ঢাকা, ২২ নভেম্বর শুক্রবার, ২০২৪ || ৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
৩৭৫

যে কারণে প্রতিবছর একই সময় পেঁয়াজের দাম বাড়ে

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৫:২৭ ১২ ডিসেম্বর ২০২৩  

ভারতের রপ্তানি বন্ধের খবরে হঠাৎ দেশে পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেছে। বিগত কয়েক বছরে এই ধরনের ঘটনা একাধিকবার ঘটেছে। গত ৮ ডিসেম্বর মসলাজাতীয় পণ্যটি রপ্তানি বন্ধ করে ভারত। সেই সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেন বিক্রেতারা।

 

সেদিন সকালে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দর ছিল ১০০ থেকে ১২০ টাকা। সন্ধ্যায় তা গিয়ে দাঁড়ায় ২০০ থেকে ২২০ টাকায়। কোথাও কোথাও কেজিতে ২৫০ টাকাও ওঠে। ২০১৯ সাল থেকে প্রায় প্রতিবছর একই সময়ে এরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে।

 

নির্দিষ্ট বছরের সেপ্টেম্বরে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দেয় ভারত। এরপর থেকে দেশের বাজারে দর বাড়তে থাকে। নভেম্বরে তা কেজিপ্রতি ২৫০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। আবার ভারত থেকে আমদানি শুরু হলে মূল্য কমতে থাকে। ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের পরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক আলোচনা সভায় বলেছেন, কালোবাজারি করে একটি চক্র বাজার অস্থিতিশীল করে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে।

 

গত কয়েক দিনও পেঁয়াজ গুদামজাত এবং অবৈধ মজুত করার অভিযোগে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ব্যবসায়ী, আড়তদারদের জরিমানা করা হয়েছে। বাজার বিশ্লেষক ও পেঁয়াজ ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অতীতে দেখা গেছে প্রতিবছর এই সময়ে ভারতের রপ্তানি বন্ধ করার সুযোগ কাজে লাগায় ব্যবসায়ীদের একাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সময়ে নতুন পেঁয়াজ না ওঠা আর পুরোনো পেঁয়াজের সরবরাহ কম থাকায় ব্যবসায়ীদের একটি মহল মজুত করে কৃত্রিমভাবে দাম বাড়িয়ে দেয়।

 

পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সরকারি বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা দর কমানোর পদক্ষেপ নেয়। যেসব এলাকায় কর্তৃপক্ষ অভিযান চালায়, সেখানে সাময়িকভাবে দরও কমে। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতির খুব পরিবর্তন হয় না। প্রতি বছর একই সমস্যার উদ্ভব হলেও বাজার নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে স্থায়ী সমাধান হয় না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

 

ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা 

দেশে প্রতিবছর যে পরিমাণ পেঁয়াজের চাহিদা থাকে, সেটার সিংহভাগই দেশীয় উৎপাদনের মাধ্যমে পূরণ হয়। বছরে ৫ থেকে ৬ লাখ টন আমদানি করা হয়। যেটার অধিকাংশই আসে ভারত থেকে। এছাড়া মিয়ানমার, মিশর, তুরস্ক, চীন থেকে অল্প পরিমাণে আমদানি হয়।

 

তবে ভারত থেকে সড়কপথে পেঁয়াজ আনা সহজ। পাশাপাশি আমদানি খরচ কম। ফলে দেশের অধিকাংশ আমদানিকারক দেশটি থেকে তা আনেন। ঢাকার শ্যামবাজারের ব্যবসায়ী ও আমদানিকারক গোকুল কৃষ্ণ মানিক এই তথ্য জানান।

 

তিনি বলেন, ভারত থেকে পেঁয়াজ আসে স্থলপথে ট্রাক দিয়ে। কিন্তু সেটি যদি মিশর বা তুরস্ক থেকে আনি তাহলে আনতে হয় জাহাজে। তখন খরচও বেড়ে যায় বেশ কয়েকগুণ। আর অনেক দিন জাহাজে থাকার ফলে পেঁয়াজ নষ্টও হয় বেশি পরিমাণ। এই কারণে পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর ভারত নিষেধাজ্ঞা দিলে দেশের বাজারে দামে বড় ধরনের তারতম্য দেখা দেয়।

 

তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, আমদানি না করে উৎপাদনে সমন্বয় ও বাজার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দেশীয় পেঁয়াজ দিয়েই দেশের চাহিদা মেটানো সম্ভব।

 

যে কারণে প্রতিবছর দাম বাড়ে 

দেশে পেঁয়াজের উৎপাদনের বিষয়টি নিয়ে কাজ করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মসলা গবেষণা কেন্দ্র। সংস্থাটির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার চাষ সংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখেন। তিনি বলেন, দেশে সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর-ডিসেম্বর পর্যন্ত সাধারণত পেঁয়াজের ঘাটতি থাকে। যে সুযোগ কাজে লাগিয়ে মজুতদাররা বাজারে অস্থিরতা তৈরি করার চেষ্টা করে। দেশীয় উৎপাদনের বড় অংশ হয় বছরের মার্চ-এপ্রিলে। সেসময় মোট দেশীয় উৎপাদনের ৮০ ভাগ পেঁয়াজ কৃষক ঘরে তোলে। তাই দর সবচেয়ে কম থাকে।

 

ড. মজুমদার বলেন, দেশে উৎপাদিত প্রধান পেঁয়াজ ওঠে মার্চ-এপ্রিলে। এছাড়া জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে হয় মুড়িকাটা। জুন-জুলাইয়ে অল্প পরিমাণ গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ হয়। সেপ্টেম্বরের পর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত নতুন মুড়িকাটার ফলন হয়। এর আগের সময়টায় বাজারে কিছুটা ঘাটতি থাকে। নভেম্বর-ডিসেম্বরে অধিকাংশ কৃষকের কাছে পেঁয়াজের মজুত থাকে না। এই সময়ে যাদের কাছে থাকে, তারা বাজারে সরবরাহ কমিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করার এবং দাম বাড়ানোর চেষ্টা করেন।

 

দেশীয় উৎপাদন ও চাহিদার সমন্বয় 

দেশে বার্ষিক চাহিদা ২৭-২৮ লাখ টন। যার পুরোটাই দেশীয় উৎপাদিত পেঁয়াজ দিয়েই পূরণ করা সম্ভব বলে মনে করেন ড. মজুমদার। তার মতে, বছরজুড়ে নির্ধারণ করে দেয়া হলে কৃষক সঠিক দাম পাওয়ার নিশ্চয়তা পাবে। তাহলে দেশেই বছরে ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টন উৎপাদন করা সম্ভব হবে। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে চাহিদার প্রায় পুরোটা উৎপাদন করা হয়েছিল। কিন্তু ঝুঁকি এড়াতে ওই বছরও ৬ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। ফলে জোগান হয়ে যায় চাহিদার চেয়ে বেশি। যে কারণে বিপুল পরিমাণ দেশীয় ও আমদানি করা পেঁয়াজ নষ্ট হয়।

 

তিনি বলেন, সেই বছর কৃষকরা দেশীয় পেঁয়াজের দাম কম পান। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হন তারা। তাতে পরের বছর অনেক কৃষক চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। ফলস্বরূপ পরের অর্থবছরে (২০২২-২৩) পেঁয়াজের উৎপাদনও কমে যায়। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে দাম যদি নির্ধারণ করে দেয়া যায়, যেমন মার্চ-এপ্রিলে ৫০ টাকা, জুন-জুলাইয়ে ৬০ টাকা এবং বছরের শেষদিকে ৭০ টাকা, তাহলেই কৃষক নির্দিষ্ট পরিমাণ পেঁয়াজ ফলাতে উৎসাহিত হবেন।

 

ড. মজুমদার মনে করেন, কৃষকের চাষাবাদের খরচ বিবেচনায় রেখে মিয়ানমারের মতোও পেঁয়াজের সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া উচিত। যাতে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত না হন। লাভজনক হলে প্রতিবছরই পেঁয়াজ চাষে উৎসাহিত হবেন তারা। তাতে ঘাটতিও কমে আসবে। পাশাপাশি সংরক্ষণের আধুনিক পদ্ধতির ব্যবস্থা, কৃষকদের প্রশিক্ষণ, অন্য ফসলের সঙ্গে চাষ করতে উৎসাহ, ভালো ও উন্নত বীজ সরবরাহ করলে পেঁয়াজে কয়েক বছরের মধ্যেই স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারবে বাংলাদেশ।

 

দাম নিয়ন্ত্রণ 

ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) মতে, বাজারে সরকারের নজরদারি বাড়ানো এবং ব্যবসায়ীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা গেলে পেঁয়াজের দাম নিয়ে প্রতিবছর এই পরিস্থিতি তৈরি হবে না। ক্যাবের সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, আমরা বারবার বলেছি সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের একটা বার্ষিক পরিকল্পনা থাকতে হবে। কখন আমদানি করবে আর কখন দেশীয় উৎপাদন দিয়ে চাহিদা পূরণ হবে-এরকম উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।