলেন, টেলিভিশনে দেখলাম, নেত্রকোনায় একটা লোকের ব্যাগের ভেতরে বাচ্চার মাথা পাওয়া গেছে। লোকটাকে পিটাইয়া মাইরা ফালাইছে। এসব দেইখা আমাদের ভয় হয়। বাচ্চাদের একা ছাড়তে পারি না।

'কাটা মাথা' আতঙ্ক এখন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। শিশু সন্তান হারিয়ে যাওয়ার ভয় এখন মানুষের মধ্যে জেঁকে বসেছে। কোনও কিছুতেই তারা বিশ্বাস করতে চাচ্ছেন না, এটা গুজব। নেত্রকোনায় এক ব্যক্তির ব্যাগে শিশুর কাটা মাথা পাওয়া গেছে। এ খবর ছড়িয়ে পড়ার পর মূলত এই ধারণা মানুষের মাঝে অনেকটা বদ্ধমূল হয়েছে, 'কাটা মাথার' বিষয়টি কোনও গুজব নয়। কেন এটা বিশ্বাস করছেন? জেসমিন আক্তারের উত্তর, টেলিভিশনের খবর সবাই বিশ্বাস করে। ওখানে সত্যিটাই দেখানো হয় বা বলা হয়। কিন্তু এ আতঙ্ক কি কেবল শহরকেন্দ্রীক?

প্রত্যন্ত গ্রামের অবস্থা

বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য বরগুনা শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দুরে নলিবাজারে গেলাম। জায়গাটি জেলে অধ্যুষিত এলাকা। অনেকটা অবাক হয়েই লক্ষ্য করলাম, সেখানে 'কাটা মাথা' গুজব বরং আরো জোরালো। এলাকায় অপরিচিত মানুষ দেখলেই সন্দেহ করছেন সবাই। আমি যখন বাজারে পৌঁছালাম, দেখলাম লোকজন বেশ উৎসুক দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে। এক ব্যক্তি এসে সরাসরি আমার পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন। আমি পরিচয় দিলাম। সঙ্গে থাকা স্থানীয় ট্রলার মালিক সমিতির এক ব্যক্তি আমার পরিচয় তাদের দিলেন। জানলাম 'কাটা মাথা' গুজব গ্রামাঞ্চলে এতটাই ছড়িয়েছে যে, বিভিন্ন প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি পর্যন্ত কমে গেছে।

একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মারজানা রহমান বললেন, এইডা এখন সব জায়গায় চলত্যাছে। ছেলেধরা কল্লা কাড্যা নিছে। বাচ্চারা ভয় পায়, তাই আসতে চায় না। এরকম প্রভাব পড়া স্বাভাবিক।

সবচেয়ে মারাত্মক ব্যাপার হলো যে, প্রতিটি স্কুল থেকে একটি করে শিশু চাওয়া হয়েছে-এমন গুজবও ছড়িয়েছে। মারজানা রহমান বলেন, অনেকে জিজ্ঞেস করে, আপনার স্কুলে কি এরকম কোন তথ্য দিছে। আমরা বলি, এ ধরণের কোনও তথ্য নাই। এটা সম্পূর্ণই গুজব।

কিন্তু শিক্ষকদের কথাও পুরোপুরি বিশ্বাস করছেন না অভিভাবকেরা। তিনি বলেন, বিষয়টা এত ছড়িয়েছে যে এইডা বললেও কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। তারা বলে, সব জায়গায় শুনছি, সবাই কি মিথ্যা কথা কইব? অভাবনীয় বিষয় হচ্ছে, প্রত্যন্ত গ্রামেও এখন অনেক অভিভাবক শিশু সন্তানদের স্কুলে আনা-নেয়া করছেন। মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর মোল্লা নামে এক অভিভাবক বলেন, এখন বাচ্চাদের সঙ্গে যাওয়া লাগে। বাচ্চাদের স্কুল থেকে যাইয়্যা আনা লাগে। আমরা খুব আতঙ্কের ভিতরে আছি।

গুজব কিভাবে ছড়িয়েছে

আমি যাদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের কেউ-ই ফেসবুক ব্যবহার করেন না। পুরুষেরা বলছেন, গ্রামের হাট-বাজারে অনেকেই 'কাটা মাথা' প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করেছেন। সেখান থেকেই তারা এটি শুনেছেন। অনেকে আবার লোকমুখে শুনেছেন, দূরের কোনও গ্রামে এক শিশু হারিয়ে গেছে। যদিও বিষয়টি তারা কখনো যাচাই করেননি। তবে এভাবেই গুজবের ডালপালা বিস্তৃত হয়েছে।

নলিবাজারের বাসিন্দা মো. দুলাল মিয়া বলেন, তিনি এলাকার সবার কাছে একই কথা শুনছেন। বাজারে শুনছি, ফেসবুকে টুকে না। খালি মানুষের মুহে-মুহে। নারীদের অনেকেই বিষয়টি শুনেছেন আত্নীয়স্বজনের কাছে, নয়তো স্কুলের অন্য অভিভাবকদের কাছ থেকে। জেসমিন আক্তার বলেন, এইটা মানুষের মুখে-মুখে। যেমন স্কুলে আসছি, এক ভাবী বললো, ছেলেধরা বের হইছে। এরকম কইরা শুনছি।

সরকারের তরফ থেকে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে, পদ্মাসেতুতে মাথা লাগার বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। তবে গত এক সপ্তাহে ছেলেধরা আতঙ্কে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় গণপিটুনিতে বেশ কয়েকজন মারা গেছেন।

তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, মানুষ যাতে আইন নিজের হাতে তুলে না নেন; সেজন্য জনসচেতনতা তৈরি করতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে টিভিসিসহ নানাভাবে প্রচারণা চালানো শুরু হয়েছে। আরো ব্যাপকতর করা হচ্ছে। ব্যাপক হারে প্রচারণার জন্য আগামী ৩১ জুলাই তথ্য মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় একযোগে বৈঠকে বসবে বলেও জানান তিনি।  

বাংলাদেশ বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর