ঢাকা, ২৩ নভেম্বর শনিবার, ২০২৪ || ৯ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
১৩৪

নাগরিক কমিটি গঠন, কোন পথে যাচ্ছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ০৫:৪৫ ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪  

প্রথমে কোটা সংস্কার আন্দোলন, সেই আন্দোলন থেকে সরকার পতনের এক দফা দাবি। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো গণঅভ্যুত্থানের মুখে সরকার প্রধানের দেশ ছেড়ে পলায়ন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন দেশের ছাত্র-জনতা।

 

শেখ হাসিনা সরকার পতনের এক মাসের মাথায় এবার নতুন প্লাটফর্ম হিসেবে আত্নপ্রকাশ ঘটেছে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তৈরি প্লাটফর্ম জাতীয় নাগরিক কমিটি। তবে রাজনৈতিক প্লাটফর্ম হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও এখনই রাজনৈতিক দল হিসেবে কার্যক্রম শুরু করবে না এই সংগঠন।

 

এই সংগঠনটি বলছে, গত ১৫ বছরেরও বেশি সময় রাষ্ট্র পরিচালনা থাকা অবস্থায় দেশের বিভিন্ন সেক্টরে এখনো স্বৈরাচারী ধারা ও অব্যবস্থাপনা রয়ে গেছে। এমন অবস্থায় যাত্রা শুরুর পর ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’ সারাদেশের জেলা, উপজেলা ও মহানগরে তাদের কার্যক্রম শুরু করবে। এক্ষেত্রে তাদের প্রথম কাজ হবে সংস্কার।

 

সদস্য সচিব হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাবেক ডাকসু (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ) নেতা আখতার হোসেন।তিনি বলেন, “এটা রাজনৈতিক প্লাটফর্ম, তবে এখনই রাজনৈতিক দল হিসেবে আমরা যাত্রা শুরু করছি না। দল হিসেবে কার্যক্রম কবে কিংবা কিভাবে হবে সেটা ভবিষ্যতের পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে”।

 

বাংলাদেশের ক্ষমতাকেন্দ্রীক রাজনীতিতে গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক জোট আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। সে সময় নানা সংকটময় পরিস্থিতিতে বিভিন্ন তৃতীয় রাজনৈতিক জোট গঠনের চেষ্টা করলেও তা সফলতার মূখও দেখেনি। এ অবস্থায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে গড়ে ওঠা এই প্লাটফর্মটি আগে সংবিধান পরিবর্তন করে রাজনৈতিক কাঠামোতে আগে পরিবর্তন আনতে চায়। এরপর রাজনৈতিক দল হিসেবে যাত্রা শুরুর দিকে নজর দিতে চায় তারা।

 

শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর গত আটই অগাস্ট নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ছয় সদস্যের একটি লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তখন এই সংগঠনের অন্যতম সমন্বয়ক ও বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছিলেন, “এই কমিটি সকল অংশীজনের সঙ্গে সংলাপ ও আলোচনা করবে। এই কমিটি সরকারের বিভিন্ন কাজের জবাবদিহিতা নিশ্চিতের ব্যাপারেও কাজ করবে”।

 

এরপর গত একমাস ধরে ওই লিঁয়োজো কমিটি কাজ করে এই জাতীয় নাগরিক কমিটির রুপরেখা চূড়ান্ত করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা নাসির আব্দুল্লাহকে আহবায়ক ও গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তির আহবায়ক আক্তার হোসেনকে সদস্য সচিব করে কমিটি চুড়ান্ত করা হয়।

 

ওই লিঁয়াজো কমিটির সদস্য ও জাতীয় নাগরিক কমিটির আহবায়ক আরিফুল ইসলাম আদিব বিবিসি বাংলাকে বলেন, “গত দেড় দশকে দেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ কিংবা রাজনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যারা যুক্ত ছিল তাদের নিয়েই কমিটি করা হয়েছে”। মূলত প্লাটফর্মটিতে থাকছে তরুণ ও যুব সমাজের প্রতিনিধিরা। যাদের বয়স ২৮ থেকে ৪৪ বছরের মধ্যে তারাই প্রাধান্য পেয়েছে।

 

নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব বলেন, “সিনিয়র সিটিজেন যারা আছেন তাদেরকে অভিজ্ঞতা ও পরামর্শকে কাজে লাগাতে তাদেরকে রাখা হবে উপদেষ্টা হিসেবে”। জাতীয় নাগরিক কমিটির সংগঠকরা বলছেন, রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কারে প্রেশার গ্রুপ হিসেবে কাজ করবে এ কমিটি।

 

প্রাথমিকভাবে কেন্দ্রীয় আহবায়ক কমিটি সারাদেশের ৬৪ জেলা ও ১২টি মহানগর এবং উপজেলা পর্যায়ে নাগরিক কমিটি গঠন করবে। এরপর জাতীয়ভাবে কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে। সেই কাউন্সিল নতুন করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি প্রস্তুত করবে। সংগঠক আরিফুল ইসলাম আদিব বলেন, “আওয়ামী লীগ গত পনেরো বছরে বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছে। সরকার পতনের পর সেই জায়গাগুলোতে এক ধরনের ভ্যাকুয়াম তৈরি হয়েছে। এই কমিটি সে সব জায়গাগুলোতে সংস্কার আনতে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত কাজ করবে”।

 

এই সংস্কার করতে গিয়ে সংবিধান সংশোধন কিংবা পরিবর্তনে জোর দিচ্ছে নাগরিক কমিটি। সংগঠনটির নেতৃত্ব বলছেন, সবার আগে নতুন গঠিত কমিটি সংবিধান পুনর্লিখনের জন্য গণপরিষদ তৈরি করতে জনমত গঠন ও প্রস্তুতি নিতে কাজ করবে শুরুতেই।

 

সদস্য সচিব বলেন, “বর্তমানে বাংলাদেশের যে সংবিধান রয়েছে আবার ফ্যাসিবাদ পুর্নজ্জীবিত করতে পারে। যে কারণে নতুন একটি সংবিধানের বিষয়ে জনগণের মধ্যে আমরা এই আলাপটা জোরালো করতে চাই”। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রাথমিক কমিটি গঠিত হয়।

 

শুরুতে সমন্বয়ক কমিটি ছিল ৬৫ জনের। পরে অগাস্টের শুরুতে যখন সরকার পতনের এক দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু হয় তখন এই কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা হয় ১৫৮ সদস্য নিয়ে। পাঁচই অগাস্ট সরকার পরিবর্তনের পরে যে সরকার গঠন হয়েছে সেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারেও রয়েছে এই সমন্বয়কদের দুই জন।

 

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ অন্তর্ভূক্ত হওয়ার ঘোষণার পর কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয় তাদের কার্যক্রম। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র সংস্কারে যে লিঁয়াজো কমিটি গঠন করা হয় গত আটই অগাস্ট, সেই কমিটি জাতীয় নাগরিক কমিটির কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে।

 

এক্ষেত্রে যাদের এখনো শিক্ষাজীবন রয়েছে, অর্থাৎ যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছেন তাদের সাথে কাজ করবে আগে থেকে গঠিত ছাত্র বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই সংগঠনের নেতৃত্ব দিবে হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস আলম, আব্দুল হান্নান মাসুদ ও আবু বাকের মজুমদারসহ অন্য সমন্বয়করা।

 

হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, দুটি সংগঠনের মধ্যে বড় কোন পার্থক্য নেই। আমরা ছাত্র নাগরিকদের নিয়ে কাজ করবো। আর নাগরিক কমিটি বাকিদের নিয়ে কাজ করবে। আর যাদের ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে এখন যুবক বা তরুণ প্রজন্মের তাদের নিয়ে কাজ করবে জাতীয় নাগরিক কমিটি।

 

জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব বলেন, “আমরা সবাই গণঅভ্যুত্থানের স্প্রিট ও আকাঙ্ক্ষা ধারণ করি। সাম্য ও বৈষম্যহীন সমাজের আকাঙ্ক্ষা থেকে দুটি প্লাটফর্ম এক। আলাদা কোন পার্থক্য নেই”। গত পাঁচই অগাষ্টের গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া সংগঠকরা বলছে 'ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান যে নতুন রাজনৈতিক ভাষা ও জনগোষ্ঠীর সম্ভাবনা হাজির করেছে, তা বাস্তবায়ন করতে হলে বাংলাদেশকে নতুন করে গঠন করতে হবে'।

 

এক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে তারা এই জাতীয় নাগরিক কমিটি করেছে। তাহলে এটি কমিটি কী কোন অরাজনৈতিক মঞ্চ নাকি রাজনৈতিক ভবিষ্যত নিয়েও চিন্তা করছে, সেই প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসছে। জবাবে এই সংগঠনটি বলছে, এটা একটা রাজনৈতিক প্লাটফর্ম। এখানে যারা আসছে সবাই রাজনৈতিক সচেতন। তবে রাজনৈতিক দল বা পার্টি পলিটিক্স আপাতত তাদের লক্ষ্য না।

 

সংগঠনটির শীর্ষ সংগঠকরা বলছেন, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ এই চার মূলনীতির ওপর দাড়িয়ে বর্তমান সংবিধান। এখন গণঅভ্যুত্থানের পর যেহেতু নতুন সংবিধান লেখার দাবি উঠেছে। সংগঠক বলেন, সংবিধান নতুন হলে বর্তমান যে রাজনৈতিক দলগুলো রয়েছে সেগুলোরও গঠনতন্ত্র নতুন করে করতে হবে। কারণ তখন নতুন সংবিধানে অনেক কিছুই পরিবর্তন হতে পারে। তাই আমরা এখনই চুড়ান্তভাবে কিছু বলছি না”।

 

জাতীয় নাগরিক কমিটি বলছে, এই প্লাটফরমে যারা থাকছে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক দল হিসেবে চালু হওয়ার পর সবাই রাজনীতি করবে এমন না। কেউ রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টরে যাবে, কেউ কেউ আবার সরাসরি রাজনীতিতে অংশ নিতে পারে এই প্লাটফর্ম থেকেই।

 

সদস্য সচিব বলেন, "পরবর্তী রাজনৈতিক অবস্থান আমরা দেখবো, তারপর এই নিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নেবো। তবে, আমরা এখনো কোন অরাজনৈতিক সংগঠন না”। তারা বলছেন, ভবিষ্যতে রাজনীতিতে ফ্যাসিবাদ বন্ধ করতেই তারা অগ্রসর হচ্ছে। এর শেষটা নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের মাধ্যমেই হতে পারে।