ঢাকা, ২৩ নভেম্বর শনিবার, ২০২৪ || ৯ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
১০৪২

নুরুর অভাবিত বিজয়

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২০:৫৯ ১৮ মার্চ ২০১৯  

২৮ বছর পর ডাকসু নির্বাচন উপলক্ষে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত প্রতিষ্ঠানটি গত দুদিন কাটালো উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে। সোমবার গভীর রাতে টিভি পর্দায় দেখি অনেকগুলো মুষ্টিবদ্ধ হাতের আক্রমণাত্মক ভঙ্গি এবং একজন অসহায় কর্তার মুখচ্ছবি। যিনি কিছুক্ষণ আগেই ঘোষণা করেছেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার নতুন নায়ককে নির্বাচিত করেছে; নায়কের নাম নুরুল হক নুরু। সেসময় উপস্থিত ছাত্রদের মাঝে তখন একটাই শব্দ উচ্চারিতে হচ্ছিল- ‘ভুয়া, ভুয়া...। ইতিহাস বলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই একদিন উচ্চারিত হয়েছিল ‘নো নো, ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই, ‘আইয়ুব শাহী ধ্বংস হোক- এমন স্লোগান। এখন সেই একই ক্যাম্পাসে শোনা যায়- ‘ভুয়া ভুয়া, ‘ধর ধর, ‘তুলে নেব চামড়া ইত্যাদি। শ্লোগানে আশ্চর্য পরিবর্তন এসেছে শতবর্ষী এই বিদ্যাপীঠে!

গত ১১ মার্চের অতি আশ্চর্য রাতের আগে-পরে যে দুদিন সূর্যের আলোয় কাটিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সেখানে কেবল মুহূর্তের রঙের পরিবর্তন। এই সাদা তো, এই কালো। ‘ডাকসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেতনায় ঢুকে যাওয়া একটি নাম; তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে আছে ঐতিহ্য আর গৌরবের ইতিহাস। বাংলাদেশ নামক যে বদ্বীপ একদা অন্যের অধীন ছিল, তারও স্বাধীন হওয়ার পেছনে রয়েছে এই ডাকসুর গৌরবজ্জ্বল ভূমিকা। বাংলার ইতিহাসের খলিফারা এখানেই পদচারণা করতেন। খলিফারা যার আদর্শে উজ্জীবিত ছিলেন তিনি আমাদের জাতির পিতা। তো এই ডাকসু নির্বাচনের ইতিহাস বলে- এটি স্বতঃস্ফূর্ত হয়, নিরপেক্ষ হয়, উৎসবমুখর হয়। কিন্তু সোমবার সকালে ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার কিছু সময় পর থেকেই এই নির্বাচনটি আলোচিত হতে থাকে। যে উৎসবের ছবি রঙিন হওয়ার কথা ছিল, সেখানে কালো রং স্পষ্টতর হতে থাকে। আতঙ্ক ছড়ায় নানা জায়গায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি জায়গায় উচ্চ মনন আর উন্নত নৈতিকতার শিক্ষায় শিক্ষিত হতে আসা দেশসেরা মেধাবী তরুণেরা দিনের আলোয় অনিয়মের উৎসব প্রত্যক্ষ করে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। সব দলই জয়ী হতে চায়- নির্বাচনে এই চাওয়াটা দোষের নয় কিন্তু নিজেদের বলয়ের বাইরে কাউকে জয়ী হতে দেয়া যাবে না এমন মানসিকতা অন্তত ডাকসুর ক্ষেত্রে মানায় না।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বরাবরই বলে এসেছেন নির্বাচন অবাধ এবং সুষ্ঠু হয়েছে। পুনরায় নির্বাচনের দাবি তারা আমলেই নেননি। রাত তিনটার দিকে জাতি জানতে পেরেছে ডাকসুর নতুন ভিপির নাম। যারা ঘুমিয়ে পরেছিলেন তারা সকালে ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলে দেখেন তার নাম- নুরুল হক নুরু। এমন অপ্রত্যাশিত বিস্ময় জাতি দীর্ঘদিন পায়নি। চারদিকে কেবল অবিশ্বাস ভেসে বেড়ায়। নির্বাচন নিয়ে সব দেশে, সব কালে অনেক কথা হয়, ভবিষ্যতেও হবে। তবে ইদানিং একটু বেশি হয়। ধারণা করি, দেশের তরুণ সমাজের একটি বড় অংশ এই খবরে খুশি। পাঠকের নিশ্চয়ই কোটাবিরোধী আন্দোলনের কথা ভুলে যাওয়ার কথা নয়। সেসময় এই নামটি বহুবার উচ্চারিত হয়েছে। নামটি অনেকের চেতনায় আঘাত করেছে, নিদ্রা ভঙ্গ করেছে; তখন জেগে উঠেছিল দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। আশা করছি তার হাত ধরেই পুনরায় জেগে উঠবে ডাকসু।

নুরু বাংলা মায়ের কৃষকের ঘরের সন্তান। অনেক তরুণ মনে করেন, তিনি ফিনিক্স পাখির মতো পুনর্জাগরণের নায়ক। একটি ছবি চোখে ভাসছে- কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় নুরু ধাওয়া খেতে খেতে এক পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের সামনে এক শিক্ষকের দুই পায়ের আড়ালে আশ্রয় নেন। সেদিন ওই শিক্ষক তাকে আড়াল করে রক্ষা করতে পারেননি। নুরু নিগৃহীত হয়েছিলেন সেদিন। নুরু মার খান, জেলে যান, তার নামে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা হয়। তিনি তবুও বলেন, ‘আমরা ন্যায্যতা চাই। নুরুকে অপবাদও দেয়া হয়েছে, অপঘাত করা হয়েছে, তাতে তিনি দমে যাননি। ইংরেজিতে ‘রিজিলিয়েন্স একটা শব্দ আছে। বাংলায় বলে বারবার প্রত্যাবর্তন। কিসের থেকে প্রত্যাবর্তন? পতনোন্মুখ অবস্থা থেকে, ধ্বসের কিনার থেকে, মৃত্যুর দুয়ার থেকে। নুরুল হক নুরু এই সবকটি অবস্থা থেকেই প্রত্যাবর্তন করেছেন। অথচ কত অন্ধকার আর কালো তার পথ রুদ্ধ করার প্রচেষ্টায় ছিল, কিন্তু তাকে থামানো যায়নি। তাই গত সোমবারের গল্প মঙ্গলবারে এসে নানান রূপ ধরে। কেউ বলেন আপস, কেউ বলেন সাহস! নুরু কেন জিতল, কীভাবে জিতল? জিতল নাকি জেতানো হলো? অনেক প্রশ্ন মনে! আমি বলি, কী দরকার এসব প্রশ্নের? নুরু ভিপি হয়েছে- এটাই কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য স্বস্তির নয়? নুরু ভোটের মাধ্যমেই জিতে এসেছে। তার প্রবল প্রতিপক্ষ সেটা মেনে নিয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছে। এটাই তো সত্যিকারের গণতান্ত্রিক মনোভাব। মেয়েদের হলে সুষ্ঠু ভোটের প্রভাব নুরুর বিজয়ে রয়েছে। এছাড়া ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোনো কোন্দলের ফসলও নুরুর ঘরে উঠতে পারে! ছাত্রদলের ভোটও তিনি পেতে পারেন। ফলে ভোট কম পাওয়ার পরও অন্য কোনো ইশারায় নুরুকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে- এমন কাল্পনিক বাক্যে অন্তত আমার বিশ্বাস নেই। আমি মনে করি, এই বিজয় ভবিষ্যত গণতন্ত্রের, গণতান্ত্রিক সৌন্দর্যের।

সিটিজেন জার্নালিজম বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর