ঢাকা, ১৯ এপ্রিল শনিবার, ২০২৫ || ৬ বৈশাখ ১৪৩২
good-food
৪৫৭

ব্ল্যাক ফাঙ্গাস কতটা ভয়ংকর? লক্ষণ, কারণ ও প্রতিকার

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ০০:৫৯ ২৭ মে ২০২১  

ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা কালো ছত্রাককে মহামারি ঘোষণা করেছে ভারত। প্রতিবেশী হওয়াতে বাংলাদেশেও এ নিয়ে করোনার মধ্যে নতুন করে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর ইতোমধ্যে জানিয়েছে, ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের চিকিৎসা এবং ব্যবস্থাপনা কেমন হবে। তা নিয়ে নির্দিষ্ট গাইডলাইন দেওয়া হবে।


স্বাস্থ্য অধিদফতর জানাচ্ছে, বিষয়টি নিয়ে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি সতর্ক আছে। তাছাড়া এ সংক্রান্ত চিকিৎসা সম্পর্কে অধিদফতরের পক্ষ থেকে জেলাগুলোতে সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছে।


আনুষ্ঠানিকভাবে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের চিকিৎসা কেমন হবে, ব্যবস্থাপনা কেমন হবে, সেই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন অধিদফতর দেবে বলেও জানানো হয়।


ভারতে 'ব্ল্যাক ফাঙ্গাস' ছড়িয়েছে ব্যাপকভাবে। সেখানে এখন পর্যন্ত আট হাজার ৮০০ জন এতে সংক্রমিত হয়েছেন। সংক্রমিত প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ মারা যাচ্ছে। আর যারা বেঁচে যাচ্ছেন, তাদের মধ্যে একটি অংশের চোখ অপসারণ করতে হচ্ছে। 

ভারতের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার ১২ থেকে ১৮ দিনের মধ্যে এর সংক্রমণ দেখা দেয়। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর) ডায়াবেটিসে আক্রান্ত কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসকদের ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণ শনাক্তে প্রাথমিক লক্ষণগুলোর প্রতি সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে।

কালো ছত্রাকের সংক্রমণকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় মিউকরমাইকোসিস। এসব ছত্রাক পরিবেশে; বিশেষ করে মাটি পঁচে যাওয়া জৈব পদার্থ যেমন: পঁচা ফলমূল, পাতা বা পশুর বিষ্ঠায় ছড়িয়ে থাকে। এসব ছত্রাককে ল্যাবরেটরির কৃত্রিম মিডিয়াতে যখন বৃদ্ধি করা হয়, এদের রং হয় গাঢ় বাদামি বা কালো। তাই এদের ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা কালো ছত্রাক বলা হয়।


মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না
চিকিৎসকরা বলছেন, ব্ল্যাক ফাঙ্গাস যে কেবল করোনার কারণেই হবে সেটা নয়। ব্ল্যাক ফাঙ্গাস 'হসপিটাল অ্যাকোয়ার্ড' ইনফেকশন হতে পারে মন্তব্য করে তারা বলছেন, এটা সহজে মানুষকে সংক্রমণ করে না। তবে ঝুঁকিপূর্ণ রোগী হলে তখন এটা 'ডেডলি' হয়। তাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় রোগীদের পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। দরকার না হলে স্টেরয়েড না দেওয়া ও অক্সিজেন না দেওয়ার মতো কাজগুলো করতে হবে।


তবে আশার কথা হলো, চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন ব্ল্যাক ফাঙ্গাস 'পার্সন টু পার্সন' অর্থাৎ মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না।


লক্ষণ
ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের লক্ষণ সম্পর্কে তারা জানান, নাক বন্ধ হয়ে যায়। নাকে ঘা হয়ে রক্তক্ষরণ হয়। চোখে অস্পষ্টতা বা ঝাপসা দেখা যায়। এ থেকে চোখে রক্তক্ষরণ হয়। ফুসফুসের সংক্রমণ ভালো হলেও অক্সিজেন ধরে রাখার সক্ষমতা কমে যায়। শ্বাসকষ্ট হয়। মুখের একদিকে ফুলে যায়। নাক অথবা দাঁতের মাড়ি কালো হয়ে যায়। কফের সঙ্গে রক্ত যায়। রক্ত বমি হয়। নতুন করে নিউমোনিয়ার সংক্রমণ হয়। মাথা, দাঁতে, ঘাড়ে ব্যথা হয়। ত্বকে কালো দাগ দেখা দেয়।


কারা ঝুঁকিতে
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সংক্রমণের সঙ্গে ডায়াবেটিসের সম্পর্ক রয়েছে। আবার করোনা চিকিৎসায় ব্যবহার হওয়া ডেক্সামেথাসনের মতো স্টেরয়েড ডায়াবেটিসও বাড়িয়ে দেয়। তাই করোনায় আক্রান্ত ডায়াবেটিস রোগীদের চিকিৎসার বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা খুব জরুরি।


চিকিৎসকরা বলছেন, স্টেরয়েড করোনা আক্রান্ত রোগীদের জীবন বাঁচাতে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এর খারাপ দিক বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে এটা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে ফেলে। আর আগে থেকেই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, এমন মানুষদের যদি এ ওষুধ দেওয়া হয়; তাহলে তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আরও কমে যায়। আর এটা হলেই সেসব মানুষের ক্ষেত্রে 'সেকেন্ডারি ইনফেকশন' হচ্ছে।


উদাহরণ দিয়ে তারা বলছেন, কোনও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর যদি করোনা হয় এবং তার অক্সিজেন প্রয়োজন হলে; তাকে দীর্ঘমেয়াদে স্টেরয়েড দেওয়া হয়। তখন আগে থেকেই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকা রোগীর সেই সক্ষমতা আরও কমে যাবে। 


স্টেরয়েড ব্যবহারে সংক্রমণ ঝুঁকি
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন ও ইনফেকশাস বিভাগের ডা. ফরহাদ উদ্দিন হাছান চৌধুরী মারুফ বলেন, 'সব করোনা আক্রান্ত রোগীর ব্ল্যাক ফাঙ্গাস হচ্ছে না। কিন্তু যারা আগে থেকেই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এবং দীর্ঘমেয়াদি স্টেরয়েড দেওয়া হয়েছে। তাদের ক্ষেত্রে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস হচ্ছে।' 


যদিও বাংলাদেশে এখনও ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের রোগী পাননি বলে তিনি জানান। এর কারণ হিসেবে চিকিৎসকরা বলছেন, ভারতে অক্সিজেনের স্বল্পতার কারণে রোগীদের বাঁচানোর জন্য স্টেরয়েডের ব্যবহার বেশি হয়েছে। এ কারণে সেখানে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের এরকম প্রার্দুভাব দেখা গেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এখন পর্যাপ্ত অক্সিজেন রয়েছে। রোগীদের স্টেরয়েড দেওয়া হচ্ছে কম। দেশে রোগীদের দীর্ঘমেয়াদি স্টেরয়েড দেওয়াও হচ্ছে না।


তবে যেহেতু ভারতে এটা কোথাও কোথাও মহামারি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তাই এ দেশেও বিষয়টি নিয়ে আরও বেশি মনোযোগী হতে হবে বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। যদিও ভারতে যেভাবে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে, সেরকম পৃথিবীর অন্য কোথাও হওয়ার সম্ভাবনা কম।


ডাক্তাররা বলছেন, রোগীরা চিকিৎসাধীন থাকার সময়েই চিকিৎসকদের লক্ষণগুলো নিয়ে মনোযোগী হতে হবে। কোনও লক্ষণ দেখা দিচ্ছে কিনা সেই বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। চিকিৎসকরা এর লক্ষণ জানবে এবং কখন ব্ল্যাক ফাঙ্গাস হিসেবে সাসপেক্ট করবে সেটা জানতে হবে।


অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, অর্গান ট্রান্সপ্ল্যান্ট করেছেন, করোনা থেকে সুস্থ হওয়া রোগী যারা স্টেরয়েড নিয়েছেন কিংবা অক্সিজেন নিতে হয়েছে, আইসিইউতে ছিলেন অথবা ভেন্টিলেটরে যেতে হয়েছিল, তারা ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হতে পারেন।


'স্টিল ইট ইজ এ রেয়ার ইভেন্ট' মন্তব্য করে চিকিৎসকরা বলছেন, ব্ল্যাক ফাঙ্গাস কেন হয় তা জানার জন্য অনেক গবেষণা দরকার।

পরিচ্ছন্নতা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখবে
যেসব রোগীরা আগে থেকেই নানা অসুখে আক্রান্ত থাকার কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেওয়া ওষুধ খাচ্ছেন এবং যাদের ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের কোনও লক্ষণ দেখা দিচ্ছে, সেসব রোগীদের ক্ষেত্রে এ বিষয়ে বেশি সতর্কতা নিতে হবে বলে জানান ডা. ফরহাদ হাছান চৌধুরী মারুফ। 


তিনি বলেন, 'লক্ষণ দেখা মাত্র সেই অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হবে। মনে রাখতে হবে "আর্লি আইডেন্টিফাই" করা গেলে রোগীর জীবন বাঁচবে।


চিকিৎসকরা জানান, যদি নোংরা পরিবেশে যেতে হয়; তাহলে জুতো পরে যেতে হবে। ফুল স্লিভ পোশাক এবং বাগানে কাজ করার সময় গ্লাভস পরতে হবে। প্রতিদিনের ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা ব্ল্যাক ফাঙ্গাস প্রতিরোধে ভূমিকা রাখবে।


তবে অনেকেই ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের কথা শুনে অ্যান্টি ফাঙ্গাল ওষুধ খাচ্ছেন জানিয়ে চিকিৎসকরা বলছেন, এ ওষুধের ইটসেলফ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। সুতরাং চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনও ওষুধ না খাওয়ার পরামর্শ তাদের।


কাতারের ক্লিনিকাল মাইক্রোবায়োলোজিস্ট ও ওয়েল কর্নেল মেডিক্যাল কলেজের ল্যাবরেটরি মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ রুবায়েত হাসান বলেন, 'পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব, হাসপাতালে ব্যবহার্য সামগ্রী যেমন: ব্যান্ডেজ, মাস্ক অপরিষ্কার, এসি বা এয়ার ফিল্ট্রেশন সিস্টেম, কনস্ট্রাকশনের প্রক্রিয়া থেকে মূলত কালো ছত্রাক ছড়ায়। 


তবে এটা নিরাময়যোগ্য মন্তব্য করে তিনি বলেন, 'যত দ্রুত রোগ শনাক্ত করা যায় ততই মঙ্গল। 

দেশে এ নিয়ে এখন পর্যন্ত বড় কোনও সমস্যা হয়নি জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, 'পৃথিবীজুড়ে করোনা হলেও ব্ল্যাক ফাঙ্গাস অন্য কোথায় হয়নি, কেবল ভারত ছাড়া।'


এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, 'ভারতে অক্সিজেনের সমস্যা ছিল, যে কারণে সেখানে স্টেরয়েড "আনইউজ্যুয়াল" করা হয়েছে। সেখানে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীও বেশি ছিল।'


আমাদের এখানে এখন পর্যন্ত কোনও কেস রিপোর্ট হয়নি মন্তব্য করে অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেন, 'একে প্রতিরোধ করার অন্যতম উপায় অনেক বেশি স্টেরয়েড ব্যবহার না করা। ঠিকমতো অক্সিজেন ব্যবহার করা। সাধারণ মানুষের জন্য ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ এবং চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া স্টেরয়েড না খাওয়া।'
 

করোনাভাইরাস বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর