ঢাকা, ২৭ ডিসেম্বর শুক্রবার, ২০২৪ || ১৩ পৌষ ১৪৩১
good-food
৯০

‘দরদি’ শিল্পপতি রতন টাটার সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ যত তথ্য

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ০৩:৫৭ ১১ অক্টোবর ২০২৪  

ভারতের ধনকুবের রতন টাটা মুম্বাইতে জন্ম নেন ১৯৩৭ সালে। বুধবার (৯ অক্টোবর) রাতে মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তার ঝুলিতে রয়েছে ‘পদ্মভূষণ’ এবং ‘পদ্মবিভূষণ’ সম্মাননা। তথ্য বলছে, তিনি ৩৮০০ কোটি রুপির সম্পত্তি তিনি রেখে গেছেন।

 

রতন টাটা ছিলেন ভারতের অন্যতম বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান টাটা গ্রুপের ইমেরিটাস চেয়ারম্যান। ১৯৯১ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত টানা ২১ বছর ধরে তিনি এ গ্রুপের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বর্তমানে এই শিল্পগোষ্ঠীর শতাধিক কম্পানি আছে। সেসব কম্পানিতে প্রায় ছয় লাখ ৬০ হাজার কর্মী কাজ করেন।

 

১৫৫ বছর পুরনো টাটা গ্রুপের বার্ষিক আয় ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি। টাটা গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার প্রপিতামহ জামসেদজি টাটা। জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার থেকে টাটা স্টিল, আকাশযান থেকে সল্ট প্যান - এমন নানামুখী খাতের এক বিপুল ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন তিনি।

 

টাটা শিল্পগোষ্ঠীর ওপর লেখা বই ‘দ্য স্টোরি অফ টাটা’-এর লেখক পিটার ক্যাসির মতে, এই শিল্পগোষ্ঠীর নীতি ‘পুঁজিবাদ ও পরোপকারকে সমান্তরালে রাখা, মানে এমনভাবে ব্যবসা করা যাতে অন্যের জীবন উন্নত হয়’। এ গ্রুপের নিয়ন্ত্রণকারী কম্পানি টাটা সন্স। পিটার ক্যাসি ব্যাখ্যা করেন, ‘টাটা সন্সের এমন অনেক কম্পানি রয়েছে যেগুলো জনহিতকর ট্রাস্টের মালিকানাধীন।’ 

 

১৯৩৭ সালে একটি ঐতিহ্যবাহী পার্সি পরিবারে রতন টাটার জন্ম। পার্সিরা একটি উচ্চ শিক্ষিত ও সমৃদ্ধ সম্প্রদায়, যারা একটা সময়ে ইরান থেকে ভারতে স্থানান্তরিত হয়েছিলো। তবে জন্মের তিন বছরের মাথায় ১৯৪০-এর দশকে রতন টাটার বাবা-মা আলাদা হয়ে যান।

 

রতন টাটার বাবা নাভাল টাটা পরিবারে এসেছিলেন দত্তক সন্তান হিসেবে। নাভালের প্রথম স্ত্রী সোনির ঘরে জন্ম হয় রতন টাটার। লিয়া টাটা, মায়া টাটা এবং নেভিল টাটা হলেন রতন টাটার সৎ ভাই নোয়েল টাটার সন্তান। নোয়েল টাটা হলেন রতনের বাবা নেভাল টাটা এবং সৎ মা সিমোনের সন্তান। নভল টাটা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন সিমোন টাটাকে।

 

রতন টাটার মা সুনি টাটা সরাসরি জামশেদজি টাটার পরিবারের অংশ। রতন টাটার পিতামহ হরমসজি টাটা জন্মসূত্রেই ওই পরিবারের সদস্য। রতন টাটার যখন ১০ বছর বয়স, সেই সময় তার মা-বাবা আলাদা হয়ে যান। রতন টাটার নিজের এক ভাইও রয়েছেন, জিমি টাটা। নভল টাটা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন সিমোন টাটাকে। 

 

রতন টাটার পড়াশোনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি স্থাপত্যে ডিগ্রি লাভ করেন। সেখানে তিনি সাত বছর ছিলেন এবং ওই সময়ে তিনি গাড়ি ও বিমান চালানো শিখেছিলেন। ১৯৬২ সালে তিনি ভারতে ফিরে আসেন। তখন তার দাদী লেডি নাভাজবাই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সে সময়ই তার আত্মীয় জেহাঙ্গীর রাতানজি দাদাভয় টাটা বা জেআরডি টাটা তাকে টাটা গ্রুপে যোগ দিতে বলেন।

 

রতন টাটাকে ভারতের জামশেদপুরে একটি স্টিল প্ল্যান্টে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে কম্পানির ম্যানেজারের প্রযুক্তিগত সহকারী হওয়ার আগে কয়েক বছর তিনি কারখানার মেঝেতে কাটিয়েছিলেন। ৭০ এর দশকের গোড়ার দিকে তিনি দুটি ভঙ্গুর ফার্মের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। একটি রেডিও এবং টিভি, আরেকটি টেক্সটাইল। দুটি ফার্মকেই ঘুরে দাঁড় করাতে সক্ষম হন তিনি।

 

জেআরডি টাটা অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে এই শিল্পগোষ্ঠীর নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু ১৯৯১ সালে তিনি কম্পানির সিনিয়র প্রার্থীদের বাদ দিয়ে রতন টাটাকে তার উত্তরসূরি হিসেবে নিয়োগ দেন।

 

লেখক পিটার ক্যাসি লিখেছেন, রতন টাটার নেতৃত্বে টাটা গ্রুপ একটি বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ড হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং তিনি ভোগ্য পণ্যের ওপর ব্যাপক জোর দেন। তার মেয়াদে গোষ্ঠীটি অ্যাংলো-ডাচ ইস্পাত প্রস্তুতকারক কোরাস এবং যুক্তরাজ্যভিত্তিক গাড়ি ব্র্যান্ড জাগুয়ার ও ল্যান্ড রোভারের অধিগ্রহণের মতো অনেক বড় পদক্ষেপ নিয়েছিলো। সেসব সিদ্ধান্তের অনেকগুলোই লাভের মুখ দেখেছে। টেলিকম উদ্যোগের মতো কয়েকটিতে আবার ক্ষতিও হয়েছে। টাটা গ্রুপ এমন একটি বিন্দুতে এসে পৌঁছায়, যখন তারা টেটলিকে কিনে নেয় এবং বিশ্বের বৃহত্তম চা কোম্পানিতে পরিণত হয়।

 

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিরাপদ ও সাশ্রয়ী মূল্যের গাড়ি তৈরিতে টাটার যে প্রচেষ্টা, তা একটা সময়ে হতাশায় রূপ নিয়েছিল। এটি ২০০৯ সালে ব্যাপক ধুমধাম করে যাত্রা শুরু করেছিল। তখন বেজ মডেলের গাড়ির দাম ছিল মাত্র এক লাখ রুপি। কিন্তু প্রাথমিক সাফল্যের পর উৎপাদন ও মার্কেটিং-এর নানা সমস্যার কারণে তা অন্যান্য প্রস্ততকারকদের কাছে হেরে যেতে শুরু করে। রতন টাটা পরে বলেছিলেন, ‘ন্যানোকে বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা গাড়ি হিসেবে প্রচার করাটা একটি বিশাল ভুল ছিল। কারণ মানুষ বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা গাড়ি চালাতে চায় না।’

 

২০০৮ সালে মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলার সময়ও তিনি তার দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছিলেন। মুম্বাইতে টাটার বিলাসবহুল মার্কই তাজ মহল প্রাসাদ হোটেলে হামলা করা হয়েছিলো। তখন আরো একটি বিলাসবহুল হোটেল, একটি ট্রেন স্টেশন, একটি হাসপাতাল, একটি ইহুদি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রসহ আরো কয়েকটি স্থাপনায় সন্ত্রাসী হামলা হয়েছিলো।

 

৬০ ঘণ্টার অবরোধে ১৬৬ জন নিহত হয়েছিলেন তখন এবং তাদের ৩৩ জনই তাজে ছিলেন। নিহতদের এক তৃতীয়াংশ, মানে ১১ জন ছিলেন তাজের কর্মচারী। ওই সময় তাজের যেসব কর্মচারী আহত বা নিহত হয়েছিলেন, তাদের পরিবারের দেখাশোনা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তাজ।

 

নিহতরা তাদের বাকি জীবনে যে বেতন পেতেন, তাদের স্বজনদেরকে তা পরিশোধ করে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন। শুধু তাই নয়, পরবর্তী ২১ মাসের মাঝে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হোটেলকে পুনরুদ্ধার করেছিলেন। এজন্য তার ব্যয় হয়েছিলো এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি।

 

তার কর্মজীবনের শেষের দিকে ২০১৬ সালে তিনি একটি বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। ওই বছরের অক্টোবরে টাটা সন্সের চেয়ারম্যান সাইরাস মিস্ত্রিকে (২০২২ সালে একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান) ক্ষমতাচ্যুত করার পর তিনি অন্তর্বর্তী চেয়ারম্যান হন। তখন এটি নিয়ে একটা ব্যবস্থাপনা বিরোধের জন্ম হয়।

 

পিটার ক্যাসে রতন টাটাকে একজন ‘বিনয়ী, ভারিক্কি ও এমনকি লাজুক মানুষ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। রতন টাটা এতটাই নিয়মতান্ত্রিক ছিলেন যে সারাদিন তিনি কী কী করবেন, দিনের শুরুতেই হাতে লিখে সেই তালিকা তৈরি করতেন। তিনি নিজেকে ‘আশাবাদী’ মানুষ মনে করতেন।

 

এদিকে, দ্রুতগামী গাড়ি এবং প্লেনের প্রতি রতন টাটার যেমন ভালোবাসা ছিল, ঠিক তেমন তিনি স্কুবা ড্রাইভিং-এও উৎসাহী ছিলেন। যদিও একটা বয়সের পর শারীরিক কারণে তিনি এটি করতে পারতেন না। তিনি একজন কুকুর প্রেমিকও ছিলেন। অনেক পোষা প্রাণীর কথা তার মনে ছিল, যারা তাকে কয়েক দশক ধরে বিভিন্ন সময়ে সঙ্গ দিয়েছে। ২০০৮ সালে ভারত সরকার দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান পদ্মবিভূষণ প্রদান করে তাকে।

 

ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে খুব একটা কথা বলতেন না রতন টাটা। তবে বেশ কবছর আগে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের সঙ্গে খানিকটা মন খুলে কথা বলেছিলেন তিনি। রতন টাটা বলেছিলেন, প্রেম করলেও বিয়ে করার সাহস আর পাননি। কোনো না কোনো কারণ দেখিয়ে পিছু হটেছেন। প্রথম প্রেমিকা ছিলেন এক মার্কিন তরুণী। যুক্তরাষ্ট্রে তখন কাজ করতেন তিনি। প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যেও তার সঙ্গে ওই তরুণীর সম্পর্ক তৈরি হয়। কিন্তু তাকে বিয়ে করতে পারেননি। দ্রুত ভারতে ফিরে আসার কারণে সে সম্পর্ক পূর্ণতা পায়নি।

 

২০১১ সালে একটি সাক্ষাৎকারে রতন টাটা বলেছিলেন, তার জীবনে চার বার বিয়ের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল‌। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নানা কারণে পিছিয়ে আসতে হয় তাকে। একাধিক সম্পর্কে জড়ালেও শেষ পর্যন্ত বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি রতন টাটা। তাই শেষদিন পর্যন্ত কুমার থেকে গেলেন। ছোটবেলা বাবা-মায়ের বিচ্ছেদই রতন টাটার মধ্যে বিয়ের ভীতি তৈরি করেছে বলে অনেকের ধারণা।

বিশ্ব বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর