ঢাকা, ২৬ নভেম্বর মঙ্গলবার, ২০২৪ || ১২ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
৪৩৪

রাজাকার তালিকায় তোলপাড় : সমালোচনা-বিক্ষোভ-প্রতিবাদ

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১১:৩৯ ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯  

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত রাজাকারের তালিকা নিয়ে সারা দেশে তুমুল সমালোচনা, বিক্ষোভ - প্রতিবাদ চলছে। এ তালিকায় সরকারি দল আওয়ামী লীগের অনেক নেতা, মুক্তিযোদ্ধা ও খোদ যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান আইনজীবীর নাম উঠে আসায় তালিকা নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। তালিকা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলছে তীব্র সমালোচনা।

 

বরিশাল, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, ঝালকাঠি, বরগুনা, বগুড়া ও রাঙামাটি জেলায় মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও আওয়ামী লীগ নেতাদের কয়েকজনের নাম তালিকাভুক্ত দেখে ক্ষোভ ও হতাশা জানিয়েছেন স্থানীয় নেতা-কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধারা। দেশের অনেক এলাকায় বিক্ষোভ কর্মসূচিও দেয়া হয়েছে।

 

গেল রোববার রাজাকার তালিকা প্রকাশ করে সরকার। এতে রয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী ১০ হাজার ৭৮৯ জনের নাম। তীব্র সমালোচনার মুখে  প্রকাশিত তালিকা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। তিনি বলেছেন, ব্যাপকভাবে অভিযোগ পাওয়া গেলে তালিকা প্রত্যাহার করা হবে। আর ‘দুই-এক শ’ নামে ভুল হলে সংশোধন করা হবে।

 

আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তালিকা প্রকাশের আগে আরও যাচাই-বাছাই করার দরকার ছিল।

 

তালিকায় নাম আসা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান আইনজীবী গোলাম আরিফ টিপু বলেছেন, ‘আমি একজন ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা, অথচ নাম রাজাকারের তালিকায়। ২০১০ সালের ২৮ মার্চ সরকার আমাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দায়িত্ব দিয়েছে। আজ আমার নাম রাজাকারের তালিকায়!’

 

এদিকে গতকাল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, একাত্তরে ‘প্রকৃতপক্ষে’ স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন না, এমন কারও নাম সরকারের প্রকাশিত স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকায় এসে থাকলে তা বাদ দেওয়া হবে। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটি ও স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর ব্যাখ্যা তুলে ধরা হয়।

 

ক্ষোভ, অসন্তোষ :

 

স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকার ৮৯ নম্বর পৃষ্ঠায় রাজশাহী জেলার প্রকাশিত নামগুলোর মধ্যে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপুসহ পাঁচজনের নাম আছে। এ পাঁচজন এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যরাও ছিলেন স্বাধীনতার পক্ষের মানুষ।

মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক অ্যাডভোকেট মহসিন আলীর নামও আছে সেই তালিকায়।

তালিকায় থাকা আবদুস সালামের পরিবারের পাঁচজন সদস্য মুক্তিযুদ্ধের সময় নিহত হন।

তৎকালীন জেলা প্রশাসক আবদুর রউফ ও পুলিশ কর্মকর্তা এস এস আবু তালেবের নামও আছে তালিকায়।

এমন ভুলেভরা রাজাকারের তালিকা নিয়ে ক্ষোভে ফুঁসছেন রাজশাহীর মুক্তিযোদ্ধারা। তারা বলছেন, প্রকাশিত এ তালিকায় তৎকালীন রাজশাহী জামায়াতের আমির অ্যাডভোকেট আফাজ উদ্দিন, শান্তি কমিটির সভাপতি সাবেক এমপি আয়েন উদ্দিনের নাম নেই।


রাজশাহীর প্রবীণ সাংবাদিক জেলা ন্যাপ সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফিজুর রহমান খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। ’৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনের সময় রাষ্ট্রভাষা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, রাজশাহীর তিনি যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। মূলত তার নেতৃত্বেই রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল। ভাষা আন্দোলনে বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৯ সালে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। সঠিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য ১৯৭১ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট স্টিয়ারিং কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন টিপু।’ এ ছাড়া তালিকায় নাম আসা অ্যাডভোকেট সালাম ও অ্যাডভোকেট মহসিন মিয়া ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের রাজশাহী অঞ্চলের অন্যতম সংগঠক। এখনো বহু মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটে অ্যাডভোকেট মহসিনের স্বাক্ষর আছে।

 

বরিশালের ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট তপন কুমার চক্রবর্তী এবং তার মা শহীদজায়া ঊষা রানী চক্রবর্তী, মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক মিহির লাল দত্তের নাম রাজাকারের তালিকায় আসায় বরিশালজুড়ে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ নিয়ে সমালোচনা চলছে। বরিশালে স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকায় তাদের নাম আসায় প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে। 

নগরের সদর রোড অশ্বিনী কুমার হলের সামনে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত তালিকায় আগুন ধরিয়ে প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ। এ সময় তারা পুনরায় তালিকা প্রকাশের দাবি জানান। পরে তারা নগরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেন। বাসদের পক্ষ থেকে গতকাল স্থানীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনেও প্রতিবাদ জানানো হয়। এ সময় তপন কুমার চক্রবর্তী ও তার মেয়ে ডা. মনীষা চক্রবর্তী উপস্থিত ছিলেন।

তপন কুমার চক্রবর্তী বলেন, ‘একজন গেজেটেড মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা দুঃখজনক। যারা এটা ঘটিয়েছে তারা অসদুদ্দেশ্যে এটা করেছে। তালিকা সংশোধনের পাশাপাশি জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে হবে।’

ডা. মনীষা চক্রবর্তী বলেন, ‘বিজয় দিবসের প্রাক্কালে শুধু মুক্তিযোদ্ধাকে নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অপমান করা হয়েছে।’

 

বগুড়ার বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগ নেতার নাম রাজাকার তালিকায় থাকায় বিজয় দিবসের এক অনুষ্ঠানে ক্ষোভ প্রকাশ করে তালিকাটি সংশোধনের দাবি জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা।

তালিকায় ১৮ নম্বরে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক এমপি কছিম উদ্দিন আহম্মেদের নাম। কছিম উদ্দিনের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী এখনো মুক্তিযোদ্ধা ভাতা উত্তোলন করেন।

আওয়ামী লীগের সাবেক এমএনএ মজিবর রহমান (আক্কেলপুর), মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার মনছুর আলী, আওয়ামী লীগের সাবেক উপজেলা সভাপতি তাহের উদ্দীন সরদার, সাবেক রেলওয়ে শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা মুক্তিযোদ্ধা জাহান আলী, সান্তাহার কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আমিরুল ইসলাম এবং আওয়ামী লীগ নেতা ফয়েজ উদ্দীন আহম্মেদের নামও রয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধারা এ তালিকা দেখে হতবাক। তারা বলছেন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এটা করা হয়েছে। এ তালিকা সঠিক নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের বা মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তাকারীদের রাজাকার বানানোর বিচার করতে হবে।

 

বরগুনার পাথরঘাটা মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি, পাথরঘাটা থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি প্রয়াত মজিবুল হকের নাম স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকায় আসায় স্থানীয়রা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তার নাম রাজাকারের তালিকায় আসায় স্থানীয়রা মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ। এতে আওয়ামী লীগের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে। প্রয়াত মজিবুল হকের স্ত্রী নুরজাহান বেগম (৯০) বলেছেন, ‘বড় বেদনার, বড় কষ্টের; মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক, মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি, থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি যিনি এখন রাজাকারের তালিকায়। বিদায়ের বেলায় দেখতে হলো আমার স¦ামীর নাম রাজাকারের তালিকায়, তাও আবার ১ নম্বরে! আমার স্বামীকে এখন কবর থেকে তুলে বিচার করতে হবে!’

বিক্ষুব্ধ মুক্তিযোদ্ধারা  পাথরঘাটা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। পাথরঘাটা পৌর শহরের শেখ রাসেল চত্বরে মানববন্ধন করা হয়। এছাড়া বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

তালিকায় ঝালকাঠি জেলার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক জেলা কমান্ডার প্রয়াত শামসুল আলম ওরফে সামশুর নাম আসায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তার পরিবারসহ স্থানীয়রা। তার ছেলে সৈয়দ জাকারিয়া আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার বাবা চারবার জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডারের দায়িত্ব ছিলেন। একাত্তরের রণাঙ্গনের একজন যোদ্ধা ছিলেন তিনি। তার নাম রাজাকারের তালিকায় ওঠার মতো চরম দুঃখজনক এবং বিস্ময়কর ঘটনা আর থাকতে পারে না।’ রাঙামাটিতে রাজাকারের তালিকা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন রাঙামাটি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রবার্ট রোনাল্ড পিন্টু।

 

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রকাশিত রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সিরাজগঞ্জে গঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের পলাশডাঙ্গা যুবশিবিরের সর্বাধিনায়ক, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও উল্লাপাড়া থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের প্যানেল স্পিকার প্রয়াত আব্দুল লতিফ মির্জার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। আব্দুল লতিফ মির্জার নাম এ তালিকা থেকে প্রত্যাহারের জোর দাবি জানিয়েছেন তারা।

এ বিষয়ে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার ও পলাশডাঙ্গা যুবশিবিরের সামরিক প্রশিক্ষক সোহরাব আলী সরকার বলেন, আব্দুল লতিফ মির্জার নাম কীভাবে এ তালিকায় এল, সেটাই ভাবার বিষয়। এতে আমরা হতাশ হয়েছি।

বিষয়টি নিয়ে করণীয় ঠিক করতে আজ স্থানীয় সব মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে জরুরি বৈঠক ডাকা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

বিষয়টি নিয়ে আব্দুল লতিফ মির্জার পরিবারের পক্ষ থেকেও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেয়া হয়েছে। আব্দুল লতিফ মির্জার মেয়ে মুক্তি মির্জা বলেন, এমন ঘটনায় আমরা স্তম্ভিত ও বাকরুদ্ধ। লতিফ মির্জার নাম রাজাকারের তালিকায় আসা মানে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশকেই অস্বীকার করা। মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত ছয়টি বেসামরিক বাহিনীর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা সংগঠন সিরাজগঞ্জের পলাশডাঙ্গা যুবশিবির ছিল খুবই শক্তিশালী, যার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন আমার বাবা। বিষয়টি জানানোর জন্য আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে নাটোরে সেখানকার কুখ্যাত ৫৯ রাজাকারের একটি তালিকা তৈরি হয়েছিল। তত্কালীন নাটোর মহকুমার প্রশাসন এতে স্বীকৃতিও দিয়েছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের রোববার প্রকাশিত তালিকায় এদের নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিষয়টি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা।

নাটোরের সিংড়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আব্দুল ওয়াদুদ দুদু বলেন, ১৫ ডিসেম্বর সরকারিভাবে যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, সে তালিকা ভুলে ভরা। প্রকৃত যারা রাজাকার ছিল, তাদের নাম তালিকায় আসেনি। তাছাড়া কিছু কিছু স্বীকৃত রাজাকার এখনো বেঁচে রয়েছে। তারা বুক ফুলিয়ে চলছে। তালিকা আরো যাচাই-বাছাই করে প্রকাশ করলে ভালো হতো।

১৯৭৫ সালের ৫ মার্চ নাটোর মহকুমার ৫৯ রাজাকারের একটি নামের তালিকা প্রকাশ করা হয়। নাটোর মহকুমার তত্কালীন প্রশাসনও এ তালিকায় স্বীকৃতি দেয়। তালিকাটি পরবর্তী সময়ে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে বলে সন্দেহ করছেন তারা।

এ বিষয়ে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের যুগ্ম আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম নান্টু বলেন, ১৯৭৫ সালের ৫ মার্চ প্রকাশিত রাজাকারের তালিকায় নাটোর মহকুমার ৫৯ জনের নাম থাকলেও স্বাধীনতাবিরোধীদের নতুন তালিকায় তাদের নাম আসেনি।

তিনি আরো বলেন, তত্কালীন মহকুমার সংস্থাপন, রেকর্ড রুম বা ট্রেজারি অফিসে স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা থাকার কথা। কারণ মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস রাজাকাররা স্বাক্ষর করে বেতন-ভাতা উত্তোলন করেছে। কিন্তু ’৭৫-পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় আসীন হওয়া রাজনৈতিক দলের নেতারা সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে এ তালিকা সরিয়ে ফেলতে পারে বলে আমরা ধারণা করছি।

অন্যদিকে নাটোর জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার (নেজারত, ট্রেজারি, ফর্মস অ্যান্ড স্টেশনারি) জাকির মুন্সি বলেন, এ ধরনের তালিকা আদৌ আছে বা ছিল কিনা, তা আমার জানা নেই।

নাটোর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার রাজাকার, আলবদর, আলশামস বা শান্তি কমিটির কোনো তালিকা বা দলিলপত্র পাওয়া যায়নি। জেলা প্রশাসক মো. শাহরিয়াজ জানান, ট্রেজারি অফিসে অনুসন্ধান করে কোনো দলিলপত্র পাওয়া যায়নি।

তিনি বলেন, তত্কালীন সময়ে মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয় (এসডিও) অফিস ছিল নাটোরে। কিন্তু ট্রেজারিতে সে সময়ের কোনো দলিলপত্র বা তালিকা নেই। আমরা অনুসন্ধান করে এ ধরনের কোনো কাগজপত্র পাইনি।

 

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর দুঃখ প্রকাশ :

 

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকায় সরকারি গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার নাম আসায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। গতকাল রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ব্যাপকভাবে অভিযোগ পাওয়া গেলে প্রকাশিত ওই তালিকা প্রত্যাহার করা হবে। আর দুই-এক শ নামে ভুল হলে সংশোধন করা হবে। তবে ওই ভুলের জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায় অস্বীকার করে তিনি বলেছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তালিকা তারা হুবহু প্রকাশ করেছেন, কোনো পরিবর্তন করা হয়নি।

স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের নাম দেখে নেতা-কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধারাও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বলেন, ‘এখনো এ তালিকা সংশোধন করা সম্ভব। কে করতে পারে সঠিকভাবে? ওই সময়কার লোকেরা। তাই তাদের জীবিত অবস্থায় প্রকাশ পাওয়ায় আমি মনে করি, তারা আহত হলেও, কষ্ট পেলেও একটা সংশোধন হওয়ার সুযোগ রয়েছে।’

তবে তিনি মনে করেন, ‘কিছু ভুলের অভিযোগ এলেও রাজাকারের ওই তালিকা বিতর্কিত হয়নি। অভিযোগ যেহেতু এসেছে ... বিতর্কিত হয়ে গেল - এটা বলা যাবে না। এটা দেখতে হবে সংখ্যাটা কতজন? আমার মনে হয়, আমি যতটুকু খবর পাচ্ছি; বরিশাল বিভাগ সম্পর্কেই অভিযোগগুলো পাচ্ছি।’

তিনি বলেন, ‘আমরা স্বীকার করব না যে আমরা করেছি। এ তালিকা আগেই করে রেখে গেছে। সেখানে কোনো ইল মোটিভ থাকতে পারে। উদ্দেশ্যমূলক... ভাই, যেভাবে আসছে, আমি তো বললাম, আমরা এটায় এডিট করি নাই। আমরা এখানে দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন; যেভাবে এসেছে; সেটা প্রকাশ করেছি।’

মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা অতন্ত বিনয়ের সঙ্গে যেটা বলছি, তালিকা আমরা তৈরি করি নাই। জাতির দাবি ছিল, তাই প্রকাশ করেছি। আমি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে করি নাই।’

তপন চক্রবর্তীর মেয়ে ডা. মনীষা চক্রবর্তীর প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করে মন্ত্রী বলেন, ‘আমার নাম এলে আমি যেভাবে কষ্ট পেতাম, উনারাও সেভাবে কষ্ট পেয়েছেন। সেজন্য আমি ব্যথিত। আমিও কষ্ট পেয়েছি, সেটা তো আমি বলেছি।’

 

প্রকাশের আগে যাচাই করা উচিত ছিল :

 

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘এটি রাজাকারের তালিকা নয়। এটি হচ্ছে ১৯৭২ সালে দালাল আইনে করা মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছিল তাদের তালিকা। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে চাপ ছিল তালিকাটি দ্রুত দেওয়ার। আমরা শুধু ওই সময়ের তালিকাটি তাদের কাছে দিয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘এটা রেকর্ড। আর রেকর্ডে আমাদের হাত দেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু তালিকাটি যাচাই-বাছাই না করে প্রকাশ করে দিয়েছেন।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উচিত ছিল তালিকাটি যাচাই-বাছাই করে একটু সময় নিয়ে প্রকাশ করা। তাহলে এ ভুলগুলো হতো না।’

তিনি বলেন, ‘রাজাকারের তালিকা জেলা প্রশাসকদের কার্যালয়ে পাওয়া যাবে। তৎসময়ে তালিকাভুক্ত রাজাকাররা ডিসি অফিস থেকে বেতন নিত। সেখানে তাদের তালিকা রয়েছে।’

 

রাজাকারের তালিকায় নাম থাকায় টিপুর ‘আফসোস’ :

 

ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও রাজাকারের তালিকায় নাম আসায় আফসোস করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু।  ট্রাইব্যুনালের নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের কাছে গোলাম আরিফ টিপু বলেন, ‘আমি একজন ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। অথচ আমার নাম রাজাকারের তালিকায়! ২০১০ সালের ২৮ মার্চ সরকার আমাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দায়িত্ব দিয়েছে। অথচ আজ আমার নাম রাজাকারের তালিকায়! কীভাবে রাজাকার, আলবদর তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার নাম এলো, সেটা কীভাবে হলো- এর উৎস খুঁজে বের করতে হবে। এর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি জানাই।’

তিনি বলেন, ‘আশা করছি, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় তাদের ভুল বুঝতে পারবে। খুব দ্রুত সংশোধনী দিয়ে তা নতুন করে প্রকাশ করবে। এ ছাড়া এর সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনবেন।’

এর আগে গোলাম আরিফ টিপুর লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সীমন।

পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম বলেন, ‘আমরা এর আগে যতবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কাজের জন্য প্রয়োজনীয় নথি চেয়েছি, তারা কোনো দিন তা আমাদের সরবরাহ করেনি।’

 

প্রসঙ্গত, ১৫ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নথি পর্যালোচনা করে প্রথম ধাপে ১০ হাজার ৭৮৯ জন রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। তবে ওই তালিকায় কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার নাম উঠে আসায় তা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়।

 

‘ভূত তাড়াতে হবে’ :

 

গণফোরামের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা মহসীন মন্টু বলছেন, ‘গোলাম আরিফ টিপু শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধাই নন, ভাষা আন্দোলনেও তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। তিনি সব সময় প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের হেয় করতেই গোলাম আরিফ টিপুর নাম রাজাকারের তালিকায় দেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ভূত আছে। এ ভূত তাড়াতে হবে। এ তালিকা বিতর্কিত। এটা প্রত্যাহার করা উচিত।’

বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা মহসীন মন্টু বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুকে আমি চিনি আমার শৈশব থেকেই। তিনি ভালো ফুটবল খেলতেন। আমার বড় ভাইয়ের ক্লাসমেট ছিলেন। রাজশাহী কলেজের ছাত্র ছিলেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনা করেছেন। আমার বাবাও রাজশাহী কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। বড় ভাইয়ের ক্লাসমেটের সুবাদে গোলাম আরিফ টিপুর সঙ্গেও আমার সখ্য ছিল।’ তিনি আরও বলেন, ‘পাকিস্তানিদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কেন রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করা হবে? প্রতিটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে তালিকা আছে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠন আছে। সবাই সবাইকে চেনেন। এ তালিকা আরও গভীরভাবে যাচাই-বাছাই করা উচিত ছিল। সরকারকে বলব, বিতর্কিত এ তালিকা বাদ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে নতুন করে তালিকা তৈরি করুন।’

 

বাংলাদেশ বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর