ঢাকা, ২৪ নভেম্বর রোববার, ২০২৪ || ১০ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
৬৪২

সুপার ফিশ মলার মস্ত বড় গুণ

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২৩:০২ ২৯ জুলাই ২০২২  

দেশে প্রাণিজ আমিষের ৬০ ভাগ আসে মাছ থেকে। যা বর্ষা মৌসুমে শতকরা ৭০-৮০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। তিন দশক ধরে মাছের উৎপাদন বেড়েছে ৬ গুণ আর এক দশকে দেশীয় ছোট মাছের উৎপাদন প্রায় ২ দশমিক ৫ গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার টন। বাংলাদেশে ১৪৩ প্রজাতির ছোট মাছ রয়েছে যার মধ্যে অন্যতম মলা মাছ।

 

মলা দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ। এর বৈজ্ঞানিক নাম অসনষুঢ়যধৎুহমড়ফড়হ সড়ষধ। এ মাছ বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, নেপাল ও মিয়ানমার পর্যন্ত পাওয়া যায়। যা মলা, ময়া, মৌড়ালী, মসী, মলা কার্পলেট প্রভৃতি নামে সমধিক পরিচিত। মলা সাধারণত পুকুর, খাল-বিল, নালা ও ধীরে প্রবাহমান পানিতে এবং ধানক্ষেতে পাওয়া যায়।

 

এদের জীবনকাল ১৩-১৫ মাসের হয়। সর্বোচ্চ ২০ সে.মি. পর্যন্ত দৈর্ঘ্যরে হতে পারে। মলা পানির ওপরের স্তরে থাকে এবং খাবার হিসাবে প্রাকৃতিক খাদ্য যেমন- উদ্ভিজ কণা ও প্রাণিজ কণা গ্রহণ করে। মলা মাত্র তিন মাস বয়সে পরিপক্বতা অর্জন করে এবং বছরে সর্বোচ্চ পাঁচবার পর্যন্ত ডিম দিতে পারে। প্রতিটি উপযুক্ত স্ত্রী মলা প্রতিবারে এক থেকে সাড়ে ছয় হাজার ডিম দিয়ে থাকে।

 

ছোট মাছ হিসাবে মলার গুরুত্ব চাউর হওয়ার পর থেকেই এর সংরক্ষণ, চাষ ও হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদন কৌশল নিয়ে ব্যাপক আকারে গবেষণা শুরু হয়। বাংলাদেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান যেমনÑবাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই), সম্প্রসারণ প্রতিষ্ঠান (মৎস্য অধিদপ্তর) ও বিভিন্ন এনজিও, ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসে।

 

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে মুক্ত জলাশয় ও সংযোগ পুকুরের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। ফলে মলার মতো স্ব-নিয়োগকৃত প্রজাতিগুলো (যেসব মাছ আবাসস্থলেই স্বেচ্ছাধীনভাবে পোনা ছাড়তে পারে) শুধু পুকুরকেন্দ্রিক পোনা উৎপাদন করে কাক্সিক্ষত পোনার চাহিদা পূরণ সম্ভব নয়। তাই হ্যাচারি থেকে মানসম্মত, নিরবচ্ছিন্ন পোনা সরবরাহের ব্যবস্থা থাকা জরুরি।

 

২০১৮ সালে বাংলাদেশে প্রথম ব্রহ্মপুত্র হ্যাচারি মলার কৃত্রিম প্রজননে সফলতা অর্জন করে। ২০২০ সালে তাতে ব্যাপক সফলতা আসে। ওই সফলতার স্বীকৃতিস্বরূপ ব্রহ্মপুত্র হ্যাচারির স্বত্বাধিকারী এ কে এম নুরুল হক ‘জাতীয় মৎস্য পদক-২০২২’ স্বর্ণপদক লাভ করেন। বিগত ২০ বছরে গবেষকদের অবিরত গবেষণা, প্রদর্শনী খামার, প্রচারণা ও অদম্য উদ্যোগের ফলে এ ধরনের সফলতা অর্জিত হয়েছে।

 

প্রতি কেজি মলার রেণু ১২ হাজার টাকা হারে বিক্রি করা হয়। মলার রেণু পরিবহন নিয়ে ওয়ার্ল্ডফিশ বাংলাদেশ ব্যাপকভিত্তিক গবেষণা ও সম্প্রসারণের কাজ করে যাচ্ছে। দেশের উত্তরাঞ্চলসহ অনেক জায়গায় পুকুরে মলা চাষ হচ্ছে। বাংলাদেশের ৪০ লাখ পুকুরে বছরে আনুমানিক ১০ কেজি করে মলা মাছ উৎপাদন করা গেলে ৫ বছরের কম বয়সি ৬০ লাখ শিশুর পুষ্টি চাহিদা মেটানো সম্ভব।

 

ইতোমধ্যে পুষ্টিমান সংবেদনশীল মাছ চাষ প্রক্রিয়ায় ছোট মাছ চাষে চাষিরা আগ্রহী হয়ে উঠছেন। মলার একক চাষের তুলনায় সাথি ফসল হিসাবে অন্য মাছের চাষ বেশ লাভজনক ও সহজসাধ্য হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে।
ইতোমধ্যে মলা-কার্প, মলা-চিংড়ি, মলা-পাঙ্গাশ, মলা-পাবদা, মলা-গুলশা চাষ ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে।
ভবিষ্যতে আইপিআরএস, আরএএস ও অন্যান্য নিবিড় মাছ চাষের ক্ষেত্রে পুকুরের পানি, প্রাকৃতিকভাবে শোধন করার জন্য মলা মাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

 

মৌসুমি পুকুর যেখানে তিন থেকে ছয় মাস পানি থাকবে এমন পুকুর মলা চাষের জন্য যথেষ্ট উপযোগী।
বিনা খাবারে পুষ্টি সমৃদ্ধ মলা উৎপাদন জলবায়ু সহনশীল এবং কম বা শূন্য কার্বন নিঃসরণ প্রযুক্তি হিসাবে বিবেচিত হতে পারে।

 

মলা চাষের জন্য পানির গুণাগুণ, পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মলার ভবিষ্যৎ ঝুঁকিতে পড়তে পারে। এ জন্য পর্যাপ্ত বরুড স্টক, সিলেকটিভ ব্রিডিং কার্যক্রমসহ ধীরে বৃদ্ধি পাওয়া পুরুষ মলাকে এড়িয়ে শুধু স্ত্রী মলা চাষের গবেষণা জোরদার করতে হবে।

 

প্রতিটি মলা গড়ে ৩-৫ গ্রাম ওজনের পেতে ৩-৪ মাস পর পর মলা বাজারজাত করা যায়। আর আংশিক আহরণে নারীরাও দৈনিক ২-৩ বার ঝাঁকি জাল দিয়ে গৃহস্থালির রান্নার জন্য প্রয়োজনীয় মলা মাছ সংগ্রহ করতে পারে। বয়স্ক মলা ধরা ও অতিরিক্ত মলার পোনার চাপ কমাতে ‘আংশিক আহরণ’ গুরুত্বপূর্ণ। আংশিক আহরণ পরিবারের নারীদের মাছ চাষের কার্যক্রমে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করে।

 

ছোট মাছে অনেক পুষ্টিগুণ; যেমন এতে আয়রন, প্রোটিন, ফসফরাস, ভিটামিন-এ, ভিটামিন বি-১২, ইপিএ, ডিএইচএ, লাইসিন, মিথিয়োনিন থাকে। ছোট ও বড় মাছের তুলনামূলক পুষ্টিগুণ বিবেচনা করলে ১০০ গ্রাম রুইয়ের তুলনায় সমপরিমাণ মলার মধ্যে ৫ গুণ আয়রন, ৩ গুণ জিংক, ১৬ গুণ ক্যালসিয়াম, ১৯২ গুণ ভিটামিন এ ও ১.৫ গুণ ভিটামিন বি ১২ বেশি আছে।

 

ছোট মাছের ভিটামিন শিশুর রাতকানা রোগ প্রতিরোধে কার্যকর। মাত্র ২০ গ্রামের কম মলা মাছ প্রতিদিন খেলে একজন শিশু তার প্রয়োজনীয় ভিটামিন এ-এর অভাব মিটাতে সক্ষম। বাংলাদেশের প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষ বিশেষ করে নারী ও শিশুরা ভিটামিন এ, আয়রন, ক্যালসিয়াম ও জিংকের অভাবে ভোগে। এসব ভিটামিন ও খনিজ পদার্থকে ‘মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট’ বা ‘অনুপুষ্টি’ বলে। যা ভালো স্বাস্থ্যের জন্য অতি জরুরি।

 

একটি শিশু সময়মতো প্রয়োজনীয় অনুপুষ্টি না পেলে তার মস্তিষ্কের বৃদ্ধি, বুদ্ধিমত্তা, বিকাশ এমনকি পরবর্তী জীবনে স্কুলে ভালো ফলাফল করা ব্যাহত হতে পারে। শিশুদের অপুষ্টিজনিত ক্ষতি পরবর্তী জীবনে পূরণ করা প্রায় অসম্ভব। অনুপুষ্টি সমৃদ্ধ ছোট মাছ যেমন-মলা, ঢেলা, দাঁড়কিনাতে প্রচুর পরিমাণে অনুপুষ্টি থাকে। যা মানুষের পুষ্টি চাহিদা মেটাতে সক্ষম।

 

ছোট মাছ সাধারণত মাথা ও হাড়সহ খাওয়া হয়। যা সহজপাচ্য এবং পুষ্টিগুলো সহজেই শরীর শোষণ করে নিতে পারে। এমনকি ছোট মাছসহ তরকারি রান্না করলে তরকারির অনুপুষ্টিগুলোর শোষণও বেড়ে যায়। মাতৃগর্ভে শিশুর এক বছর ও মাতৃদুগ্ধ পানের (ল্যাকটেটিং পিরিয়ড) দুবছর মিলিয়ে মোট তিন বছর বা ‘সংকটময় ১০০০ দিন’ পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা বেশি জরুরি। কারণ এ সময়ই শিশুর বৃদ্ধি ও শরীর গঠনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়।

 

মাতৃত্বকালীন মায়েদের উচিত ছোট মাছ গ্রহণ করা। কারণ মায়ের পুষ্টির ওপরেই নির্ভর করে অনাগত সন্তানের পুষ্টি। আর শিশুর বয়স যখন ৬ মাস তখন থেকে অনুপুষ্টি সমৃদ্ধ ছোট মাছ খাওয়াতে হবে। চাইলেই একজন দরিদ্র মা অল্প টাকায় ১০০-২০০ গ্রাম ছোট মাছ কিনতে পারেন এবং শিশুর খাদ্য তালিকায় ন্যূনতম ২০ গ্রাম মাছ দৈনিক ভিত্তিতে দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে মাছের পাউডার তৈরি করে খিচুড়ির সঙ্গে বা অন্য শিশু খাদ্যের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে।

 

বাংলাদেশে উদ্ভাবিত মলা মাছের চাষ প্রযুক্তি পরে এশিয়ার ভারত, নেপাল, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া এবং আফ্রিকার জাম্বিয়া, মালাউ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। ১৯৯০ দশকে বাংলাদেশে অধ্যাপক ড. আবদুল ওহাবের সঙ্গে মলাসহ বাংলাদেশি ছোট জাতের মাছ নিয়ে গবেষণা করেন ড. শকুন্তলা থিলস্টেড। পরে ড. আব্দুল ওহাব মলা নিয়ে গবেষণা করেন। এ মাছকে জনপ্রিয় করার কাজে নিয়েজিত থাকেন।

 

বিশ্ব দরবারে মলার বড় স্বীকৃতি মিলেছে ড. শকুন্তলার হাত ধরে যিনি ২০২১ সালের ১১ মে খাদ্য ও কৃষি ক্ষেত্রে নোবেলখ্যাত ‘বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার-২০২১’ লাভ করেন ।টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় প্রকৃতিনির্ভর সমাধান, পুষ্টি সংবেদনশীল চাষ পদ্ধতি, কম কার্বন নিঃসরণ, কম পানি খরচ, কম জ্বালানি খরচ করে উৎপাদন ব্যবস্থায় জোর দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ‘সুপার ফিশ’খ্যাত মলা মাছ হতে পারে একটি লাগসই প্রযুক্তি।