ঢাকা, ২৪ নভেম্বর রোববার, ২০২৪ || ৯ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
৩৮৮

হঠাৎ মুরগি-ডিমের দাম এত বাড়ল কেন?

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ০০:৫৪ ১৫ আগস্ট ২০২২  

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপক প্রভাব পড়েছে দেশের কাঁচাবাজারে। বেড়ে গেছে সবধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। স্বাভাবিকভাবেই পোল্ট্রি সামগ্রীর দর বেড়েছে। গত কয়েকদিন ধরে এ নিয়ে চলছে বিস্তর আলোচনা। বিশেষ করে মুরগির মাংস ও ডিমের দাম বাড়ায় খরচ সামলাতে কাটছাঁট করতে হচ্ছে মধ্য ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোকে।

 

ঢাকার কালাচাঁদপুর এলাকার বাসিন্দা মিতালি ঘাগরা। তার ৫ সদস্যের পরিবার চলে একজনের উপার্জনে। আগে সপ্তাহে অন্তত তিনদিন মুরগি এবং দুই দিন মাছ রান্না হতো। এখন পণ্যগুলো কেনা কমিয়ে সবজির দিকে ঝুঁকছেন তিনি। ডিম খাওয়ার ক্ষেত্রেও লাগাম টানতে হয়েছে তাকে। ফলে আগের মতো ডিম, মাছ, মাংস পাতে ওঠে না এ পরিবারটির।

 

মিতালি ঘাগরা বলেন, আগে সপ্তাহে আমার ২ ডজন ডিম লাগতো। এখন দাম বেড়ে গেছে। ফলে হালি ধরে কিনি। মুরগি আগে সপ্তাহে দুই তিনদিন খেতাম। বর্তমানে একদিন খাই। দাম বেড়ে গেলে কী করব? আয় রোজগার তো বাড়েনি।

 

বাজারদর নির্ধারণকারী সরকারি সংস্থার (টিসিবি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২ আগস্ট প্রতি কেজি ব্রয়লারের দাম ছিল ১৪৫ টাকা। এখন যার মূল্য ১৮৫ টাকা। অর্থাৎ গত ১২ দিনে এ মুরগির দর বেড়েছে ৪০ টাকার মতো। একই হারে বেড়েছে সোনালির দাম। 

 

কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এর চেয়ে ১০ থেকে ২৫ টাকা বেশি দর হাঁকছেন বিক্রেতারা। সেই সঙ্গে ডিমের দামও সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। এখন এক ডজন বিক্রি হচ্ছে ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকায়।

 

টিসিবির হিসাবে, গত সপ্তাহেও ডজন প্রতি ডিম ছিল ১২০ টাকার মতো। অর্থাৎ এক লাফে ৩০ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এ হিসাবে প্রতিটি ডিমের দাম পড়ছে ১৩ টাকার বেশি। মাছের বাজারেও আগুন। ফলে বাজারে আগের চেয়ে বেচাকেনা কমে গেছে বলে জানান দোকানিরা।

 

কালাচাঁদপুর কাঁচাবাজারের মুরগি ব্যবসায়ী রবিন ইসলাম গত সপ্তাহে দিনে ৫০টি মুরগি বিক্রি করতেন। কিন্তু দাম বাড়ার পর ৩০টিও বেচতে পারেন না তিনি।

 

মাছ ব্যবসায়ী শামীম হোসেন জানান, মূল্য বেড়ে যাওয়ায় গত সপ্তাহের চেয়ে এবার তার বিক্রি প্রায় অর্ধেক কমে গেছে। বেলা গড়িয়ে গেলেও বেশিরভাগ মাছ বিক্রি করতে পারেননি তিনি।

 

এ পরিস্থিতির পেছনে মধ্যসত্ত্বভোগী ও পরিবহন সংশ্লিষ্টদের দুষছেন উৎপাদকরা। পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট জামান সেন্টুর অভিযোগ, পরিবহন সিন্ডিকেট মালপত্র আনা নেয়া বাবদ প্রায় দ্বিগুণ ভাড়া হাঁকছে, যা দেখার কেউ নেই।

 

তিনি বলেন, আগে যেখানে ১৭/১৮ হাজার টাকায় এক গাড়ি নেয়া যেত। সেই গাড়ির ভাড়া চায় ২৬/২৭ হাজার টাকা। তাদের মনমতো সব হচ্ছে। এখানে আমাদের কিছু বলার নেই। প্রশাসনও কোনো ব্যবস্থা নেয় না।

 

পরিবহন খরচ বাড়ার পাশাপাশি ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে মুরগির ফিডের দামও বেড়েছে। এতে কাঁচামাল না আসায় প্রভাব পড়েছে ডিম ও মুরগির দামে। আবার বিদ্যুতের দাম বাড়ায় মুরগির খাবার প্রসেস করার খরচও বেড়েছে।

 

জামান সেন্টু বলেন, ৬টা মুরগির জন্য দিনে ১ কেজি ফিড লাগে। এর দাম আগে ছিল ৫০ টাকা। ওই ৬টা মুরগি থেকে ৬টা ডিম আমি ৬০ টাকায় বিক্রি করলে দুই দিকেই লাভ থাকতো। এখন একই ফিডের মূল্য হয়েছে কেজিতে ৭৫ টাকা। আবার বিদ্যুতের ইউনিট দরও ১৭ টাকা হয় মাঝে মাঝে। তাহলে এর প্রভাব তো ডিমে, মাংসে পড়বেই।

 

উৎপাদকরা এসব বাড়তি খরচের বোঝা বহন করেন। তবে মধ্যসত্ত্বভোগীদের পাল্লায় সেই দাম পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ তার। জামান সেন্টুর মতে, ভোক্তা পর্যায়ে যে হারে দাম বেড়েছে, সেটার সঙ্গে তাদের দামের বিস্তর ফারাক রয়েছে।

 

এভাবে প্রতিনিয়ত উৎপাদন খরচ বাড়তে থাকায় প্রান্তিক খামারিরা ক্রমেই ব্যবসা থেকে সরে যাচ্ছে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রতিদিন ৫০ থেকে ৭০ গ্রাম প্রোটিনের প্রয়োজন হয়। অল্প দামে মুরগির মাংস ও ডিম থেকে তা পাওয়া যেতো বলে জানিয়েছেন পুষ্টিবিদরা। 

 

তবে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষের প্রোটিন গ্রহণের ওপরে সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। কারণ, টানাপোড়েনে থাকা পরিবারগুলো ব্যয় সামলাতে সব আগে প্রোটিনজাত খাবার কেনা কমিয়ে দেন।

 

সার্বিক পুষ্টি চাহিদার এ ঘাটতি দীর্ঘমেয়াদে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ সায়মা হক বিদিশা। তিনি বলেন, খাবারের মূল্য বৃদ্ধি পেলে মানুষ ক্যালোরি ইনটেক কমিয়ে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করে। এতে পুষ্টির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। দীর্ঘমেয়াদে যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সেটায় পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।

 

চলতি বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য-বিজ্ঞান ইন্সটিটিউট এবং স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইন্সটিটিউটের যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ৪১ শতাংশ পরিবারের স্বাস্থ্যকর খাবার কেনার সামর্থ্য নেই। দারিদ্রসীমার নিচে বা দারিদ্রসীমার ঠিক ওপরে থাকা পরিবারগুলো স্বাস্থ্যকর খাবার কিনতে পারছে না।