ঢাকা, ২৪ নভেম্বর রোববার, ২০২৪ || ১০ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
৯৪৩

অনিয়ন্ত্রিত-অনিরাপদ কীটনাশক

বাড়ছে কৃষকদের মধ্যে ক্যান্সার প্রকোপ 

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৪:০৪ ১৫ জানুয়ারি ২০২১  

দেশে কৃষকদের মধ্যে ক্যান্সারের প্রকোপ বাড়ছে। তাদের মধ্যেও কীটনাশক ও কৃষি রাসায়নিকের নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবহারের প্রবণতা অনেক বেশি। প্রকোপ বেশি হওয়ার পেছনে অনিয়ন্ত্রিত মাত্রায় কীটনাশক, রাসায়নিক সারের ব্যবহার এবং দূষণের মাত্রা বৃদ্ধিকে দায়ী করছেন জনস্বাস্থ্য খাত সংশ্লিষ্টরা।

 

এছাড়া অনিয়ন্ত্রিত ও অনিরাপদভাবে কীটনাশক প্রয়োগের কারণে ক্যান্সার ছাড়াও স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন কৃষকরা। দীর্ঘমেয়াদে তা হয়ে উঠছে কিডনি, হৃদযন্ত্র ও ফুসফুসের ক্ষতির কারণ। 

 

দেশের একমাত্র বিশেষায়িত সরকারি ক্যান্সার চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল (এনআইসিআরএইচ)। এর ক্যান্সার এপিডেমিওলজি বিভাগের সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ক্যান্সার রেজিস্ট্রি রিপোর্ট: ২০১৫-১৭’ প্রতিবেদনের পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবছর হাসপাতালটিতে যত রোগী ক্যান্সার আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হচ্ছেন, তাদের মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশই কৃষক। এছাড়া শনাক্তকৃতদের মধ্যে কৃষকের হারও এখন উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে।

 

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে হাসপাতালটিতে ক্যান্সার আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয় ১০ হাজার ৩১০ জন। তাদের মধ্যে ৩০ দশমিক ২ শতাংশই কৃষক। ২০১৬ সালে শনাক্তকৃত ১১ হাজার ১৫ জনের মধ্যে কৃষক ছিলেন ৩৩ দশমিক ১ শতাংশ। ২০১৭ সালে ১৪ হাজার ৪৪ জন ক্যান্সার আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়, তাদের মধ্যে ৩৪ দশমিক ৩ শতাংশ ছিলেন কৃষক।

 

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (আইপিএম) ও গুড এগ্রিকালচার প্র্যাকটিস (জিএপি) নীতিমালার পরামর্শ হলো, রাসায়নিক সার বা কীটনাশক ব্যবহারের সময় মুখে মাস্ক ব্যবহার এবং শরীরের অন্যান্য অংশে কীটনাশকের অনুপ্রবেশ রোধের প্রতিরোধক ব্যবস্থা থাকতে হবে। এছাড়া বাতাসের উল্টো দিকে তা প্রয়োগ করা যাবে না।

 

কিন্তু সিংহভাগ কৃষকই এসব পরামর্শ মানছেন না। কোনো ধরনের সুরক্ষা উপকরণ বা ব্যবস্থা ছাড়াই কীটনাশক প্রয়োগ করছেন ৮৫ শতাংশের বেশি কৃষক। ফলে এসব রাসায়নিক ও কীটনাশকের মারাত্মক এবং ক্ষতিকারক সূক্ষ্ম উপাদানগুলো দেহে প্রবেশ করে মারণব্যাধির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। একই সঙ্গে তা মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কমিয়ে দিচ্ছে।

 

তাছাড়া অনিয়ন্ত্রিত ও অনিরাপদভাবে কীটনাশক প্রয়োগের কারণে ক্যান্সার ছাড়াও স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন কৃষকরা। দীর্ঘমেয়াদে তা হয়ে উঠছে কিডনি, হূদযন্ত্র ও ফুসফুসের ক্ষতির কারণ। ফলে ফসলের রোগবালাই দমনের পাশাপাশি উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য কীটনাশক ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে অবহেলা করছেন কৃষকরা। এভাবে কীটনাশক ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষকের যেমন বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে, তেমনি পরিবেশের ওপরও পড়ছে বিরূপ প্রভাব।

 

রাজধানীর হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ডা. লেলিন চৌধুরী মনে করছেন, যথাযথভাবে নিরাপত্তা উপকরণ ব্যবহার না করা এবং অতিমাত্রায় কীটনাশক ও রাসায়নিক ব্যবহারের কারণেই কৃষকদের মধ্যে ক্যান্সার আক্রান্তের হার বাড়ছে। 

 

কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ফসলের রোগবালাই ও কীটপতঙ্গ দমনের জন্য কীটনাশক, ছত্রাকনাশক, আগাছানাশক, পতঙ্গনাশক ও রোডেন্টিসাইড (ইঁদুর মারা বিষ) ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রতি বছর এসব কীটনাশক ও বালাইনাশক ব্যবহার হচ্ছে গড়ে ৩৫-৩৭ হাজার টন। এছাড়া বার্ষিক রাসায়নিক সারের ব্যবহার হচ্ছে ৫০ লাখ টনেরও বেশি। কৃষকের মৃত্যুঝুঁকি বাড়ানোর পাশাপাশি এসব উপকরণের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে সার্বিক জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ-প্রতিবেশেও দেখা যাচ্ছে বিরূপ প্রভাব।

 

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. বাহানুর রহমান বলেন, কৃষকদের মধ্যে ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব বাড়ার অনেক কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে একটি প্রধান কারণ হতে পারে কৃষিচর্চার ধরন। অর্থাৎ যখন একজন কৃষক কীটনাশক বা রাসায়নিক স্প্রে করছেন, তখন তিনি নিজের সুরক্ষা নিশ্চিত করছেন না। কৃষকরা কাজের অধিকাংশ সময় ডাস্টের সঙ্গেই থাকেন।

 

ফসল ও জমির ডাস্ট তাদের ফুসফুসের জন্য অনেক ক্ষতিকর এবং ফুসফুসের ক্যান্সারেরও কারণ। মোটা দাগে নিজেদের সুরক্ষিত রাখার তেমন কোনো ব্যবস্থা কৃষকরা ব্যবহার করেন না। পর্যাপ্ত ও সময়মতো সুরক্ষা ব্যবস্থা না নেয়ার কারণে তাদের মধ্যে ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক বেশি। আমাদের দেশে কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা ও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ঘাটতি আছে। এগুলো নিশ্চিত করতে পারলে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। 

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান বলেছেন, ক্যান্সারের প্রকোপ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সত্যিই উদ্বেগজনক। ভেজাল খাবার, শস্য উৎপাদনে কীটনাশকের ব্যবহার, পরিবেশ দূষণ, ধূমপানসহ নানা কারণে ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।