ঢাকা, ২৩ নভেম্বর শনিবার, ২০২৪ || ৯ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
৯০৩

ভাওয়াইয়া: কর্মজীবী মানুষের প্রধান কর্মসঙ্গীত

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ০৯:৪৬ ১৯ জানুয়ারি ২০২১  

ওকি গাড়িয়াল ভাই,
কত রব আমি পন্থের দিকে চাঞা রে।
যেদিন গাড়িয়াল উজান যায়।

 

গরুর গাড়ি চালক বা গাড়িয়ালকে উদ্দেশ্য করে বলা ভাওয়াইয়া গান। ভাওয়াইয়া মূলত বাংলাদেশের রংপুর এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে ও আসামের গোয়ালপাড়ায় প্রচলিত এক প্রকার পল্লীগীতি। এসব গানের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এ গানগুলোতে স্থানীয় সংস্কৃতি, জনপদের জীবনযাত্রা, তাদের কর্মক্ষেত্র, পারিবারিক ঘটনাবলী ইত্যাদির সার্থক প্রয়োগ ঘটেছে।

 

ভাওয়াইয়া কথার উৎপত্তি
ভাওয়াইয়া কথাটির উৎপত্তি সম্পর্কে অনেক মতবাদ রয়েছে। ভাব (মনের অনুভূতি)>ভাও+ইয়া। অর্থাৎ, যে সমস্ত গানের মধ্য দিয়ে মনের অনুভূতি প্রকাশ করা হয়।

 

উৎপত্তি
ভাওয়াইয়া গানের আকরভূমি রংপুর। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের নদী-নালা কম থাকায় গরুর গাড়িতে চলাচলের প্রচলন ছিল। আর গরুর গাড়ির গাড়োয়ান রাত্রে গাড়ি চলাবস্থায় বিরহ ভাবাবেগে কাতর হয়ে আপন মনে গান ধরে। উঁচু-নিচু রাস্তায় গাড়ির চাকা পড়লে তার গানের সুরে আধো-ভাঙ্গা বা ভাঁজ পড়ে। এই রকম সুরে ভাঙ্গা বা ভাঁজ পড়া গীতরীতিই 'ভাওয়াইয়া' গানে লক্ষণীয়। প্রেম-বিয়োগে উদ্বেলিত গলার স্বর জড়িয়ে যেরকম হয়, সেরকম একটা সুরের ভাঁজ উঁচু স্বর হতে ক্রমশঃ নিচের দিকে নেমে আসে। সুরে ভাঁজ পড়া ভাওয়াইয়া গানের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য।

 

বিশিষ্ট শিল্পীগণ
আব্বাসউদ্দিনকে 'ভাওয়াইয়া গানের সম্রাট' বলা হয়। তিনি (১৯০১-১৯৫৯) বাংলার লোকগানের এক ধ্রুপদী সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব। সঙ্গীতাঙ্গনে তথা আধুনিক কাব্যগীতি, দেশাত্মবোক গান, ইসলামী গান, ভাওয়াইয়া সঙ্গীত এবং পল্লীগীতিতে এই শিল্পীর অবদান তুলনারহিত। বিশেষ করে লোকগানের অন্যতম ধারা ভাওয়াইয়া সঙ্গীতকে নাগরিক মনে জনপ্রিয় করে তােলার পেছনে তার কৃতিত্ব অসামান্য।

 

তারেষা, ধরলা, দুধকুমার, তিস্তা, কালজানি বিধৌত উত্তরবঙ্গের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ভাওয়াইয়া সঙ্গীতের অন্যতম অনুষঙ্গ করে মৈষাল-মাহুত-গাড়িয়ালের মাধ্যমে বিরহী নারীর আকুতি, মন-মনন, চিন্তা-চেতনাকে অত্যন্ত চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন। শিল্পী এ কাজ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করতে সক্ষম হয়েছেন। কারণ, তার এই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা।

 

আব্বাসউদ্দীনের জন্ম কোচবিহার জেলার তুফানগঞ্জের বলরামপুর গ্রামের এক নৈসর্গিক পল্লীতে। একদিকে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ, অন্যদিকে কালজানি নদী। এমন প্রাকৃতিক পরিবেশে কৃষক-শিল্পীর উদাস করা কণ্ঠে ভাওয়াইয়ার সুর দিনরাত অনুরণিত হতো। তার চিন্তা-চেতনায়, মন-মননে ভাওয়াইয়া গান আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষদের কণ্ঠে গীত ভাওয়াইয়া গানের সুর তার সমস্ত সত্তাকে যেনো আলোড়িত করতো।

 

এ প্রসঙ্গে তিনি নিজেই বলেন, সেই সব গানের সুরেই আমার মনের নীড়ে বাসা বেঁধেছিল ভাওয়াইয়া গানের পাখি। এখান থেকেই মূলত আব্বাসউদ্দীনের ভাওয়াইয়া গানের হাতেখড়ি। তিনি কোন সঙ্গীত গুরুর কাছে নয়, রং গানের শিক্ষা নিয়েছেন প্রকৃতির সহজ-সরল সুর-পাঠ থেকে। লোকসংস্কৃতির অঙ্গনে ভাওয়াইয়া সঙ্গীত যতদিন টিকে থাকবে ততদিন ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাসউদ্দীনকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।

 

চলচ্চিত্র

বাংলাদেশী চলচ্চিত্র পরিচালক শাহনেওয়াজ কাকলীর চলচ্চিত্র 'উত্তরের সুর' (Northern Symphony) ছবিতে একজন ভাওয়াইয়া গায়কের জীবনচিত্র তুলে ধরা হয়। এখানে উত্তর বাংলাদেশের দারিদ্র্যের কারণে ধীরে ধীরে ভাওয়াইয়া গানের অবলুপ্তি তুলে ধরা হয়। চলচ্চিত্রটি ১৮তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয়।

ফিচার বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর