ঢাকা, ২৪ নভেম্বর রোববার, ২০২৪ || ১০ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
১০৩৪

গান দিয়ে ফুটে ওঠে বাংলা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৬:০৪ ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১  

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি

ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু গড়া এ ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি।।”

 

এ গানের কথায় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সংঘটিত বাংলা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ফুটে ওঠে। সাংবাদিক ও লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরী ওই দিনেই গানটি রচনা করেন। প্রথমে আবদুল লতিফ গানটিতে সুরারোপ করেন। তবে পরবর্তীতে আলতাফ মাহমুদের করা সুরটিই অধিক জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৫৪ সালের প্রভাতফেরিতে প্রথম গাওয়া হয় গানটি।

 

১৯৬৯ সালে জহির রায়হান তার 'জীবন থেকে নেওয়া' চলচ্চিত্রে সেটি ব্যবহার করেন। বর্তমানে এই গানটি হিন্দি, মালয়, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, সুইডিশ, জাপানিসহ ১২টি ভাষায় গাওয়া হয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ভাষা আন্দোলনকারী ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালায়। এতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরো নাম না জানা অনেকে শহীদ হন।

 

সেসময় ঢাকা কলেজের ছাত্র আবদুল গাফফার চৌধুরী ঢাকা মেডিক্যালে যান আহত ছাত্রদের দেখতে। মেডিক্যালের আউটডোরে তিনি মাথার খুলি উড়ে যাওয়া মরদেহ দেখতে পান, যেটি ছিল ভাষা সংগ্রামী রফিকের মরদেহ। সেটি দেখে তার মনে হয়, এটা যেনো তারই ভাইয়ের রক্তমাখা লাশ। তৎক্ষণাৎ তার মনে গানের প্রথম দুটি লাইন জেগে ওঠে। কয়েকদিনের মধ্যে তিনি গানটি লেখেন।

 

ভাষা আন্দোলনে প্রথম প্রকাশিত লিফলেটে এটি 'একুশের গান' শিরোনামে প্রকাশিত হয়। ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত 'একুশে সংকলনে'ও এটি প্রকাশিত হয়। তৎকালীন যুবলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক সেটি আব্দুল লতিফকে দিলে তিনি এতে সুরারোপ করেন। আব্দুল লতিফ তখন এটি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাওয়া শুরু করেন।

 

ঢাকা কলেজের কিছু ছাত্র কলেজ প্রাঙ্গণে শহীদ মিনার স্থাপনের চেষ্টা করার সময়ও গানটি গান। গানটি গাওয়া ও লেখার অপরাধে ঢাকা কলেজ থেকে ১১জন ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়। ১৯৫৪ সালে আলতাফ মাহমুদ, তিনি তখন নামকরা সুরকার। পরে গানটিতে তিনি ফের সুরারোপ করেন। ১৯৫৪ সালে আলতাফ মাহমুদের সুরে প্রভাতফেরিতে গানটি প্রথম গাওয়া হয়। বর্তমানে এটিই গানটির প্রাতিষ্ঠানিক সুর হিসেবে স্বীকৃত।

 

প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের সব অঞ্চল থেকে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শ’ শ’ মানুষ এই গান গেয়ে শহীদ মিনার অভিমুখে খালি পায়ে হেঁটে যান। ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এদিন প্রভাতফেরিতে গানটি গেয়ে সবাই শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

 

বিবিসি শ্রোতা জরিপে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ গানের তালিকায় এটি তৃতীয় স্থান লাভ করেছে। গানটি দেশের শহুরে শিক্ষিত জনসাধারণের ভেতর ভাষা আন্দোলনের চেতনা তীব্রভাবে ছড়িয়ে দেয়। ঠিক সেভাবে দেশের সাধক-কবিদের চেতনাকে গভীরভাবে নাড়িয়ে দেয়।জাতিসত্তার সেই জাগরণ মুহূর্তে এই বাংলার স্বশিক্ষিত সাধক-কবিগণ সেদিন কালের বুকে রেখেছিলেন তার মাতৃভাষাপ্রীতি ও দেশপ্রীতির গভীর ছাপ। সেই কাহিনি গল্পের চেয়েও বিস্ময়কর।

 

মানিকগঞ্জের সংগীতসাধক মহিন শাহ ও সাইদুর রহমান বয়াতি, কুষ্টিয়ার সংগীতসাধক মকছেদ আলী সাঁই, চট্টগ্রামের সংগীতসাধক আবদুল গফুর হালী, ফরিদপুরের সংগীতসাধক আবদুল হালিম বয়াতি, বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের সংগীতসাধক শাহ আবদুল করিম সবাই ভাষা-আন্দোলনে গান গেয়ে ও পরিবেশন করে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।

 

৫২’র ভাষার গান রচয়িতাদের মধ্যে লালন-ঘরানার সাধক কবি মহিন শাহ অবশ্যই অগ্রগণ্য। ভাষা-আন্দোলনের এ চারণকবি ভাষার গান গাইবার অপরাধে পুলিশি-নির্যাতনের শিকার হন। ভাষা-প্রেমকে অবলম্বন করে তিনি ছিলেন দেশপ্রীতিতে উদ্বেলিত। ভাষা তার আবেগ ও চেতনাকে আচ্ছন্ন করে। তাই তিনি গেয়েছিলেন-

“আ-মরি বাংলা ভাষা

মা বলা ডাক মধুর লাগে

মায়ের গলা ধরে

মা মা বোলে পুলক জাগে॥”

 

ভাষা আন্দোলন, ভাষা-শহীদ প্রেক্ষাপট নিয়ে গান রচয়িতায় শাহ আবদুল করিম অবদান ঢের। গানে ভাষা-শহীদদের প্রাণ দানের ইতিহাসকে শুধু ভাষার জন্যে না-বলে ঘোষণা করেছেন দেশের জন্যও। তার রচিত ভাষা-শহীদ স্মরণের গানটির উদ্ধৃতি-

“সালাম আমার শহীদ স্মরণে

দেশের দাবী নিয়া দেশপ্রেমে মজিয়া

প্রাণ দিলেন যে সব বীর সন্তানে॥

ভাষার দাবী লইয়া আপনহারা হইয়া

স্মৃতি গেলেন রাখিয়া বাঙ্গালীর মনে

সালাম বরকত জব্বার প্রিয় সন্তান বাংলার

ভুলিবার নয় ভুলি কেমন”

 

ভাষার গান রচয়িতাদের মধ্যে সাইদুর রহমান বয়াতি উল্লেখযোগ্য। কিশোর বয়স থেকেই তিনি গান রচনা করেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, থাকতেন নিজ গ্রামে। যখন গ্রামে থেকেই শুনতে পান ঢাকায় গুলিবর্ষণের ঘটনায় বরকত, সালাম, রফিকের তাজা রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে, তখন তিনি বেদনায় মর্মাহত হন এবং অন্তর্বেদনা থেকে গেয়ে ওঠেন-

 

‘জন্মভূমি মায়ের ভাষা বলতে কেন দাও বাধা

তোমাদের কি হয় মাথা বেথা?

হায়রে বনের পাখি বনে থাকে

যার যার ভাষায় সেই ডাকে

তাতেই খুশি আল্লাপাকে

বুলিতে তার নাম গাঁথা॥

 

ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপট নিয়ে পূর্ণাঙ্গ জারি পালাসহ বেশ কিছু গান রচনা করেন ভাবসাধক আবদুল হালিম বয়াতি। এ জারি পালায় তিনি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের পুরো বিবরণ তুলে ধরেছেন।যা অনেক ইতিহাস পুস্তকেও দুর্লভ। জারি পালাতে হালিম বয়াতি লিখেছেন-

 

“উর্দু হবে রাষ্ট্রভাষা জিন্নাহ সাহেব কয়

ছাত্ররা সোচ্চার হয়ে প্রতিবাদ জানায়

বাংলা হবে রাষ্ট্রভাষা উর্দু আমরা মানি না॥

জিন্নাহর সাথে নাজিমুদ্দিন মুসলিম লীগ আর নুরুল আমিন

উর্দুভাষা চাইল সেদিন বাংলাভাষা চাইল না॥”

ফিচার বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর