ঢাকা, ০১ ফেব্রুয়ারি শনিবার, ২০২৫ || ১৯ মাঘ ১৪৩১
good-food
২৩

অনুষ্ঠানে যেতে কেন বারবার বাধার মুখে পড়ছেন অভিনেত্রীরা?

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২২:০৪ ৩১ জানুয়ারি ২০২৫  

দেশের জনপ্রিয় নির্মাতা আশফাক নিপুন বলেছেন, নারী অভিনেতাদের দিয়ে শো-রুম উদ্বোধন করতে না দেয়া এবং নারী ফুটবল দলকে খেলতে না দেয়া পুরোপুরি রাজনৈতিক একটি বিষয়। যদি কেউ মনে করেন, এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা তাহলে ভুল। নারীদের বিকাশ হতে না দেয়া রাজনীতি বহু বছর ধরে চলে আসছে।

 

সম্প্রতি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে বাধার মুখোমুখি হচ্ছেন দেশের বিনোদন অঙ্গনের তারকারা। অভিনয়ের বাইরে তারকাদের নানা ধরনের কর্মকাণ্ডে বাধা পাওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। মূলত 'তৌহিদী জনতা' ও 'ধর্মপ্রাণ মুসুল্লি'র ব্যানারে বাধা দেয়া হচ্ছে তাদের। যেসব অভিযোগ পাওয়া গেছে বেশিরভাগই নারী শিল্পীদের নিয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠান বাধা দেয়ার ঘটনার। কোনো পুরুষ শিল্পীর অনুষ্ঠান বন্ধ বা বাধা দেয়ার খবর পাওয়া যায়নি।

 

এ ধরনের তৎপরতা নিয়ে শিল্পীদের পক্ষ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিবাদ পাওয়া যাচ্ছে, সাংগঠনিকভাবে এখনও তেমন জোরালো অবস্থান চোখে পড়েনি। বাধার মুখে পড়েছেন এমন শিল্পীরাও এ বিষয়ে সংবাদমাধ্যমে খোলামেলা কথা বলছেন না। তবে যারা কথা বলছেন তাদের দাবি, এসব হামলা বা বাধার ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের পরিচয় খুঁজে বের করা উচিত এবং এ ধরনের ঘটনা রাষ্ট্রীয়ভাবেই প্রতিহত করা উচিত।

 

বাধার ঘটনা যত

তারকারা মূলত নিয়মিত অভিনয়ের বাইরে বিভিন্ন পণ্যর শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কাজ করে থাকেন। এছাড়া বিভিন্ন পণ্যের শো রুম উদ্বোধন ও প্রচারণার কাজেও অংশ নেন। এসব কারণে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নানা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হয় তাদের। বিগত দিনগুলোয় এসব অনুষ্ঠানে বড় কোনো সমস্যা না হলেও সম্প্রতি বেশ কয়েকটা ঘটনা আলোচনার জন্ম দিয়েছে। শিল্পীরাও পড়েছেন চিন্তায়। অনেকেই যে কোনো আয়োজনে অংশ নিতে শঙ্কায় পড়ে যাচ্ছেন।

গত ২ নভেম্বর ২০২৪ এ চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারে একটি লাইফ-স্টাইল পণ্যর শোরুম উদ্বোধন করার কথা ছিল অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরীর। তিনি নিজেও চট্টগ্রামের মেয়ে। ওই দিন উদ্বোধন করতে চট্টগ্রামে পৌছেও গিয়েছিলেন। কিন্তু শেষমেষ অনুষ্ঠান স্থলে যেতে পারেননি এই অভিনেত্রী। তিনি যাওয়ার আগেই 'রিয়াজউদ্দিন বাজারের সর্বস্তরের ব্যবসায়ী ও তাওহীদি জনতা' নামের একটি ব্যানারে প্রতিরোধ করা হয়। সার্বিক নিরাপত্তার কথা ভেবে আর উদ্বোধনী আয়োজনে অংশ নেননি।

ওই দিন মেহজাবীনের উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা 'খুকি লাইফ স্টাইল' শো-রুমের ম্যানেজার ইমদাদ হোসেন গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, রাজনৈতিক সমস্যার কারণে অভিনেত্রী যেতে পারেননি। নিরাপত্তার অভাবে তিনি আবার ঢাকায় ফিরে গেছেন। তাকে ছাড়াই উদ্বোধন অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে। এ বিষয়ে ওই দিন তাৎক্ষণিকভাবে মেহজাবীন চৌধুরীর কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে ঢাকায় ফিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন তিনি।

মেহজাবীন চৌধুরী লেখেন, চট্টগ্রামে একটি শোরুমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম, কিন্তু বিমানবন্দর থেকে শোরুমে যাওয়ার পথে শুনলাম যে নিরাপত্তা সংক্রান্ত কিছু সমস্যা হয়েছে। তাই আয়োজক এবং আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে নিরাপত্তার অভাবে আমরা শোরুমে যাব না। আমরা তখনই গাড়ি ঘুরিয়ে বিমানবন্দরের দিকে ফিরে যাই এবং ঢাকায় ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেই। তবে গত ২৯ জানুয়ারি যোগাযোগ করলে বিষয়টি নিয়ে আর কথা বলতে চাননি।

 

'যাদের সমস্যা তারা না আসলেই পারতেন'

মেহজাবীন কথা না বললেও বাধা দেয়ার বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন চলচ্চিত্র অভিনেত্রী পরীমনি। তার গত ২৫ জানুয়ারি টাঙ্গাইলে একটি শোরুম উদ্বোধন করতে যাওয়ার কথা ছিল। যাদের শোরুম সেই লাইফস্টাইল প্রতিষ্ঠান 'হারলান' এর শুভেচ্ছাদূত হিসেবে বেশ কিছুদিন কাজ করছেন তিনি।

 

যাওয়ার আগে নিজের ফেসবুক পেজ ও প্রতিষ্ঠানের পেজে টাঙ্গাইলে উদ্ধোধনে যাওয়ার বিষয়টি জানিয়ে পোস্ট দেন। তার যাওয়ার কথা শুনে তাকে ঠেকানোর প্রস্তুতি নেয় স্থানীয় একটি মহল। আয়োজক প্রতিষ্ঠান জানায় স্থানীয়দের প্রবল প্রতিরোধ ও হুমকির মুখে তাৎক্ষণিকভাবে অনুষ্ঠানটি স্থগিত করে। এই বাধাপ্রদানকারী হিসেবে জাতীয় ওলামা মাশায়েখ আইম্মা পরিষদ ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের টাঙ্গাইল এবং কালিহাতী শাখার নাম বিভিন্ন গণমাধ্যমে শোনা যায়। বিষয়টি নিয়ে ওইদিনই সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দেন পরী।

 

তিনি লেখেন, এত চুপ করে থাকা যায় নাকি। পরাধীন মনে হচ্ছে। শিল্পীদের এত বাধা কেন আসবে? ইনসিকিউর ফিল হচ্ছে। এমন স্বাধীন দেশে নিরাপদ নই কেন আমরা? মেহজাবীন, পড়শী—এর আগে তারাও এমন হেনস্থার শিকার হয়েছেন। ধর্মের দোহাই দিয়ে আসলে কী প্রমাণ করতে চাইছেন তারা? আর কী বলার আছে… এ দেশে সিনেমা কিংবা বিনোদনের সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া হোক তাহলে। আমরা কি ধরে নেব, আমরা শুধু ইমোশনালি ব্যবহৃত হয়েছি তখন? নাকি এখন হচ্ছি? কোনটা?।

 

গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, যারা বাধা দিচ্ছেন তারা কারা? আমরা সবাই এটা জানতে চাই। চাইলেই একটা ব্যানার টাঙিয়ে দিলো আর সব বন্ধ হয়ে গেলো এটা একটু ফাইন্ডিং (খুজে বের করা) করা উচিত। ওইনদিন শোরুম উদ্ধোধন ছিল। আমি স্টেজে উঠে নাচতেছিলাম না। যাদের সমস্যা তারা সেখানে না আসলেই পারতেন। তাহলে সমস্যাটা কি ছিল?
তবে পরীমনির ধারণা, এটা বড় কোনো গোষ্ঠী নয়। তারা আসলে খুব ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু ব্যক্তি। আর বিনোদন মাধ্যমের মানুষকে টার্গেট করে এই গোষ্ঠী কাজ করছে বলে তিনি অনুমান করছেন।

 

গত ২৮ জানুয়ারি একটি রেস্টুরেন্ট উদ্বোধন করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েন চলচ্চিত্র অভিনেতা অপু বিশ্বাস। রাজধানীর পাশে কেরানিগঞ্জে সোনার থালা নামে একটি রেস্টুরেন্টের উদ্বোধন করার কথা ছিল তার। প্রতিষ্ঠানটি সেভাবে প্রচারণাও করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যেতে পারেননি তিনি। তবে বিষয়টি নিয়ে ফেসবুক বা গণমাধ্যমে কোনো কথাও বলেননি অভিনেত্রী।

 

যেসব অভিযোগ পাওয়া গেছে তার বেশিরভাগই নারী শিল্পীদের নিয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠান বাধা দেয়ার ঘটনার। কোনো পুরুষ শিল্পীর অনুষ্ঠান বন্ধ বা বাধা দেয়ার খবর পাওয়া যায়নি।

 

শিল্পী সংগঠনগুলো চুপ

এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা গত ৬ মাসে বেশ কয়েকটি ঘটেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে শিল্পকলায় প্রদর্শনী চলা অবস্থায় নাটক বন্ধ করে দেয়ার মতো ঘটনাও আছে। একই সঙ্গে সংগীতশিল্পী পড়শীর একটি কনসার্ট বন্ধ করে দেয়ার অভিযোগও আছে। অভিযোগ আছে নাটকের শুটিং বন্ধ করে দেয়ার। তবে সুনির্দিষ্ট করে কেউ ফেসবুক, গণমাধ্যম বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ দায়ের করেননি।

 

এসব ঘটনায় আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বিবৃতি বা বক্তব্যও দেয়নি শিল্পীদের কোনো সংগঠন। তবে অনেকেই তাদের সমবেদনা জানিয়েছেন। সামাজিক মাধ্যমে নানা ধরনের মন্তব্য এসেছে বিষয়টি নিয়ে। টেলিভিশন নাটকের অভিনয়শিল্পীদের সংগঠন 'অভিনয় শিল্পী সংঘ'-এর সভাপতি অভিনেতা আহসান হাবিব নাসিম বলেন, বিষয়টি আমাদের জন্য শঙ্কার। এমনিতেই আন্দোলনের পরে আমাদের শিল্পীদের মধ্যে একটা বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে। এসব কারণে সেটি আরও বাড়বে।

 

তিনি বলেন, শুটিং এর বাইরে এসব উদ্বোধন বা শুভেচ্ছা দূত হওয়ার মতো কাজ শিল্পীদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের অংশ। এসব করতে বাধা দেয়ার মানে হলো তার স্বাভাবিক জীবনযাপন বাধাগ্রস্ত করা। যখন শিল্পী কোথাও যান তখন যদি কোনো দর্শক না আসেন সেটা একটা ব্যাপার। কিন্তু শিল্পীকে যেতেই দেয়া হলো না সেটা তো প্রতিরোধ। এটা কাম্য নয়।

 

সংঘ থেকে প্রতিবাদ না করা প্রসঙ্গে অভিনেতা নাসিম বলেন, আমরা একটু অবজারবেশন (পর্যবেক্ষণ) এ আছি। ৩১ জানুয়ারি আমাদের অভিনয়শিল্পী সংঘের সাধারণ সভা। তারপর আসলে এসব নিয়ে কথা বলার পরিকল্পনা রয়েছে। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপতি অভিনেতা মিশা সওদাগর দেশের বাইরে রয়েছেন। তার হোয়াটসঅ্যাপে খুদে বার্তা পাঠালেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

 

দেশের নানা ইস্যুতে সরব নির্মাতা আশফাক নিপুন মনে করেন, এ ভাবে বাধা দেয়ার বিষয়টি বহু বছর ধরে চলে আসলেও ২০২৫ সালে এসে বিষয়টি একেবারে অচল। নারীদের বাধা দিয়ে যে রাজনীতিটা করা হচ্ছে সেটি সুপ্রতিষ্ঠিত হতে দেয়া যাবে না। এটার জন্য আমাদের কাজ করতে হবে। সেটা সামাজিক ভাবে হোক বা রাষ্ট্রীয়ভাবে হোক। যে কোনো মব বা তৌহিদী জনতার ব্যানারে যা কিছুই ঘটুক সেটা প্রতিহত করা দরকার। আমি এটির তীব্র প্রতিবাদ জানাই।

বিনোদন বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর