ঢাকা, ২২ নভেম্বর শুক্রবার, ২০২৪ || ৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
১৮৯৫

সকালবেলার রৌদ্রে!

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৮:২১ ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০  

কেমন হয় সকালবেলার রোদ? কোন সকালের রোদ? সূর্য তার সমস্ত ঐশ্বর্য নিয়ে পুড়িয়ে দেয়া গ্রীষ্মের সকালবেলার রোদ? দীর্ঘ বর্ষণের পর হঠাৎ আলোর ঝলকানি দেয়া সকালবেলা? পানির তল থেকে জেগে ওঠা নরম মাটির শরীরে লাগা আশ্বিনের সকালের রোদ; নাকি শীতের সকালবেলার রোদ? কোন সকাল আর কোন সকালবেলার রোদ? 

 

আচ্ছা, বিভূতিভূষণ যখন একা একা হেঁটে যেতেন তার সময়ের পথ ধরে, তিনি কি সকালবেলার রোদের সঙ্গে তখন কথা বলতেন? বলতেন! আর সকালবেলার রোদের সঙ্গে যদি তার কথাই না হবে তাহলে এমন ভাবনা সৃষ্টি করেন কী করে জীবনানন্দ দাশ? ‘মাছির গানের মতো অনেক অলস শব্দ হয় সকালবেলার রৌদ্রে: কুঁড়েমির আজিকে সময়।’ 

 

মনীষী, দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সকালবেলার রৌদ্র, রোদ্দুর- রোদের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন দীর্ঘ সময় ধরে। তিনি সকালের রোদের রং দেখতে পেয়েছিলেন, ঘ্রাণ পেয়েছিলেন, সেসব রোদের বর্ণনা আছে ‘ছিন্ন পত্রাবলী’র পাতায় পাতায়। 

 

এখনো পৃথিবীতে সকালবেলা আছে। সকালের রোদ আছে। সেই রোদটাকে চেনার, তার সঙ্গে কথা বলার একটু অবসর কেবল খুঁজে নিতে হয়। আমরা এটি খুঁজতে কখনো যাই বিক্রমপুরের ছাতিয়ানতলীতে; কখনো যাই নদীর ঘ্রাণমাখা গ্রাম ঝনকি আবার অরণ্যঘেরা গ্রাম হাটুরিয়াচালা। 

 

সকালবেলার রোদ কেমন হয় তা আমাদের চিনিয়ে দেয় লালমাটির ভাওয়াল গড়ের হাটুরিয়াচালার মকশ্ বিলের পাড়ে একলা দাঁড়িয়ে থাকা হিজলগাছটি। তার মাথায়, পাতার আড়ালে বসে সকালের রোদ গায়ে মেখে এ শেষ হেমন্তেও ডেকে ওঠে চিরবিরহী কণ্ঠে ঘুঘু পাখি। 

 

মানুষের গল্পকার শেখর ইমতিয়াজের গ্রাম হাটুরিয়াচালা। শহুরে কবি ইরাজ আহমেদকে ডাক পাঠায় হাটুরিয়াচালা। সঙ্গী হই আমি। আমরা সকালবেলার রোদ দেখব বলে, ঝিমধরা দুপুর আর শিশিরের শব্দের মতোন সন্ধ্যানামা দেখবো বলে ছুটে যাই হাটুরিয়াচালা। 

 

সেখানে লাউয়ের জাংলার নিচে, কচি লাউপাতার ছায়ায় নেমে বেড়ায় ঝুট শালিক। তারা আমাদের চিনিয়ে দেয় সকালের রোদ। অনেক দূরে বিলের জলের ওপর মাছধরার নৌকা, পানিতে ঝিলিক দেয়া আলো আমাদের বলে দেয় সকালবেলার রোদ কেমন হয়। 

 

এরপর রোদের রং ডানায় মেখে, রোদের ঘ্রাণ নিয়ে উড়ে যায় চিল। আমাদেরও তো ফিরে আসতে হয় নাগরিক এসব জঞ্জালে। কিন্তু সেই সকালবেলার রোদ থেকে যায় অন্য কোথাও! গ্রামে গ্রামে মোড়া এদেশে আমিও গ্রামের ছেলে। ঝনকি আমার গ্রামের নাম। 

 

যখন থেকে বোধ, তখন থেকেই রোদের সঙ্গে মাখামাখি সখ্য আমার। শীতবেলার সকালের রোদ সত্যি সত্যি সোনার চেয়ে দামি ছিল আমাদের কৈশোরে। সুকান্তের কবিতা আমাদের ছেলেবেলায় বুঝিয়ে দিয়েছে শীতের সূর্য আর রোদ কতটা প্রয়োজনীয়! 

 

আমরা খেজুরপাতায় বোনা পাটিতে সকালবেলার রোদে পিঠ দিয়ে বসতাম। হাতে থাকতো খেজুর রসের বাটি আর সাজিতে মুড়ি। কেউ যদি আমাদের সেই রোদ আটকাতো আমরা বলতাম, ‘ওই ছেওয়া ছাড়’; মানে তোর, তোমার বা আপনার ছায়াটা সরিয়ে দিন, রোদটা আটকাবেন না। 

 

আমরা মাঝে মাঝে এমন সকালবেলার রোদ দেখার জন্য তো ছুটে যাই পাহাড়ে, সমুদ্রতীরে, অরণ্যে। প্রশ্ন হলো তার দেখা কী পাই? আমাদের কথা কি হয় সেই রোদের সঙ্গে? হয়! হয়তো হয়, হয়তো হয় না। সকালবেলার খোলা জানালা। পূব দিক থেকে ঘরে ঢুকে আলো। উত্তর দিক দিয়ে ঢুকে শীতল বাতাস। ধুলিরও অবাধ উড়ে আসা। 

 

ঠিক তখনি বেজে উঠেন রবীন্দ্রনাথ। ‘আকাশ ভরা সূর্য-তারা’ গেয়ে উঠেন জর্জ বিশ্বাস, মানে আমাগো ব্রাত্যজন গায়ক দেবব্রত বিশ্বাস। এমন নিজস্ব ঢং তার গলায়। অথবা গেয়ে উঠলেন, ‘ও দয়াল, বিচার করো..’ অখিলবন্ধু ঘোষ। তখন সকালবেলাটা আর সকালবেলার রোদকে সত্যি সত্যি অন্যরকম মনে হয়, আপন আপন। 

 

এ রোদে ভেসে ভেসে ধ্রুপদী বাংলা গান নিয়ে চলে আসেন জ্ঞানেন্দ্র প্রসাদ গোস্বামী, আহলাদী গলায় রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে আসেন রীতা ঘটক। আর সকালের রোদের সঙ্গে প্রতিদিনই আসেন জীবনানন্দ, আবুল হাসান, জয় গোস্বামী এবং ভাস্কর চক্রবর্তী-শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা’র কবি। আর আসে পাখিদের বাগানবাড়ি!

লেখক: ফজলুর রহমান

সিনিয়র সাংবাদিক

ফিচার বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর