ঢাকা, ০৩ ডিসেম্বর মঙ্গলবার, ২০২৪ || ১৯ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
৫৪০২

রাসেল নেই, আছে তার সাইকেল

শহিদুল হক ভুঁইয়া স্বপন

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২২:৩৭ ১৯ অক্টোবর ২০২০  

এ সাইকেল (ছবিতে পেছনেরটি) ১৯৭২ সালে লন্ডন থেকে এনে আমার বাবা বিলেতে মুক্তিযুদ্ধে স্টিয়ারিং কমিটির আহ্বায়ক আজিজুল হক ভুঁইয়া রাসেলের জন্মদিনে উপহার দিয়েছিলেন। এটি তার খুবই প্রিয় ছিল। সাইকেলটির সিট উঁচু-নিচু করে অ্যাডজাস্ট করা যেতো। ভেপু লাগানো ছিল। খুব চমৎকার রিংগিং বেল ছিল। অনেক মধুর শব্দ হতো। 

 

রাসেল বেশিরভাগ সময় এটা চালাতো। অনেক ছবি আছে এ সাইকেলসহ তার। আমার আর ওর বয়স মাত্র ৬ মাসের ব্যবধান। আমি ৬ মাসের বড়। সে ইউল্যাবে পড়তো। আমি আইডিয়াল স্কুলে। তার এক মামা পড়তো আমার সঙ্গে। প্রদীপ, ক্লাস সিক্সে আমার সঙ্গে পড়তো। 

 

আমরা আরামবাগে থাকতাম। প্রদীপের কাছে রাসেলের গল্প শুনতাম। বাবার কাছে তার গল্প শুনতাম। বাবাকে বলেছিলাম, যখন ৩২ নম্বরে যান আমাকে যেন নিয়ে যায়। ওর সঙ্গে পরিচিত হবো। বাবা বলেছিলেন নিয়ে যাবেন। লন্ডন থেকে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে এসে শুরু করলেন সাংবাদিকতা। সারাদিন রাত বাইরে থাকেন। আমাকে আর ৩২ নম্বরে নিয়ে যাওয়া হয় না। আমি প্রতীক্ষায় থাকি। আশায় থাকি একদিন দেখা হবে। আমরা বন্ধু হবো। 

 

হঠাৎ এলো ১৫ আগস্ট ১৯৭৫। আমরা আরামবাগে। আমি খুব সকালে উঠে রেডিও খুলতাম। সিলং থেকে ভোরে গান ভেসে আসতো। সেই গান শুনে দিন শুরু করতাম। হঠাৎ রেডিও টিউন করতেই একটা কর্কশ কণ্ঠ ভেসে এলো-’আমি মেজর ডালিম বলছি। শেখ মুজিব সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে। শেখ মুজিবকে উৎখাত করা হয়েছে...।’ 

 

একটু পর বলল, ‘শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। খন্দকার মুশতাক আহমদকে রাষ্ট্রপতি করা হয়েছে। সারাদেশে কারফিউ জারি করা হয়েছে।’ এবার আর পারলাম না। সকাল ৬টা বা সাড়ে ছ’টা। বাবা ঘুমাচ্ছেন। আমরা সকালে উনাকে বিরক্ত করি না। আমার অন্যান্য ভাইবোন কাজিনরা ঘুমাচ্ছে। মা নামাজ শেষে রান্নাঘরে গেছেন। 

 

বাবাকে ডাকলাম। বলল কি? আমি বললাম… রেডিওতে ঘোষণা করতেসে, বঙ্গবন্ধুকে মাইরা ফেলসে! কি বলিস? রেডিও কই? আমার কাছে আন! রেডিও কানের কাছে ধরলাম। ভলিউম যতটা পারা যায় বাড়ালাম। এক ব্যান্ডের ছোট পকেট রেডিও। তেমন শব্দ হয় না। আবার কানের কাছে ধরলাম। স্পষ্ট শোনা গেল ডালিমের ঘোষণা... ‘শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। মুশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতি। সব বাহিনীকে এ বিপ্লবী সরকারের আনুগত্য প্রকাশ করার আদেশ দেয়া হলো। অন্যথায় কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

 

বাবা লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠলেন। মাকে ডেকে বললেন জলদি চা দাও। আমাকে বাইরে যেতে হবে। বাসায় ছিলেন বাবার ম্যানেজার কাঞ্চন কাকা। বললেন কাঞ্চন উঠ। চল! মুজিব ভাইরে আর্মি মাইরা ফেলছে। জানি না বাকিদের কি অবস্থা। চল ৩২ নম্বর যাই।

