ঢাকা, ২২ নভেম্বর শুক্রবার, ২০২৪ || ৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
১৮৯

গণভবনের মাল লুট: মানসিক বিকারগ্রস্ততা নাকি অন্য কিছু?

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ০৪:২৭ ৮ আগস্ট ২০২৪  

অতি আনন্দে মানুষ গণভবনে ঢুকে ভাঙচুর লুট চালালো। আবার সেই লুটের মালপত্র নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আনন্দে প্রকাশও করলো? তাহলে কী সবাই মানসিক বিকারগ্রস্ত? মাহফুজা সোমা নামের এক উদ্যোক্তা নারী প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনেকগুলো শাড়ি নিয়ে এসে, নিজের ফেইসবুকে প্রকাশ করা মাত্রই সবার রোষানলে পড়ে গেলেন।

 

নিজের ভুল বুঝতে পেরে ফেইসবুকে সেটা স্বীকার করে তিনি লেখেন, ‘আমি আসলেই দুঃখিত। এখন নিজের কাছেই খারাপ লাগছে। আমি যদি চুরি করতাম তাহলে কি পোস্ট করতাম? গণভবনের জিনিস সবাই সুভেনিয়র/ স্মৃতি হিসেবে নিয়ে আসছে। আমিও নিয়ে আসছিলাম রেখে দেওয়ার জন্য। অবশ্যই নিজে পরার জন্য না। এখন মনে হচ্ছে- সেটা এমন কোনো সংস্থা বা জাদুঘরে ফেরত দেওয়া উচিত যারা এইগুলা যত্ন করে রাখবে।’

 

তারপরেই একটি ভিডিও পোস্টে দেখা যায়, শাড়িসহ যা যা এনেছিলেন সেগুলো সেনাবাহিনীর কাছে ফেরত দিয়েছেন।সামাজিক মনোবিজ্ঞানে একে ‘মব মেন্টালিটি’ বা অনেকগুলো মানুষের কাজের প্রভাব হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে জনতার মাঝে থেকে নিজের একক স্বত্ত্বা হারিয়ে ফেলে মানুষ। ফলে অনেকগুলো মানুষ যা করছে সেটাই করা শুরু করে।

 

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিশু-কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, “মনোবিজ্ঞানে ‘কনফর্মিটি’ বলে একটা কথা আছে। মানে অন্যের সাথে নিজেকে ‘কনফর্ম’ বা একাত্ম ঘোষণা করা। অনেকগুলো মানুষ যখন একই কাজ করে তখন দুয়েকজন মানুষ একা থাকতে পারে না। তারাও সেটাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে।”

 

এটার একটা উদাহরণ হল- গণপিটুনি যখন হয়। একটা মানুষের মধ্যে ‘কিলার মেন্টালিটি’ নেই, যে কখনও কাউকে মারতে চায় না। কিন্তু গণপিটুনির সময় সেও হয়ত দুয়েকটা ঘুষি দিয়ে আসে। অথচ সে হয়ত জীবনে কখনও একটা ফুলের টোকা দেয়নি কাউকে।

 

“অনেক মানুষ যখন একটা কাজ করে তখন ‘সোশাল ড্রিভেন’ তৈরি হয়। মানুষ যেহেতু সামাজিক প্রাণী সেহেতু সমাজের ভারী অংশের দিকেই সে ধাবিত হয়”- মন্তব্য করেন ডা. হেলাল।

লুটের মাল নিয়ে আনন্দ প্রকাশ করা কি তবে মানসিক বিকাগ্রস্ততার পরিচয় দেয়? 

 

ডা. হেলাল ব্যাখ্যা করেন, “এটা আসলে মানসিক বিকারগ্রস্ততার মধ্যে পড়ে না। সবাই করছে আমিও করে ফেলছি- এরকম একটা বিষয়। যখন এই ধরনের পরিস্থিতি ঘটে তখন আবেগটা বেড়ে যায়। যাকে বলা হয় আবেগের আতিশয্য। আনন্দ যেমন কাজ করে তেমনি কারও কারও মধ্যে হয়ত ক্ষোভ ছিল, অপ্রাপ্তি ছিল- সব কিছু মিলিয়ে উল্লাসের বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পেয়েছি গণভবনে সাধারণ মানুষ ঢুকে যাওয়ার ঘটনায়।”

 

 

দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, সব সময় কিন্তু কিছু সুযোগ সন্ধানী অপরাধী মানুষ থাকে। তারা এই ধরনের পরিস্থিতিতে সুযোগ নেয়। ফলে লুটতরাজ আক্রমণ এটা অপরাধীদের কাজ। এটাকে আবেগের আতিশয্য বলা যাবে না। কিন্তু মানুষ যে গণভবনে ঢুকে যাচ্ছে হৈচৈ করেছে সেটা আবেগের আতিশয্য।

 

এই ধরনের আবেগ নিয়ন্ত্রণের উপায় কী?

উত্তরে ডা. হেলাল বলেন, “উপায় হল জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ তৈরি করা। তাহলে এসব ঘটবে না। সেখানে আবেগের চাইতে জ্ঞানটা এগিয়ে থাকবে। যেমন- শ্রীলঙ্কাতে কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের পর সব জায়গায় ঘটনা ঘটে নাই। তারা কিন্তু একটা জায়গাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। তাদের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন। এছাড়া অন্য কোথাও কোনো হাঙ্গামার কথা শোনা যায়নি। খবরও আসেনি।”

 

অথচ যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের গুলির ঘটনার পর অনেক কিছু হতে দেখা গেছে- মন্তব্য করেন এই মনোচিকিৎসক। তার কথায়, “যদিও আমরা আমেরিকাকে অনেক উঁচু জায়গাতে রাখি, তবে তুলনামূলক হিসেবে শ্রীলঙ্কা জ্ঞান-ভিত্তিক সমাজ। যেটা আমেরিকার সমাজ না, তাদেরটা অনেকটা আমাদের মতো আবেগের স্রোতে চালিত হওয়া সমাজ।” সমাজ যদি জ্ঞান-ভিত্তিক হয়, সমাজের মানুষের যদি যুক্তিবোধ প্রবল থাকে তখন এই ধরনের ঘটনাগুলো কম ঘটবে।

 

এই জ্ঞান-ভিত্তিক সমাজ তৈরি করার দায়িত্ব কাদের?

এর জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রের কিছু নীতি এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পরিবার। ডা. হেলাল এই তিন উপাদান উল্লেখ করে বলেন, “আমি যুক্তি দিয়ে পরিচালিত হব না-কি আবেগে পরিচালিত হব- সেই মানসিকতার তৈরিতে এই তিন বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। আমি কি জ্ঞানটা’কে কাজে লাগাবো না-কি এই মুহূর্তে যে ক্ষোভ আছে সেটা প্রকাশ করবো?”

 

এটি কিন্তু নিরূপন করে তার পারিবারিক শিক্ষা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। আর রাষ্ট্রের কিছু নীতি দীর্ঘদিন ধরে এটা তৈরি করবে। এই মনোবিজ্ঞানী ব্যাখ্যা করেন, “এটা ‘ইকোলজিক্যাল সিস্টেম’ বা পরিবেশগত ব্যবস্থার অংশ। যখন রাষ্ট্রের নীতি ভালো থাকে যে, একটা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ হবে তখন পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেভাবেই পরিচালিত হয়।”

 

পারিবারিক কাঠামোতে তখন অনৈতিক-চর্চা থাকে না, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তখন সত্যকে সত্য এবং মিথ্যাকে মিথ্যা বলার প্রবণতাগুলো শেখায়। আর অন্যের মতের প্রতি সহিষ্ণুতা বা সম্মান প্রদর্শনের মানসিকতা তৈরি করে।

বাংলাদেশ বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর