ঢাকা, ২৯ নভেম্বর শুক্রবার, ২০২৪ || ১৫ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
৪৩৫

যেসব কারণে ট্রাম্পের পতন

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২২:১৯ ১০ নভেম্বর ২০২০  

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ব্যাপক ভরাডুবি ঘটেছে ডোনাল্ড ট্রাম্প তথা রিপাবলিকানদের। জো বাইডেন অর্থাৎ ডেমোক্র্যাটদের ২৮৪ ইলেকটোরাল ভোটের বিপরীতে ২১৪টি পেয়েছে তারা। নেপথ্যে কতিপয় কারণ উল্লেখ করেছেন বিবিসির নিউইয়র্ক সংবাদদাতা নিক ব্রায়ান্ট।

 

২০১৬ সালের মার্কিন নির্বাচন ছিল ঐতিহাসিক দুর্ঘটনা এবং আমেরিকার স্বাভাবিকতা থেকে বিচ্যুতি। এমন ধারণা অনেকের মনে ছিল। ২০২০ সালের নির্বাচনে চিরদিনের মতো সেটার কবর রচনা করেছে তারা!

 

এবার প্রায় ৭ কোটি ভোট পেয়েছেন ট্রাম্প, যা আমেরিকার ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট। পুরো দেশে মোট ভোটের ৪৭ শতাংশের বেশি পেয়েছেন তিনি। মনে করা হচ্ছে, প্রিয় ফ্লোরিডা ও টেক্সাসসহ ২৪টি রাজ্যে জয় পেয়েছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট।

 

মার্কিন মুলুকে ট্রাম্পের ভিন্ন ভাবমূর্তি আছে। সেখানে অনেকেই তাকে ভক্তি করেন। হোয়াইট হাউসে গেল চার বছরে তার প্রেসিডেন্সির নানা বিষয় খুঁটিয়ে দেখেছেন সমর্থকরা। অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের সব শর্ত মেনে নিয়েছেন তারা।

 

ট্রাম্পের রাজনৈতিক দুর্বলতা রয়েছে। এ নিয়ে অনেকে অনেক বিশ্লেষণ হাজির করেছেন। অবশ্য তার রাজনৈতিক শক্তির বিষয়টিও আলোচ্য। যাহোক, তিনি হেরেছেন এবং আধুনিক যুগের সেই চারজনের একজন, যারা দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন মসনদে বসতে পারলেন না।

 

শুধু তাই নয়, টানা দ্বিতীয়বার পপুলার ভোটে হারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ২০১৬ সালে ইলেকটোরাল ভোটে জেতেন তিনি এবং ক্ষমতায় আসেন। এর অন্যতম কারণ ছিল, প্রথা ভেঙে রাজনীতির বাইরে থেকে আসা মানুষ ছিলেন ট্রাম্প। এছাড়া তিনি এমন কিছু বলার সাহস রাখেন, যা অন্য কেউ কখনও বলেননি। এ বছর সেটিই কাল হয়েছে তার। এই দুটিই রিপাবলিকানদের ভরাডুবির উল্লেখযোগ্য কারণ। 

 

গেলবার চাউর হয়, নিউইয়র্কের ফিফথ্ অ্যাভিনিউতে কাউকে গুলি করলেও ট্রাম্পকে বেশিরভাগ ভক্ত ভোট দিতেন। কিন্তু ৪ বছর আগে যারা তাকে সমর্থন দিয়েছেন, এবার তাদেরই একটা বড় অংশ পিছপা হয়েছেন। মূলত তার মারমুখি আচরণের কারণে পিছু হটেছেন তারা। 

 

আমেরিকার বেশিরভাগ শহরতলীর ক্ষেত্রে এটা দেখা গেছে। ট্রাম্পের আগের প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিনটনের চেয়ে ৩৭৩টি শহরতলীর কাউন্টিতে ভালো করেছেন বাইডেন। ফলে পেনসিলভানিয়া, মিশিগান ও উইসকনসিনে জিতেছেন তিনি। একই কারণে জয় পেয়েছেন জর্জিয়া ও অ্যারিজোনায়।

 

শহরতলী এলাকায় নারীদের সমর্থন পাননি ট্রাম্প। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচনে যা দেখা যায়, সেটার কিছুটা পুনরাবৃত্তি হয়েছে ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট ভোটে। গেল মেয়াদে তাকে ভোট দিয়েছিলেন উচ্চশিক্ষিত রিপাবলিকানরা। 

 

ট্রাম্পকে আবারও একটা সুযোগ দিতে রাজি ছিলেন তারা।  যদিও তিনি ঠিক প্রেসিডেন্টসুলভ ছিলেন না। উচ্চশিক্ষিত দলীয় সমর্থনকারীরা জানতেন, ট্রাম্প ঠিক অন্যদের মতো হবেন না। কিন্তু যেভাবে তিনি একের পর এক প্রথা ও আচরণগত নিয়ম ভেঙেছেন, তা অনেকের কাছেই ছিল আপত্তিকর। তারা তার কাছ থেকে দূরে সরে গেছেন।

 

চলতি বছরের মাঝামাঝিতে বর্ণবাদী উত্তেজনায় ইন্ধন জোগান ট্রাম্প। কৃষ্ণাঙ্গদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন তিনি। বর্ণবৈষম্যমূলক শব্দ ব্যবহার করে টুইট করেন। অনেক সময়ে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদকে সমর্থন করেন। 

 

পাশাপাশি আমেরিকার চিরাচরিত মিত্রদের দূরে ঠেলে দেন ট্রাম্প। সেই সঙ্গে ভ্লাদিমির পুতিনের মতো কর্তৃত্ববাদীদের প্রশংসা করেন তিনি। যা অনেকে ভালো চোখে দেখেননি। ‘খুব স্থিতিশীল প্রতিভা’ হিসেবে নিজেকে জাহির করেন প্রেসিডেন্ট। একইসঙ্গে মদত দেন ষড়যন্ত্র তত্ত্বে।

 

'ক্রাইম বস'-এর মতো কথা বলতেন ট্রাম্প। তার কথা শোনাতো অপরাধ জগতের নেতার মতো। নিজের সাবেক আইনজীবী মাইকেল কোহেনকে ‘ইঁদুর’ হিসেবে বর্ণনা করেন তিনি। 

 

এরপর রয়েছে ট্রাম্পের সেই আচরণ। যাকে তার গা-ছমছমে কর্তৃত্ববাদ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন সমালোচকেরা। সদ্য নির্বাচনের পরও তা দেখা গেছে। কারণ, তিনি ফলাফল মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান।

 

পিটসবার্গের বাসিন্দা চাক হাওয়েনস্টেইন। ২০১৬ সালে তিনি ছিলেন ট্রাম্প সমর্থক। তবে এবার ভোট দিয়েছেন বাইডেনকে। 

 

চাক বলেন, মানুষ আসলে ক্লান্ত। সবাই দেখতে চান দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরেছে। শালীনতা দেখতে চান তারা। দেখতে চান ঘৃণা বন্ধ হয়েছে। ওরা চান ঐক্যবদ্ধ জাতি দেখতে। আর এসবই বাইডেনকে প্রেসিডেন্ট পদে বসিয়েছে।

 

ট্রাম্পের রাজনৈতিক ব্যর্থতা হলো নিজের সমর্থনকে মূল 'ট্রাম্প বেস' কিংবা নিজের কড়া সমর্থকদের বাইরে নিয়ে যেতে পারেননি। এমনকি বেশ চেষ্টাও করেননি।

 

২০১৬ সালে ৩০টি রাজ্যে জয় পেয়েছিলেন ট্রাম্প। তবে এমনভাবে শাসন করেছেন যেন তিনি কেবল রক্ষণশীল, লাল আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। গেল ১০০ বছরে আমেরিকায় আর কোনও প্রেসিডেন্ট এত বিভেদের কারণ হয়ে দাঁড়াননি। 

 

৪ বছর আগে ২০টি অঙ্গরাজ্য হিলারিকে ভোট দিয়েছিল। সেসব নীল রাজ্যকে কাছে টানার চেষ্টা করেননি ট্রাম্প। ফলে অনেক ভোটার এমন কাউকে চেয়েছেন, যিনি হোয়াইট হাউসকে অনেকটা প্রথা অনুযায়ী চালাবেন। তার শিশুসুলভ গালাগালি, খারাপ ভাষার ব্যবহার এবং অবিরাম দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কারণে বিরক্ত ছিলেন তারা। চেয়েছিলেন একধরনের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরুক।

 

এবার ট্রাম্প ছিলেন ক্ষমতাসীন, বাইরের কেউ নন। নিজের কর্মকাণ্ডের সমর্থনে কথা বলতে হয়েছে তাকে। বিশেষ করে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি, যা তিনি ভালোভাবে সামাল দিতে পারেননি। যে মহামারি নির্বাচনের দিন পর্যন্ত যুক্ত রাষ্ট্রের ২ লাখ ৩০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

 

বাইডেনকে দানব বানানো ছিল কঠিন। ডেমোক্র্যাটিক কর্ণধাররা তাকে প্রার্থী হিসেবে পেতে উদগ্রীব ছিলেন। যে কারণে ৭৭ বছর বয়সী মধ্যপন্থীকে বেছে নেয়া হয়েছিল, সেই কাজও সমাধা করেছেন। রাস্ট বেল্ট নামে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে শ্রমজীবী মানুষের ভোট এনে দিয়েছেন তিনি।

 

ট্রাম্প কেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হেরেছেন? এই প্রশ্নের চেয়েও মজার ও তর্কসাপেক্ষ হতে পারে তিনি ঠিক কখন হেরে গেছেন। এটা কি ২০১৬ সালের নির্বাচনের পরই? সেবার ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে অংশত প্রতিবাদ হিসেবে তাকে ভোট দেন অনেকে। তারা বিভ্রান্ত হওয়ার পর?

 

তাদের অনেকে আশাই করেননি ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতে যাবেন। নাকি এটা তার ক্ষমতায় বসার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই। তিনি ‘আমেরিকার হত্যালীলা’ উদ্বোধনী বক্তব্য দেন। তাতে যুক্তরাষ্ট্রকে বর্ণনা করেন ভিন্ন দেশ হিসেবে। যেখানে কলকারখানা বন্ধ হয়েছে, শ্রমিকেরা চাকরি হারিয়েছেন এবং মধ্যবিত্তের সম্পদ কেড়ে নেয়া হয়েছে।

 

ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সির প্রথম দিনের সূর্য ডোবার আগেই পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল, প্রেসিডেন্ট পদ তাকে যতটা না বদলাবে, সেটার চেয়ে বরং অনেক বেশি তিনি প্রেসিডেন্ট পদকে বদলে দেবেন।

 

নাকি এটা আরও অনেক কিছুর সংমিশ্রণ-একের পর এক কেলেঙ্কারি, দোষারোপ, নিজের স্টাফদের ডিগবাজি ও বিশৃঙ্খলা? অথবা এটা করোনাভাইরাসের ফলাফল, তার প্রেসিডেন্সির পুরো মেয়াদের সবচেয়ে বড় সংকট?

 

করোনা আমেরিকায় আসার আগে ট্রাম্পের রাজনৈতিক সূচকগুলো ছিল বেশ শক্ত। তিনি অভিশংসন বিচার পার করেছেন। তার সমর্থন ছিল ৪৯ শতাংশ। এ যাবতকালের মধ্যে যা ছিল সর্বোচ্চ।

 

একটা শক্তিশালী অর্থনীতি আর ক্ষমতাসীন থাকা। এই দুটো বিষয় একজন প্রেসিডেন্টকে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় যেতে সাধারণত সাহায্য করে। যেকোনও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে একটি প্রশ্নই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়-দেশ কি এখন ৪ বছর আগের তৃলনায় ভালো অবস্থানে আছে?

 

কিন্তু এরই মধ্যে কোভিড এলো, সঙ্গে এলো অর্থনীতির সংকট। ফলে ওই প্রশ্নের একটা ইতিবাচক উত্তর দেয়া বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ালো। তবে এটা বলা ভুল হবে, শুধু করোনার কারণেই ট্রাম্প হেরে গেছেন।

 

প্রেসিডেন্টরা অনেক সময় জাতীয় সংকট মোকাবেলা করে শক্ত অবস্থানে পৌঁছে যান। সংকট অনেক সময় অনেককে মহান বানিয়ে দেয়। এটা সত্যি ছিল সাবেক প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডিলানো রুজভেল্টের ক্ষেত্রে। তিনি গ্রেট ডিপ্রেশন বা মহামন্দা মোকাবেলা করে আমেরিকাকে উদ্ধার করেন এবং নিজেকে অপরাজেয় অবস্থানে নিয়ে যেতে সমর্থ হন।

 

একইভাবে, জর্জ ডব্লিউ বুশ ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পর প্রাথমিক যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তাতে তার জনপ্রিয়তা বাড়ে। যা তাকে দ্বিতীয় মেয়াদে জয়ী হতে সাহায্য করে।

 

সুতরাং বলা বাহুল্য কোভিড আসলে ট্রাম্পকে শেষ করেনি। বরং তিনি যেভাবে এই সংকট মোকাবেলা করেছেন, তা-ই তার পতনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এটাও মনে রাখা দরকার, একেবারে শেষ সময় পর্যন্ত রাজনৈতিকভাবে টিকে ছিলেন তিনি। 

 

যদিও তার সময়ে দেশটি ১০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সংকট, ’৩০-এর দশকের পর সবচেয়ে মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকট এবং ’৬০-এর দশকের পর সবচেয়ে বিস্তৃত জাতিগত অশান্তির মধ্যে ছিল।

 

রিপাবলিকান পার্টিকে সমর্থন করে পরিচিতি পাওয়া 'রেড' আমেরিকা, আর ট্রাম্পের প্রভাবে থাকা রক্ষণশীলদের বড় অংশ চেয়েছিল, তিনি আবার ক্ষমতায় আসুন। আগামী দিনগুলোতে ট্রাম্প রক্ষণশীল আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকবেন। আমেরিকার রক্ষণশীলদের মধ্যে রেগানিজম যেমন প্রভাব বিস্তার করে আছে, তেমনই ট্রাম্পিজমও একইরকম একটা ব্যাপার হয়ে থাকতে পারে।

 

একজন প্রবল মেরুকরণকারী ব্যক্তিত্ব হিসেবে ট্রাম্প থেকে যাবেন। এমনও হতে পারে ২০২৪ সালে তিনি আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়াবেন।

বিশ্ব বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর