ঢাকা, ২৫ নভেম্বর সোমবার, ২০২৪ || ১০ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
৬২৬

ফেরত আসা অভিবাসীদের ৮৭ শতাংশেরই নেই আয়ের উৎস

শরিফুল হাসান

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৩:১৪ ২৭ মে ২০২০  

দেশে ফেরত আসা অভিবাসী কর্মীদের ৮৭ শতাংশেরই এখন কোনো আয়ের উৎস নেই। নিজের সঞ্চয় দিয়ে তিন মাস বা তার বেশি সময় চলতে পারবেন এমন সংখ্যা ৩৩ শতাংশ। ৫২ শতাংশ বলছেন, তাদের জরুরি ভিত্তিতে আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন।

 

বিদেশফেরত অভিবাসী কর্মীদের জীবন ও জীবিকার ওপর কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব নিয়ে ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির পক্ষ থেকে আমরা একটি জরিপ করেছিলাম। তাতে আমরা এসব তথ্য পেয়েছি।

 

জরিপে অংশ নেওয়া অভিবাসী কর্মীদের মধ্যে ৩৪ শতাংশ জানান, তাদের নিজেদের সঞ্চয় বলতে এখন আর কিছু নেই। ১৯ শতাংশ জানিয়েছেন, তাদের যে সঞ্চয় আছে তা দিয়ে আরও এক-দুই মাস চলতে পারবেন। নিজেদের সঞ্চয় দিয়ে তিন মাস বা তার বেশি সময় চলতে পারবেন এমন সংখ্যা ৩৩ শতাংশ। ১০ শতাংশ জানান, নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে ইতোমধ্যেই আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক উৎস থেকে তারা ঋণ গ্রহন করেছেন।

 

ফেরত আসা অভিবাসীদের শতকরা ৮৪ ভাগ জানিয়েছেন, এখনো জীবিকা নিয়ে কোনো পরিকল্পনা করতে পারেননি। ৬ শতাংশ জানিয়েছে, তারা পুনরায় বিদেশ যাওয়ার কথা ভাবছেন। বাকীরা কৃষিভিত্তিক ছোটো ব্যবসা, মুদি দোকান বা অন্য কিছু করার পরিকল্পনা করছেন।

 

বিদেশফেরত এই অভিবাসীরা কোন ধরনের সহায়তা পেয়ছেন কী না জানতে চাইলে ৯১ শতাংশ বলেছেন তারা এখনো সরকারি বা বেসরকারি কোন জায়গা থেকে কোন সাহায্য সহযোগিতা পাননি। বাকি ৯ শতাংশ সরকারি বা বেসরকারি কোন না কোন জায়গা থেকে সামান্য হলেও সহযোগিতা পেয়েছেন।

 

বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমন শুরুর পর ফেরত এসেছেন এমন ৫৫৮ জন প্রবাসী কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জরিপটি পরিচালনা করা হয়। এর মধ্যে ৮৬ শতাংশই ফিরেছেন মার্চে। জরিপর অংশগ্রহণকারীদের ৪৫ শতাংশ ‍এসেছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, বাহরাইন ওমান এবং কুয়েত থেকে। বাকিরা মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইতালি, মালদ্বীপসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ফিরেছেন।

 

আমরা জানতে চেয়েছিলাম কেন বিদেশ থেকে ফিরতে হলো? জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৪০ শতাংশ বলেছেন, করোনার কারণে তারা দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। ৩৫ শতাংশ বলছেনে, তারা ছুটিতে এসেছিলেন। ১৮ শতাংশ বলেছেন, তারা পারিবারিক কারণে চলে এসেছেন। ৭ শতাংশ বলেছেন, তাদের ফেরার সাথে করোনার কোন সম্পর্ক নেই। তবে এখন সবাই আবার কাজে যোগ দেওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় আছেন।

 

প্রবাসীরা কোয়ারিন্টেন করেছেন কী না আমরা জানতে চেয়েছিলাম। ৮৪ শতাংশ বলেছেন, তারা ১৪ দিনের কোয়ারিন্টেনে ছিলেন। ১৪ শতাংশ বলেছন, তারা কোয়ারিন্টেন ঠিকমতো মানতে পারেননি। দুই শতাংশ বলেছেন, তারা এক সপ্তাহ কোয়ারিন্টেনে ছিলেন।

প্রবাসীরা বলেছেন, এখন তারা ভালো নেই। ৭৪ শতাংশ জানিয়েছেন, তারা প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও ভীতির মধ্যে রয়েছেন। আমরা তাদের সবাইকে মনোসামাজিক সেবা দিয়ে যাচ্ছি।

 

দেশে ফেরার পর অনেক প্রবাসীকে নেতিবাচক পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল। ২৯ শতাংশ অভিবাসী বলেছেন তাদের প্রতিবেশী এবং আত্মীয়-স্বজনেরা তাদের ফিরে আসাকে স্বাভাবিকভাবে নেয়নি এবং তাদের প্রতি সহযোগিতামূলক মনোভাব প্রদর্শন করেনি। তবে ৯৭ শতাংশ বলেছেন, এক্ষেত্রে পরিবার সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।

