ঢাকা, ১৩ ডিসেম্বর শুক্রবার, ২০২৪ || ২৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
৮৪৭

রাজনীতির পরাজয়: সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের বিজয়

মাসুদা ভাট্টি

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১০:০৪ ১৩ মার্চ ২০১৯  

মাসুদা ভাট্টি

মাসুদা ভাট্টি

দীর্ঘ ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসু নির্বাচন। যে নির্বাচনের জন্য একাধিক ব্যক্তি ও সংগঠন দাবি জানিয়ে এলেও শেষ পর্যন্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন সান্ধ্যকালীন ছাত্র নির্বাচনের দাবিতে অনশনে বসার ঘোষণা দিলে নির্বাচনের দাবিটি জোরালো হয় এবং এক সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে কাজ শুরু করে।

বিষয়টি আদালত পর্যন্তও গড়িয়েছিল। একটি দেশের প্রধানতম বিশ্ববিদ্যালয়টির নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়েই যদি এরকম দীর্ঘ ও বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয় তাহলে সহজেই বিষয়টি অনুমানযোগ্য যে, এদেশ আসলে নির্বাচনের প্রতি কতোটা আগ্রহী। বিশেষ করে সামরিক শাসনমাল ও সামরিক ছাউনিজাত রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনীতি যে আসলে নির্বাচনের ব্যাপারে বেশ অনাগ্রহী তা দেশের নির্বাচনী পরিসংখ্যানটি বিচার করলেই পরিষ্কার হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হলেও সেটিও যে বিতর্কিত ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হলো না, সেটি নিঃসন্দেহে আলোচনার দাবি রাখে।

অনেকেই বলতে শুরু করেছেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও আসলে জাতীয় নির্বাচনের ছায়া পড়েছে এবং জাতীয় নির্বাচনের মতোই এখানেও ‘কারচুপি’ হয়েছে। সদ্য অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ইতোমধ্যেই বহু বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়েছে, এ নিয়ে নতুন করে কিছু বলতে চাচ্ছি না । কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনে দিনের শুরুতেই যেসব অনিয়ম সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীরা অভিযোগ এনেছে তার প্রতিটিই কর্তৃপক্ষ আমলে নিয়েছে এবং ত্বরিত ব্যবস্থা নিয়েছে বলে গণমাধ্যমই আমাদের জানিয়েছে। একাধিক রিপোর্টারের রিপোর্ট থেকে যেসব বিষয় জানা যায় তার মধ্যে কুয়েত মৈত্রী হল এবং রোকেয়া হলের ঘটনা দু’টি উল্লেখযোগ্য এবং দুই জায়গায়ই বাক্সভর্তি ব্যালট-পেপার পাওয়া গেছে। কুয়েত মৈত্রী হলের প্রোভোস্টকে সঙ্গে সঙ্গে বরখাস্ত করা হয়েছে এবং রোকেয়া হলের ঘটনায় নির্বাচনে অংশ নেয়া সব ছাত্র নেতার উপস্থিতিতে অব্যবহৃত ব্যালট পেপারগুলো সরানো হয়েছে এবং সেগুরো যে ব্যবহার করা হবে না সেটি তারা নিশ্চিত হয়েছেন বলে ছাত্র-ছাত্রীরাই জানিয়েছেন। কিন্তু এই প্রশ্ন এখানে অনিবার্য হয়ে ওঠে যে, এরকম ব্যালট-পেপার এলো কোত্থেকে এবং নির্বাচেনর সঙ্গে সম্পৃক্ত শিক্ষকরাই বা এরকম ব্যালট পেপারের বান্ডিল আগলে বসেছিলেন কেন?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনের জয় কিংবা পরাজয় এমনকি দিকনির্দেশনা জাতীয় রাজনীতিতে দিতো যার জন্য এই নির্বাচন প্রক্রিয়াটিকে বিতর্কিত করা হলো? আমি নিশ্চিত যে, সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা এ প্রশ্নটি এড়িয়ে যাবেন এবং যে যার দায়িত্বের অবহেলাকেও স্বীকার করবেন না। কিন্তু এর ফলে যে ক্ষতিটি হলো তা কি এড়ানো সম্ভব হবে? প্রথমতঃ নির্বাচন সুষ্ঠু হলো না বলে যে দাবি এখন চারদিকে তোলা হচ্ছে তাকে কোনো ভাবেই শোধরানো যাবে না। এমনকি যদি একাধিক হলে সরকার-সমর্থক প্যানেলের ভিন্ন কোনো প্যানেল বা ব্যক্তি জয়লাভ করেও।

দ্বিতীয়ত এই নির্বাচন বিতর্কিত হওয়ার ফলে দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক আলোচনাতেও এর বিরূপ প্রভাব পড়বে এবং মূলত সরকারি দলকেই এর টার্গেট হতে হবে। আমরা ধরেই নিচ্ছি যে, জাতীয় নির্বাচনের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদ নির্বাচনেও সরকার-সমর্থকদের বাইরে প্রত্যেকেই নির্বাচন করেছে মূলত দু’টি প্রধান উদ্দেশ্য নিয়ে,

এক. বিজয়ী হলে বলা যাবে যে, সরকারের বিরুদ্ধে জনগণ রায় দিয়েছে,

দুই. আর পরাজিত হলে জাতীয় নির্বাচনের মতো ডাকসু নির্বাচনও সুষ্ঠু হয়নি অতএব আন্দোলনে নামো।

লক্ষ্য করে দেখুন, নির্বাচন শুরু হওয়ার পর থেকে কিছু অনিয়মের ব্যাপারে জানা গেলেও কেউ নির্বাচন বর্জন করেনি কিন্তু নির্বাচন শেষ হওয়ার মাত্র কিছুক্ষণ আগে সকলে একত্রিত হয়ে নির্বাচনের বর্জনের ঘোষণা দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ভিসির বাড়ি ঘেরাও করে তার পদত্যাগ দাবি করে পুনঃনির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ শুরু হয়। কী হতো যদি সেই সময়ই নির্বাচন অনুষ্ঠান বাতিল করে দিয়ে সময় নিয়ে আরেকটি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করলে? আমার মনে হয়, সেটাই হতো সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু আমাদের দেশের কোনো ক্ষেত্রেই যে সঠিক সিদ্ধান্ত সঠিক সময়ে নেওয়া সম্ভব হয় না সেটাতো জানা কথা।

কিন্তু প্রশ্ন সেখানে নয়। গত প্রায় এক দশক ধরেই বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা তা সে জাতীয়, স্থানীয় কিংবা ডাকসু, যে নির্বাচনই হোক না কেন, প্রতিটি ক্ষেত্রে একটি নতুন প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তাহলো, একটি পক্ষ অর্থাৎ সরকার যে কোনো উপায়ে নির্বাচনে বিজয় লাভ করতে চায় আর বিরোধী পক্ষ নিজেদেরকে সরকারের ‘ভিকটিম’ হিসেবে জনগণের সামনে প্রমাণ করতে গিয়ে নির্বাচনকে বিতর্কিত করার সকল প্রকার আয়োজন নিয়েই ব্যস্ত থাকে এবং শেষ পর্যন্ত হেরে গিয়ে ঢালাও প্রচারণা শুরু করে দেয় যে, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি, এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হবে না, হওয়ার নয়।

৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে এই পদ্ধতিতে কাজ করে যে ভরাডুবি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের হয়েছে তা থেকে যে তারা কোনো প্রকার শিক্ষাই গ্রহণ করেনি তার প্রমাণ আবার পাওয়া গেলো ডাকসু নির্বাচনে। এখানেও সেই একই পদ্ধতি, কথায় কথায় সাংবাদিক সম্মেলন, মিথ্যাচার আর গুজব ছড়িয়ে ভোটারদের বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে মূল নির্বাচনী প্রচারণার চেয়ে।

নির্বাচনের দিন সকালেই দু’টি বড় অনিয়মের ঘটনা ধরে ফেলে সারাদিন সেটি নিয়েই তারা ব্যতিব্যস্ত থেকেছে এবং তাদের গুরুকূল (শিক্ষকবৃন্দ) ছাত্র রাজনীতিকে আগেও যেভাবে কলুষিত করেছে এবারও সেই একই পন্থায় নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ত্রুটিপূর্ণ করার কৌশলকে বেছে নিয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা ভোট দিতে পেরেছে এবং ভোটের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর দেখা গেছে যে, ফলাফল আসলে জাতীয় নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্টের চেয়ে যথেষ্টই ভালো হয়েছে। একটি ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থক ছাত্র সংগঠন যতটুকু সফলতা দাবি করে বা এর আগে পেয়েছে, তার থেকে বরং কমই ভোট পেয়েছে তারা। নিঃসন্দেহে এটি সরকারের জন্য, সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠনের জন্য একটি চরম বার্তাও বটে।

এখন এই প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই উঠে আসে যে, তাহলে যারা নির্বাচন শেষ হওয়ার মাত্র ঘণ্টা খানেক আগে নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করার ঘোষণা দিয়েছিল তারা এখন কি এই যে ভিপি পদ-সহ বাকি এতোগুলো পদে জয়লাভ করলো, এখনও কি তারা নির্বাচনটি বাতিল ঘোষণার পক্ষে থাকবেন? এরই মধ্যে গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিজয়ী কোটাপন্থীদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তারা এর চেয়ে বেশি ভালো ফলাফল করতো। একথা খুব মামুলি কথা বটে। কিন্তু আরেকটি সত্য এখানে দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারে অনেকের যে, এই নির্বাচনে কিন্তু সবচেয়ে বড় ভরাডুবিটি ঘটেছে বিএনপিপন্থী ছাত্রদল এবং বাম রাজনীতির সমর্থক ছাত্রসংগঠনগুলির। তারা যে বাংলাদেশের রাজনীতিতেই অপাংতেয় হয়ে পড়ছেন ক্রমশ এই বার্তাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা এই নির্বাচনের মাধ্যমে দিয়ে দিয়েছে। নির্বাচন মানেই এক ধরনের শিক্ষা, ফলে ডাকসু নির্বাচন থেকেও কে কি শিক্ষা নিচ্ছেন সেটাও দেখার বিষয়।

আগেই বলেছি যে, ডাকসু’র এবারের নির্বাচনেও শিক্ষক রাজনীতির নোংরামি ছাত্রদেরকে শুধু ভুগিয়েছে তাই-ই নয়, বরং শিক্ষকরা বুঝতেও পারেনি যে, তারা আসলে তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকুও এবার হারিয়েছেন। সরকার সমর্থক শিক্ষকগোষ্ঠী নিজ দায়িত্বে সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠনকে সহযোগিতা করতে গিয়ে সম্মান হারিয়েছেন আর সরকার-বিরোধী শিক্ষকগোষ্ঠী সরকার-বিরোধী ছাত্রসংগঠনগুলিকে কখনও মিথ্যাচার দিয়ে, কখনও গুজব দিয়ে কিংবা কখনও একেবারেই অন্যায় সব দাবী-দাওয়া দিয়ে বিভ্রান্ত করে ভোটের মাঠে মার খাইয়েছেন। দু’পক্ষই যে অন্যায় করেছেন এবং তার ভুক্তভোগী যে ছাত্ররাই হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

দেশের সর্বস্তরের নির্বাচনী ব্যবস্থার যে ত্রুটি’র প্রসঙ্গটি এখানে তুলেছি তা আরও বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে। কিন্তু এখানে অল্প কথায় বলতে চাইছি যে, সরকারি দলের জয় মানেই নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি বা নির্বাচনে কারচুপি করা হয়েছে- এ ধরনের চিন্তাধারা থেকে না বেরুনো পর্যন্ত এদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে সফল করা সম্ভব হবে না। সেটা জাতীয় নির্বাচনে হোক, স্থানীয় কোনো নির্বাচনে হোক কিংবা হোক ডাকসু’র মতো নির্বাচন। ভোটের রাজনীতি বাংলাদেশে নতুন রূপ পাচ্ছে, এই সত্য সকল পক্ষকেই উপলব্ধি করতে হবে। ২০০১ সালের ভোটার আর ২০০৮ সালের ভোটার যেমন এক নয়, তেমনই এক নয় ডাকসু’র আশির দশকের নির্বাচন আর ২০১৯ সালের নির্বাচন। এই সত্য বুঝতে না পারলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্বাচনী ব্যবস্থার চরিত্র বদলাবে না, সিইসি কিংবা উপাচার্যকে গালাগাল দেওয়াই সার হবে শুধু। ডাকসু নির্বাচনে যতোটুকু ত্রুটি হলে নির্বাচনকে মোটামুটি সুষ্ঠু বলা যায় সেরকমটাই হয়েছে, বাকিটুকু ছিল রাজনৈতিক খেলা এবং অপপ্রচার। দুঃখজনক সত্য হলো, এই অপপ্রচারে দেশের ও বিদেশের অনেক বিজ্ঞজনই জেনে বা না-জেনে অংশ নিয়েছেন, ধারণা করি, তারা প্রত্যেকেই আসলে নির্বাচনের চেয়ে নিজেদের রাজনীতিকেই এক্ষেত্রে প্রাধান্য দিয়েছেন সবচেয়ে বেশি।

ঢাকা ১২ মার্চ, মঙ্গলবার, ২০১৯
[email protected]

মুক্তমত বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর