ঢাকা, ২৬ নভেম্বর মঙ্গলবার, ২০২৪ || ১১ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
৭১৬

জেলা-উপজেলা হাসপাতালে নিরূপণ হচ্ছে স্তন ও জরায়ু ক্যান্সার

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২১:৫৭ ৯ ডিসেম্বর ২০১৯  

দেশে ও দেশের বাইরে নারীদের প্রাণঘাতি রোগের মধ্যে অন্যতম স্তন ক্যান্সার ও জরায়ু-মুখ ক্যান্সার। একটুখানি সচেতন হলে আর বাড়ির কাছের সরকারি হাসপাতালগুলো এবং মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্রে আসলে যেকোনও নারী খুব সহজেই ক্যান্সারের প্রাথমিক নিরূপণ কাজ করাতে পারেন। গুরুত্ব বিবেচনা করে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালগুলোতে স্তন ও জরায়ু ক্যান্সার পরীক্ষা করা হচ্ছে।
সেন্টার ফর সার্ভিক্যাল এন্ড ব্রেস্ট ক্যান্সার স্ক্রিনিং এন্ড ট্রেনিং প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, বিশ্বে ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীদের একটি বড় অংশ জরায়ু-মুখ ও স্তন ক্যান্সারের শিকার। আমাদের দেশে ২০১৮ সালে ৮ হাজার ৮৬ জন জরায়ু-মুখ ক্যান্সার আক্রান্ত নারীকে সনাক্ত করা হয়েছে। আর ক্যান্সারে আক্রান্তদের মধ্যে মারা গেছেন ৫ হাজার ২১৪ জন। অন্যদিকে ওই বছরে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীর সংখ্যা ছিল ১২ হাজার ৭৬৪ জন। আর এই ক্যান্সারে আক্রান্তদের মধ্যে মারা যান ৬ হাজার ৮৪৬ জন। প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় ১২ হাজার মহিলার জরায়ু-মুখে নতুনভাবে ক্যান্সার হচ্ছে।
অপরদিকে দেশে বছরে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা ১৫ হাজার। এর মধ্যে মারা যান ৮ হাজার। ৪০ বছরের পর থেকে নারীদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়তে থাকে। প্রাথমিকভাবে স্তন ক্যান্সারের উপসর্গের মধ্যে আছে স্তনের কিছুটা অস্বাভাবিক অবস্থা বা চাকা অনুভব, স্তনের চামড়ার রং পরিবর্তন বা চামড়া কিছুটা পুরু হয়ে যাওয়া, নিপল ভেতরে দেবে যাওয়া, নিপল দিয়ে রক্ত বা পুঁজ পড়া। আর স্তন ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়লে যকৃতের ক্ষেত্রে পেটে ব্যথা বা জন্ডিস, ফুসফুসে ছড়ালে কাশি হওয়া বা কাশির সঙ্গে রক্ত যাওয়া এবং হাড়ে তীব্র ব্যথা অনুভব হয়।
জরায়ু-মুখ ক্যান্সারের লক্ষণ হচ্ছে অতিরিক্ত সাদা  স্রাব, দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব, অতিরিক্ত অথবা অনিয়মিত রক্ত স্রাব, সহবাসের পর রক্ত স্রাব, মাসিক পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবার পর পুনরায় রক্তপাত, কোমরে বা তলপেটে অথবা উরুতে ব্যথা।
এই ধরনের কোনও সমস্যা হলে জাতীয় পরিচয়পত্রের ছায়ালিপি সহযোগে চলে আসতে হবে যেকোন জেলা সদর হাসপাতাল, মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র এবং নির্বাচিত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে। ৩০ বছরের বেশী বয়স হলেই জরায়ু-মুখ অবশ্যই পরীক্ষা (ভায়া) করাতে হবে। তবে ১৮ বছরের আগে বিবাহিত নারীদের ক্ষেত্রে ২৫ বছর বয়স হলেই জরায়ু-মুখ পরীক্ষা করাতে হবে। বয়স্কদের জন্যে ভায়া পরীক্ষা আরো জরুরী। এই পরীক্ষার মধ্য দিয়ে অন্যান্য স্ত্রী-রোগের চিকিৎসারও সুযোগ তৈরী হয়।
রোগের চিকিৎসার পরিবর্তে প্রতিরোধ করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। জরায়ু-মুখ ক্যান্সার খুব সহজেই প্রতিরোধ করা যায়। রোগে আক্রান্ত হওয়ার আগে জরায়ু-মুখে অনেকদিন ধরে ক্যান্সারপূর্ব অবস্থা বিরাজ করে। ক্যান্সারপূর্ব অবস্থা ধরা পড়লে সামান্য চিকিৎসার মাধ্যমে ক্যান্সার প্রতিরোধ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে জরায়ু ফেলে দেয়ার প্রয়োজন হয় না এবং চিকিৎসার পরেও সন্তান ধারণ করা সম্ভব।
নাটোর সদর হাসপাতালে স্তন ও জরায়ু-মুখ ক্যান্সারের প্রাথমিক পরীক্ষণ কাজে নিয়োজিত হোসনে আরা বলেন, যে পদ্ধতিতে জরায়ু-মুখ ক্যান্সারপূর্ব অবস্থা শনাক্ত করা হয় তাকে ‘ভায়া’ এবং স্তন ক্যান্সার পরীক্ষা পদ্ধতিকে ‘সিবিই’ বলে। এই পদ্ধতিতে জরায়ু-মুখ পরীক্ষা করলে ক্যান্সারপূর্ব অবস্থা সাদা রং ধারণ করে এবং রোগ নির্ণয়ে সাহায্য করে। আর স্তন ক্যান্সার বোঝার জন্যে স্তনে চাকা বা অস্বাভাবিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হয়। ‘বিএসএমএমইউ-এ সার্ভিক্যাল এন্ড ব্রেস্ট ক্যান্সার স্ক্রিনিং ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জাতীয় কেন্দ্র স্থাপন’ প্রকল্পের পক্ষ থেকে মোট ৩ সপ্তাহের প্রশিক্ষণ নিয়ে ২০০৭ সাল থেকে আমরা কাজ করছি এবং প্রতিমাসে এই হাসপাতালে গড়ে দুইশ’ নারীর পরীক্ষা কাজ সম্পন্ন হচ্ছে।
পরীক্ষা শেষে অনাক্রান্ত রোগীকে সবুজ রঙের কার্ড প্রদান করে কাউন্সিলিং শেষে ৩ বছর পরে আবার আসতে অনুরোধ করা হয়। পজিটিভ রোগীকে গোলাপী কার্ড প্রদান করে গাইনী বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে উন্নত চিকিৎসার জন্যে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বা বিশেষায়িত হাসপাতালে রেফার করা হয় বলে জানালেন অপর স্টাফ নার্স আশরাফুন্নেছা।
নাটোর মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের স্টাফ নার্স সুফিয়া খাতুন জানান, এই কেন্দ্রে নিয়মিত স্তন ও জরায়ু-মুখ ক্যান্সার পরীক্ষা করা হয়।
সিভিল সার্জনের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, নাটোর সদর হাসপাতাল এবং জেলার পাঁচটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২০১৮ সালে মোট এক হাজার ১৬৯ জন নারীর স্তন ও জরায়ু-মুখ ক্যান্সার পরীক্ষা করে ৫২ জনের ক্যান্সারপূর্ব অবস্থা সনাক্ত করা হয়েছে।
সিংড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আমিনুল ইসলাম জানান, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভায়া ও সিবিই পদ্ধতিতে ক্যান্সার নিরুপনের বিষয়টির ব্যাপক প্রচারণার জন্যে ২০১৭ সালের ১৪ আগস্ট ক্যাম্প আয়োজন করা হয়। ক্যাম্পে আগত ৭৫০ নারীকে পরীক্ষা করে ২৭ জনের জরায়ু-মুখ ক্যান্সার এবং ২৩ জনের স্তন ক্যান্সার সনাক্ত করা হয়। শেষে তাদেরকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ও পরামর্শ দেয়া হয়। আবারো ক্যাম্পের পরিকল্পনা করা হয়েছে-যাতে ক্যান্সার নিরূপণের পাশাপাশি পজিটিভ রোগীদের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হয়।
নাটোর সদর হাসপাতালে ভায়া ও সিবিই পরীক্ষাকারী কলেজ শিক্ষিকা রেবেকা সুলতানা (ছদ্মনাম) জানান, জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি সাথে করে মাত্র পাঁচ টাকার টিকিটের বিনিময়ে হাসপাতালে খুব অল্প সময়ে ক্যান্সার নিরূপণ পরীক্ষা হয়ে যায়। ৩ বছর পরে আবার পরীক্ষা করতে আসবো।
নাটোর সদর হাসপাতালের গাইনী বিশেষজ্ঞ ডা. শম্পা রাণী কুন্ডু বলেন, হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের কারণে জরায়ুতে ক্যান্সার হয়। জরায়ু-মুখ আবরণী কোষগুলোতে বিভিন্ন কারণে পরিবর্তন আসে। তা ধীরে-ধীরে ক্যান্সারে রূপ নেয় যা ১০ থেকে ১৫ বছর সময় লাগে। পারিবারিক ইতিহাস থাকাসহ স্তন ক্যান্সার বিভিন্ন কারণে শরীরে বাসা বাঁধতে দীর্ঘ সময় নেয়।
পুরোপুরি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ৮০ ভাগ রোগী এমন সময়ে হাসপাতালে আসেন তখন বড় অপারেশন বা রেডিওথেরাপি প্রয়োজন হয়। প্রাথমিক অবস্থায় হাসপাতালে আসলে চিকিৎসার মাধ্যমে শতভাগ রোগী ভালো হয়ে যান। তাই প্রত্যেকের উচিৎ এ ব্যাপারে সচেতন থাকা এবং নিয়মিত স্তন ও জরায়ু-মুখ পরীক্ষা করা।
হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের কারণে জরায়ুতে ক্যান্সার হয়। পরিচ্ছন্নতার স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলা, ফাস্টফুড পরিহার করে সতেজ ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, বাল্য বিবাহ, বেশী বয়সে সন্তান ধারণ না করা, বেশী সন্তান নেয়া থেকে বিরত থাকা, সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানো, স্থুলতা পরিহার করার মাধ্যমে স্তন ও জরায়ু-মুখ ক্যান্সারের ঝুঁকিমুক্ত থাকা সম্ভব বলে এই গাইনী বিশেষজ্ঞ উল্লেখ করেন।
হাসপাতালগুলোতে স্তন ও জরায়ু ক্যান্সার নিরূপণের ব্যবস্থা থাকার বিষয়টি ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে সর্বসাধারণকে অবহিত করতে পারলে অধিক নারী এই স্বাস্থ্য সেবা নিতে আসবেন জানিয়ে নাটোরের সিভিল সার্জন ডা. আজিজুল ইসলাম বলেন, এ ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।