 

কাঞ্চন কাকা রেডিও ঘোষণা শুনে বলল স্যার, কারফিউ দিসে। কেমনে যাবেন। বাবা বললেন আরে রাখ, পত্রিকার কার্ড আছে না! তুই না গেলে আমিই যাব। এখন চল বত্রিশ নম্বর। পরে অন্য কাজ। বলেই লাল হলুদ চেক হাফহাতা শার্ট এবং ঘিয়া রঙের প্যান্ট পরে বের হলেন। সারাদিন কোনও খবর নাই। গুজবে ভরে যাচ্ছে। সবাই বিবিসি, ভোয়া শুনছে। 

 

একটু পর বাংলাদেশ বেতার রেডিও বাংলাদেশ হয়ে গেল। ইসালামি গান আর বিপ্লবী গান বাজতে লাগলো। খানিক পরপর ডালিমের রেকর্ড করা ভাষণ। ১১টার দিকে খন্দকার মুশতাক ভাষণ দিল। সেনা, নৌ, বিমান, পুলিশ, বিডিআর বাহিনী প্রধানগণ আনুগত্য স্বীকার করে ভাষণ দিলেন। কর্ণেল ওসমানি সব বাহিনীকে ধৈর্য ধারণ এবং আনুগত্য প্রকাশের আহ্বান জানালেন। 

 

ঝাঁকে ঝাঁকে মন্ত্রীগণ নতুন করে শপথ নেয়ার জন্য শাহবাগ রেডিও স্টেশন ও বঙ্গভবনে লাইন লাগালেন। সন্ধ্যায় নতুন রাষ্ট্রপতি মুশতাক নতুন মন্ত্রিসভার শপথ পরিচালনা করলেন। রাত সাডে ১০টায় বাবা ফিরে এলেন। এর আগে আমরা ভাবলাম, হয়তো গ্রেফতার হয়েছেন অথবা আর্মি মেরে ফেলেছে। বাবাকে দেখে চমকে উঠলাম। 

 

মনে হলে প্রচন্ড ক্লান্ত শ্রান্ত এক মানুষ। এসে চা খেলেন টোস্ট বিস্কুট দিয়ে। চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় কান্না। এসে বললেন, কেউ বেঁচে নেই। ওরা রাসেলকেও মেরে ফেলেছে! বাবা ৩ দিন বাসা থেকে বের হলেন না। চা সিগারেট চলল। টেলিফোনে কার কার সঙ্গে কথা বললেন। ক’দিন পর মা’কে বললেন, লিলি, আমি লন্ডন চলে যাব। কিছুদিন পর তোমাকে আর স্বপনকে নিয়া যাব। এদেশে আর থাকব না।

 

রাসেল নেই। আছে তার স্মৃতি। ওর সাইকেল। ৩২ নম্বরের বাড়িতে। রাসেলের স্মৃতি হয়ে আছে লন্ডন থেকে আনা সেই সাইকেল। জং ধরছে, ভেপু নষ্ট, বেল বাজে না, টায়ার পাংচার। কেউ চালায় না। শুধু বঙ্গবন্ধু যাদুঘরের কেয়ারটেকার মুছে রাখে। 

 

আর আমি! আক্ষেপ নিয়ে বাঁচি, তার সঙ্গে দেখা হলো না। তবু রাসেল আমার বন্ধু। বেঁচে থাকলে আমার বয়সের হতো। আওয়ামী লীগের হাত ধরতো হয়তো, হয়তো বা না! বয়স তো ৫৬ হতো, আমারই মতো! 

 

ঘাতকেরা তাকেও ভয় পেয়েছিল। সে বেঁচে আছে আমাদের হৃদয়ে অনন্ত ভালোবাসায়। শুভ জন্মদিন প্রিয় রাসেল। প্রিয় না দেখা বন্ধু! অনেক আনন্দে থেকো ওপারে... বাবা,মা, ভাই, ভাবি, চাচা-চাচীদের সঙ্গে। আমরা ভ্যানগার্ড হয়ে বেঁচে আছি তোমার হত্যার প্রতিশোধ নিতে।

 

লেখক: শহিদুল হক ভুঁইয়া স্বপন (অতিরিক্ত সচিব, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়)