 

আপনারা জানেন করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে শুরু থেকে দেশজুড়ে নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করছে ব্র্যাক। এই কাজের সাথে যুক্ত আছে ব্র্যাকের এক লাখেরও বেশী কর্মী, স্বেচ্ছাসেবক ও স্বাস্থ্যকর্মী। সারা দেশে চার কোটি ৩০ লাখ (৪৩ মিলিয়ন) মানুষের কাছে করোনা ভাইরাস বিষয়ক সচেতনতা বার্তা পৌঁছে দিয়েছে ব্র্যাক। শুধু তাই নয় ব্র্যাক ১৫ লাখ মানুষের মাঝে সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণ এবং তিন লাখ পরিবারকে নগদ অর্থ সহায়তাও প্রদান করেছে। এছাড়া বিদেশ প্রত্যাগতদের কোয়রেন্টাইন হিসেবে ব্যবহার করার জন্য ইতোমধ্যে উত্তরায় বিমানবন্দরের উল্টো দিকে ব্র্যাকের ৪৩০ টি কক্ষ সরকারকে প্রদান করা হয়েছে। করোনা ভাইরাস সংক্রমণে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে নমুনা পরীক্ষার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে সহায়তা করতে ১০০ টি বুথ স্থাপনের কাজ করছে ব্র্যাক।

 

অভিবাসীদের নানা ধরনের সেবা দিতে ২০০৬ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছে ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি। বিদেশ ফেরতদের পুনরেকত্রীকরণের জন্যও ব্র্যাকের একাধিক উদ্যোগ রয়েছে। করোনার সময় ফেরত আসা এক হাজার ২৩৩ জন প্রবাসী এবং ৬৮টি পরিবারকে কাউন্সিলিং সেবা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ৭ হাজার ক্ষতিগ্রস্ত অভিবাসী ও তার পরিবারকে নগদ অর্থ সহায়তা, কমপক্ষে ৫ হাজার অভিবাসীকে অর্থনৈতিকভাবে পুণরেকত্রীকরণের জন্য দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহযোগিতা প্রদানের কার্যক্রমসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে ব্র্যাক অভিবাসন কর্মসূচি।

 

আমরা সবাই জানি, সামনের দিনগুলোতে অনেক মানুষ চাকরি হারিয়ে ফিরে আসতে পারেন। সরকার তাদের সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এটি অবশ্যই ইতিবাচক বিষয়। তবে এই প্রবাসীদের পাশে দাঁড়ানোর কাজটি শুধু সরকারের একার নয়। সরকারি-বেসরকারি সংস্থা সবাই মিলে কাজটি করতে হবে।

 

কারণ এই প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতি সবসময় সচল রেখেছেন। এমনকি করোনার সময়ও তারা বিদেশ থেকে টাকা পাঠাচ্ছেন। ঈদকে সামনে রেখে শুধু মে মাসের ১৯ দিনে ১০৯ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় সাড়ে নয় হাজার কোটি টাকা। আর জানুয়ারি থেকে ধরলে মোট তারা পাঠিয়েছেন ৫৫ হাজার কোটি টাকা। কজেই এই সংকটময় সময়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। বিশেষ করে যারা বিদেশে আছেন এবং যারা ফিরে আসছেন।

 

আমরা আজকে এই জরিপের ফল প্রকাশ করলেও পুরো রিপোর্টটা দুদিন আগেই সরকারেক মানে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে দিয়েছি। আমি বলবো সমস্যা সমাধানে তারা অনেক আন্তরিক। হ্যা আমাদের সামর্থ্যের হয়তো ঘাটতি আছে। সে কারণেই আমরা বলেছি এই মন্ত্রণালয়ের বাজেট বাড়াতে হবে।

 

পাশাপাশি ফিরে আসা প্রবাসী ও তাদের পরিবারের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ না করে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনতে হবে। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী ঝুঁকি নিরূপণ করে মনোসামাজিক সহায়তাসহ টেকসই পুনরেকত্রীকরণ কর্মসূচি গ্রহন করতে হবে। দক্ষতা ও আয়বর্ধনমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করতে সহজ শর্তে বিভিন্ন ধরনের ঋণ সুবিধা দিতে হবে। গন্তব্য দেশের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে জোরপূর্বক দেশে ফেরত পাঠানো বন্ধ করতে হবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তারা যেন কাজে ফিরতে পারেন সেই উদ্যোগ নিতে হবে।

 

প্রবাসীদের অবস্থা যাচাইয়ের এই কাজটিতে যুক্ত সব সহকর্মীকে ধন্যবাদ। ধন্যবাদ প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। সবসময় প্রবাসীদের পাশে থাকায় গণমাধ্যম কর্মীদের ধন্যবাদ। আমি মনে করি এই সংকমটয় সময়ে এক কোটি প্রবাসী এবং তাদের স্বজনদের পাশে আমাদের থাকতেই হবে। আমি বিশ্বাস করি আমরা সবাই একসাথে থাকলে ফের সুদিন আসবেই।