ঢাকা, ২৫ নভেম্বর সোমবার, ২০২৪ || ১১ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
৫১৭

বাংলাদেশের বাণিজ্যে প্রভাব ফেলছে করোনাভাইরাস

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২১:৫৭ ১০ মার্চ ২০২০  

করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্ববাণিজ্যে তো বটেই, প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশেও। চীন থেকে এখনো কাঁচামাল আমদানি সেভাবে শুরু না হয়নি। ফলে  তৈরি পোশাকসহ রফতানিমুখী বিভিন্ন খাতের পণ্য উৎপাদন নিয়ে দু:শ্চিন্তায় পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।
এর সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে পণ্য রফতানি হয়, এমন দেশগুলোতেও করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে রফতানিতেও এর প্রভাব পড়তে পারে বলে আশংকা তৈরি হয়েছে। কিন্তু করোনার কারণে ঠিক কতটা সংকটে পড়তে পারে এদেশের বাণিজ্য?
ঢাকায় উত্তরার কাছে নলভোগ এলাকা। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে রফতানির আগে প্যাকিংয়ের জন্য কাঁকড়া এবং কুঁচে মাছ আনা হয় এখানে। বিমানএয়ারপোর্টের কাছেই এ এলাকায় প্রায় ৬০টির মতো কাঁকড়া ও কুঁচে প্যাকিং সেন্টার গড়ে উঠেছে।
পুরো এলাকা ঘুরে অবশ্য মাত্র ১০/১২টি সেন্টার চালু দেখা গেলো। বাকি সব বন্ধ। যেগুলো চালু আছে, সেগুলোতেও কাঁকড়া নেই বললেই চলে। কাঁকড়া ও কুঁচে রফতানিকারকদের অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান গাজী আবুল কাশেম জানাচ্ছেন, ২০ জানুয়ারি থেকেই এ অবস্থা।
কারণ কাঁকড়া ও কুঁচের ৯০ শতাংশই রফতানি হয় চীনে। দেশটির ক্রেতারা কেনা বন্ধ করাতে এখন তাদের রফতানি বন্ধ। তিনি বলেন, বছরে আমাদের রফতানির বেশিরভাগটাই হয় জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে। চীনা নববর্ষের কারণে এর চাহিদা বেশি থাকে। আমাদের ব্যবসায়ীরা প্রায় ৪শ’ কোটি টাকার কাঁকড়া ও কুঁচে রেডি করে রাখছিল। সব নষ্ট হয়ে গেছে।
আবুল কাশেম বলছেন, ব্যবসায়ীদের অনেকেই মূলধন হারিয়ে ফেলেছেন। এখান থেকে সরকারি অর্থ সাহায্য ছাড়া ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না।
কাঁচামাল আমদানি কমেছে
বাংলাদেশের মোট রফতানি আয়ের বিবেচনায় কাঁকড়া ও কুঁচে খাত হয়তো বড় কিছু নয়। কিন্তু এটা স্পষ্ট, করোনা ভাইরাসের কারণে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করেছেন। এটা আরো বাড়বে বলেই আশংকা করা হচ্ছে। কারণ, চীন থেকেই বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ রফতানি পণ্যগুলোর কাঁচামাল আমদানি করা হয়।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান তপন কান্তি ঘোষ জানিয়েছেন, এরই মধ্যে করোনার কারণে চীন থেকে কাঁচামাল আমদানি কমেছে। গেল অর্থবছরের ডিসেম্বর-জানুয়ারি ও ১৫ ফেব্রুয়ারির পর্যন্ত মোট ৭৫ দিনের সঙ্গে চলতি অর্থবছরের একই সময়ের ৭৫ দিনের আমদানি তথ্য মিলিয়ে কমিশন বলছে, চীন থেকে কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়ার পরিমাণ ১৫ শতাংশ। কিন্তু ফেব্রুয়ারির বাকি দিনগুলোতে এবং মার্চের শুরুতে আমদানি আরো কমেছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।Image captionট্যারিফ কমিশন জানিয়েছে, চীন থেকে কাঁচামাল আমদানি ১৫ শতাংশ কমেছে।
যেসব খাত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে
মার্চের প্রথম সপ্তাহে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাড প্রতিবেদন দিয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, চীন থেকে যদি সারা বিশ্বে কাঁচামাল রফতানি ২ শতাংশও কমে যায়, তাহলে বিশ্ব অর্থনীতিতে ক্ষতি হবে ৫০ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশে ক্ষতি হবে ১ কোটি ৭০ লাখ ডলার। এর মধ্যে তৈরি পোশাক এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে সতর্ক করেছে সংস্থাটি।
এর আগে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনও প্রতিবেদনের মাধ্যমে রফতানির ১৩টি খাতকে চিহ্নিত করেছে। যেগুলো করোনা ভাইরাসের কারণে ক্ষতির মধ্যে পড়তে পারে। বলা হয়েছে, এসব খাতে ক্ষতির পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। খাতগুলোর মধ্যে আছে প্রধান রফতানি খাত তৈরি পোশাক এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। এছাড়া ওষুধ শিল্প, পাট, সুতা, ইলেক্ট্রনিক্স, সামুদ্রিক মাছ, প্রসাধনী ইত্যাদি।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা এসব খাতের পণ্য উৎপাদনের জন্য কমবেশি নির্ভর করেন চীন থেকে আনা কাঁচামাল কিংবা যন্ত্রাংশের উপর। এর মধ্যে সব আগে আছে বাংলাদেশের রফতানির মূল খাত তৈরি পোশাক। কারণ, ইতোমধ্যে এ খাতের অনেক কারখানা কাঁচামালের সংকটে পড়েছে কিংবা পড়তে যাচ্ছে।
তৈরি পোশাক খাতে কী প্রভাব পড়ছে?
বাংলাদেশের রফতানি আয়ের ৮৫ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। ফলে এ খাত যদি সংকটে পড়ে; তাহলে দেশের পুরো রফতানি খাতই সংকটে পড়বে বলে মনে করা হয়। বিজিএমইএ'র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ফয়সাল সামাদ বলছেন, তার নিজের পোশাক কারখানাতেই চীন থেকে কাঁচামালের কয়েকটি চালান আটকে গেছে। যেগুলো ফেব্রুয়ারির শুরুতেই আসার কথা।
তিনি বলেন, বেশ কিছু কারখানাতেই কাঁচামালের সংকট তৈরি হচ্ছে। কারখানাগুলো আমদানির জন্য যেসব এলসি খুলে রেখেছিল, চাইনিজ নিউ ইয়ার শেষে সেগুলোর শিপমেন্ট ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে শুরু হওয়ার কথা। এখন সেটা তো পুশব্যাক হয়ে গেছে। আমরা অলরেডি ৩০ দিন পিছিয়ে পড়েছি। এখন নতুন করে যদি আসেও, সেগুলো আসবে, আনলোড হবে, প্রসেস হবে, ফ্যাক্টরিতে আসবে- এভাবে তো আমরা অলরেডি লিড টাইম হারিয়ে ফেলেছি।
ফয়সাল সামাদ বলেন, ক্রেতাদের বিলম্বিত শিপমেন্টের সম্ভাব্য সময় জানানো হচ্ছে। কেউ রাজি হচ্ছে নিতে, কেউ রাজি হচ্ছে না। সুতরাং আমরা ইতোমধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। কেউ কেউ চীন থেকে কাঁচামাল উড়োজাহাজে আনছেন। ক্রেতাদের কাছেও হয়তো যথাসময়ে পণ্য পৌঁছাতে উড়োজাহাজেই পাঠাবেন। এতে করে ব্যয় বাড়বে।
তিনি বলেন, চীনের উৎপাদকেরা জানিয়েছেন ১৫ মার্চের পরে পুরোদমে কাঁচামাল রফতানি শুরু হবে। যদি সত্যিই সেটা বাস্তব হয়, তাহলে ব্যবসায়িক ক্ষতি হয়তো ভয়াবহ হবে না।
রফতানি নিয়ে আশংকা কেন?
কাঁচামালের অভাবে যখন পণ্য উৎপাদন নিয়ে সংশয়, তখন পণ্য উৎপাদনের পর সেটা রফতানি নিয়েও সতর্ক থাকতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। কারণ চীনের পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী করোনার বিস্তারে পর্যটন এবং কেনাকাটার পরিমাণ কমে আসছে।
বিজিএমইএ'র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট বলেন, ইতালিতে তৈরি পোশাকের অর্ডার কমবে বা বাতিল হবে এর কিছু সিগন্যাল তারা ইতোমধ্যে পেয়েছেন।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, করোনা ভাইরাসের কারণে মানুষের লেনদেন কমবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটা বাংলাদেশের পণ্যে কতটা প্রভাব ফেলবে তা বুঝতে আরো অপেক্ষা করতে হবে।
তার মতে, করোনা ভাইরাস কতটা ভয়াবহ রূপ নেয়, সেটার উপর নির্ভর করছে বাংলাদেশের বাণিজ্যে প্রভাবের মাত্রা কতটা হবে। তিনি বলছেন, সরকারকে এখনই কাঁচামালের বিকল্প খুঁজে আমদানির উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ অন্যান্য দেশও বিকল্প উৎসগুলোতে যেতে শুরু করছে। একইসঙ্গে সরকারকে রফতানি বাজারও যাচাই করতে হবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতি আমদানিকারক দেশগুলোয় কী ধরণের চাহিদা হচ্ছে, আমাদের কাছে রফতানির জন্য কী আছে, সেটা দেখতে হবে।