ঢাকা, ৩১ অক্টোবর বৃহস্পতিবার, ২০২৪ || ১৬ কার্তিক ১৪৩১
good-food
১১৯

বিদেশে পালিয়ে গেলেন ৪০০ কোটির পিয়ন পানি জাহাঙ্গীর!

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ০৩:১০ ১৬ জুলাই ২০২৪  

‘আমার বাসায় কাজ করা পিয়ন, সে এখন ৪০০ কোটি টাকার মালিক।’ রবিবার (১৪ জুলাই) বিকেলে গণভবনে সাম্প্রতিক চীন সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে-এমন উদাহরণ দিতে গিয়ে নিজ বাসার সাবেক কর্মীর দুর্নীতি সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন তিনি। এতে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে তোলপাড়।

 

ওই সময় শেখ হাসিনা বলেন, আমার বাসায় কাজ করে গেছে যে পিয়ন, সে এখন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। হেলিকপ্টার ছাড়া চলে না। হ্যাঁ, এটা বাস্তব কথা। তো কী করে বানালো এই টাকা! যখনই জেনেছি তাকে বাদ দিয়ে কার্ড-টার্ড সব সিজ করে আমার ব্যবস্থা আমি নিয়েছি। ধরা পড়লে তো চোখে আসে। তা ছাড়া তো হয় না। যখন ধরা পড়ে তখন ব্যবস্থা নিই। 

 

শেখ হাসিনার বক্তব্যের সময় ওই পিয়ন কে, তা স্পষ্ট না হলেও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং একাধিক সূত্রে জানা গেছে, এই ব্যক্তির নাম মো. জাহাঙ্গীর আলম। তার বাড়ি নোয়াখালীর চাটখিলে। উপজেলার নাহারখিল গ্রামের রহমত উল্যা ও অজিফা খাতুন দম্পতির ছেলে তিনি।  

 

৯০’র দশকে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাড়ি সুধাসদনে আসা দলীয় নেতাকর্মীকে পানি খাওয়ানোর কাজ করতেন জাহাঙ্গীর। তাকে নেতাকর্মীরা তখন ‘পানি জাহাঙ্গীর’ নামে চিনতেন। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রীর গণভবনে যাতায়াতের সুযোগ পান তিনি। এরপরই যেন আলাদীনের চেরাগ হাতে পান পিয়ন। হয়ে যান কোটিপতি, গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাটখিলের সেই জাহাঙ্গীর প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মচারী হিসেবে কাজ করতেন। কিন্তু পরিচয় দিতেন ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে। এই পরিচয়ে নানা তদবির, টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অপকর্ম করে বেড়িয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচয় ব্যবহার করে গাজীপুরের ইপিজেড এলাকার ঝুট ব্যবসাও নিয়ন্ত্রণ করতেন জাহাঙ্গীর। নোয়াখালী ও রাজধানী ঢাকায় গড়ে তুলেছেন বিপুল সম্পদ। কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। সঙ্গে নিয়ে ঘুরতেন লাইসেন্সকৃত পিস্তল ও গানম্যান। 

 

সূত্র জানায়, কোটি কোটি টাকার সম্পদ কামানোর পর রীতিমতো রাজনৈতিক মাঠে নেমে যান পিয়ন জাহাঙ্গীর। নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির পদও বাগিয়ে নেন। একই সঙ্গে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক পাওয়ার জন্য নমিনেশন তুলেছিলেন। পরে তা না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে পরবর্তীতে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। তার বিরুদ্ধে নোয়াখালী-১ আসনের নৌকার প্রার্থী এইচ এম ইব্রাহীমের বিরোধিতা করে তাকে হারানোর পাঁয়তারার অভিযোগ রয়েছে। 

 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয় দিয়ে জাহাঙ্গীর বিভিন্ন অনৈতিক কাজ করছেন- এমন অভিযোগে গত বছরের ৬ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। তাতে বলা হয়, জাহাঙ্গীরের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রয়োজনে নিকটস্থ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তা নিতে বলা হয়।

 

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকায় একাধিক প্লট-ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছেন জাহাঙ্গীর। ধানমন্ডিতে স্ত্রীর নামে আড়াই হাজার বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন। ধানমন্ডিতে আলিশান ফ্ল্যাট ছাড়া মোহাম্মদপুর ও নিউমার্কেটে দুটি দোকান রয়েছে। মিরপুরে একটি সাততলা ভবন এবং দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে তার। 

 

নোয়াখালীর চাটখিল এবং জেলা সদরের হরিনারায়ণপুর ও খলিলপুরে গিয়ে জানা গেছে, জাহাঙ্গীরের বাবা রহমত উল্যাহ ইউনিয়ন পরিষদে কেরানী হিসেবে চাকরি করতেন। সংসারে ছিল টানাপোড়ন। দল ক্ষমতায় আসার পর জাহাঙ্গীরের উত্থান অনেকের কাছে আলাদীনের চেরাগের মতো। চাটখিলে পৈতৃক ভিটায় করেছেন চারতলা বাড়ি। বাড়ির পাশে রয়েছে ৭০০ শতক জমি। উপজেলার খিলপাড়া পূর্ব বাজারে রয়েছে প্রায় কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ। জেলা শহরের মাইজদীর হরিনারায়ণপুর  রয়েছে আটতলা বিলাসবহুল বাড়ি। 

 

হরিনারায়ণপুরের বাড়ির কেয়ারটেকার জানান, বাড়িটি জাহাঙ্গীর সাহেবের স্ত্রীর নামে। তিনি মাঝে-মধ্যে আসেন। তবে গত কয়েক মাস একেবারেই আসেন না। শুনেছি স্ব-পরিবারে দেশের বাইরে চলে গেছেন। বর্তমানে তার বাড়ি এবং সম্পত্তিগুলো দেখাশোনা করেন মুকুল ও আবদুল মতিন নামের দুই ব্যক্তি। তারা বাড়ি, দোকান ও খামারের আয়ের টাকা উত্তোলন করেন।

 

নোয়াখালী সদর উপজেলার নোয়াখালী ইউনিয়নের খলিলপুর গ্রামে ১০ একর জায়গাজুড়ে খামার গড়ে তুলেছেন জাহাঙ্গীর। ওই জমি তিনি কিনেছেন সদর উপজেলার অশ্বদিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন বাবলুর কাছ থেকে। তাও নামমাত্র মূল্যে।

 

অশ্বদিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন বাবলু বলেন, আমাকে নামমাত্র মূল্য দিয়ে জমিটি নিয়েছেন জাহাঙ্গীর। বলেছেন, একটি মন্ত্রণালয় থেকে আমার ইউনিয়নের জন্য ৩০ কোটি টাকার প্রকল্প পাস করিয়ে দেবেন। তাই জনগণের স্বার্থে আমি রাজি হয়ে জমিটি দিয়েছি। কিন্তু পরবর্তীতে আর যোগাযোগ করেনি। তার অনেক টাকা। দল বিক্রি করে, দলের কর্মীদের ঠকিয়ে টাকার পাহাড় গড়েছেন তিনি। সঠিক বিচার হওয়া দরকার।


স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, জাহাঙ্গীর সাহেব খামারে আসেন গাড়িতে চড়ে। সঙ্গে পুলিশ থাকেন। একালার মানুষকে খামারে ঢুকতে দেন না। ভেতরে কি হচ্ছে, কিসের খামার তাও জানি না।জেলা সদরের সোনাপুর পৌর সুপার মার্কেটে জাহাঙ্গীরের রয়েছে দুটি দোকান। দোকান নং-০৭ ও ০৮। সেগুলো দেখাশোনা  করেন তার শ্যালক মিজান। দলীয় নেতাকর্মীদের দাবি, দোকান দুটিও নিয়েছেন ক্ষমতার দাপটে।

 

জাহাঙ্গীরের নিজ এলাকা চাটখিলের বাসিন্দারা জানান, তিনি সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য নোয়াখালীতে বিপুল অর্থ খরচ করেছেন। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে বিশাল বহর নিয়ে সভা-সমাবেশ করতেন। এজন্য লাখ লাখ টাকা খরচ করেছেন। বিভিন্ন সময় সরকারের অনেক প্রভাবশালী মন্ত্রী ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে নিজের এলাকায় দাওয়াত করে নিয়ে আসতেন তিনি। 

 

সোনাইমুড়ি উপজেলার গান্ধি আশ্রম ট্রাস্টের অনুষ্ঠানে নিজে এবং অতিথিদের যাতায়াতের জন্য হেলিকপ্টার ব্যবহার করেছেন জাহাঙ্গীর। তারা জানান, অঢেল সম্পত্তির মালিক জাহাঙ্গীরের আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে কেয়ারটেকার ও পিয়নও কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন।

 

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জমা দেয়া হলফনামায় জাহাঙ্গীর কৃষিখাত থেকে প্রতি বছর ৪ লাখ টাকা, বাড়ি ও দোকান ভাড়া থেকে সাড়ে ১১ লাখ টাকা, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক আমানত থেকে ৯ লাখ টাকা, চাকরি থেকে ৬ লাখ এবং অন্যান্য উৎস থেকে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টাকা আয়ের তথ্য জানান। হলফনামার হিসাব অনুযায়ী, বছরে প্রায় ৫০ লাখ টাকার আয়ের কথা জানিয়েছেন তিনি।

 

হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, জাহাঙ্গীরের নিজের নামে আড়াই কোটি টাকা এবং স্ত্রীর নামে ব্যাংকে প্রায় সোয়া ১ কোটি টাকা ছিল। ডিপিএস ছিল পৌনে ৩ লাখ টাকা। এফিডিআর ছিল সোয়া ১ কোটি টাকা। স্ত্রীর নামে কিনেছেন গাড়ি। বিভিন্ন কোম্পানিতে কোটি টাকার শেয়ারও রয়েছে। এছাড়া একটি অংশীদারি প্রতিষ্ঠানে তার ৬ কোটি টাকার বিনিয়োগও রয়েছে।

 

বিপুল সম্পদের বিষয়ে জানতে একাধিকবার জাহাঙ্গীরের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, জাহাঙ্গীর বুঝতে পেরেছেন যেকোনও সময় তাকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। এজন্য তিনি আগেই স্ব-পরিবারে দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন।

 

এক সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে গেছেন জাহাঙ্গীর।  খিলপাড়া ইউনিয়নের নাহারখিল গ্রামে চারতলা বাড়িতে থাকতেন তিনি। এখন সেখানে কেউ নেই।

 

আরেক সূত্র জানায়, জাহাঙ্গীর দুই বিয়ে করেছেন। প্রথম স্ত্রীর ঘরে এক সন্তান। আর দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে তিন সন্তান রয়েছে। প্রথম স্ত্রী দেশে আছেন। তবে তার সঙ্গে জাহাঙ্গীরের যোগাযোগ নেই। দ্বিতীয় স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। তার কাছেই চলে গেছেন জাহাঙ্গীর।

অপরাধ বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর