ঢাকা, ১৬ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার, ২০২৫ || ৩ মাঘ ১৪৩১
good-food
৩৪১

এই এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত: শেখ হাসিনা

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২১:১১ ৬ ডিসেম্বর ২০২০  

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশ-ভূটান পিটিএ পারস্পরিক স্বার্থের দিক দিয়ে উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও সুসংহত করবে। রোববার উভয় পক্ষের স্বাক্ষরিত অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) আমাদের দু’দেশের সম্পর্ককে আরো সুদৃঢ় করতে ভূমিকা রাখবে।

 

সেক্ষেত্রে পরবর্তী ৫০ বছর আমাদের অঞ্চলের নাগরিকরা টেকসই উন্নয়ন এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ প্রত্যক্ষ করবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। গণভবন থেকে ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে ভূটানের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রথম পিটিএ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।

 

শেখ হাসিনা বলেন, এখন সময় এসেছে আমরা পারস্পরিক সুবিধার জন্য, উভয় দেশের নাগরিকদের সামগ্রিক উন্নতি এবং কল্যাণের জন্য আমাদের অসাধারণ সম্পর্ককে আরও বেশি অর্থবহ করে তুলি। এই চেতনায় আমরা ভূটানের সঙ্গে পিটিএতে স্বাক্ষর করেছি। এই চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ এবং ভূটান থেকে বিস্তৃত পণ্য একে অপরের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে। চুক্তিতে পারস্পরিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে অতিরিক্ত তালিকা অন্তর্ভুক্ত করারও বিধান রয়েছে।

 

তিনি বলেন, এটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত, কেননা আমরা বিশ্বের কোনও দেশের সঙ্গে আমাদের প্রথম পিটিএ স্বাক্ষর করছি। আর ভূটানই প্রথম দেশ একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে একটি স্বাধীন এবং সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে।

 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে এবং ভূটানের প্রধানমন্ত্রী ডা. লোটে শেরিং সেদেশের রাজধানী থিম্পু থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। রাজধানীর বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে মূল অনুষ্ঠানের অন্য প্রান্তে ভূটানও সংযুক্ত ছিল।

 

বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এবং ভূটানের অর্থমন্ত্রী লিয়নপো লোকনাথ শর্মা নিজ নিজ দেশের পক্ষে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভোম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ভুটান। তাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তির দিনটিকেই শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে দুই দেশ অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের দিন হিসেবে বেছে নেয়।

 

পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, ভূটানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী টান্ডি দরজি এবং অর্থমন্ত্রী লিয়নপো লোকনাথ শর্মা অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। বাংলাদেশের বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দিন অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন।

 

চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বাংলাদেশ প্রান্তে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প এবং বিনিযোগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন, এফবিসিসিআই প্রেসিডেন্ট শেখ ফজলে ফাহিম, বাংলাদেশে ভূটানের রাষ্ট্রদূত কুসাব রিনচেন কিউয়েনটিল এবং ভূটানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত একেএম শহিদুল করিম থিম্পু প্রান্তে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ-ভূটান সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রী একযোগে একটি লোগো উম্মোচন করেন এবং পৃথক কেক কাটেন।

 

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এই চুক্তির ফলে ভূটান তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত কৃষি পণ্য এবং ইলেকট্রনিক্সসহ ১০০টি বিভিন্ন বাংলাদেশি পণ্য রফতানিতে শুল্ক সুবিধা প্রদান করতে সম্মত হয়েছে। অন্যদিকে, ফলমূলসহ ৩৪টি ভূটানের পণ্য বাংলাদেশে একই সুবিধা পাবে। পরবর্তীতে আলোচনার মাধ্যমে আরও পণ্য দু’দেশের তালিকায় সংযুক্ত করা হবে। এই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় পিটিএ এবং এফটিএ স্বাক্ষরের যাত্রা শুরু হবে।

 

শেখ হাসিনা বলেন, এই দিনে আমরা ভূটানের কাছ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি লাভের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ-ভূটান সম্পর্ক উদযাপন করতে যাচ্ছি। এই বছর আশীর্বাদময়, কেননা আমরা আমাদের জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ উদযাপন করছি এবং জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক-এর ও ৪০ তম জন্মবার্ষিকী।

 

প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভূটানের তৃতীয় রাজা এবং জনগণের অবদানের কথা স্মরণ করে বলেন, প্রকৃতপক্ষে সব বাংলাদেশির হৃদয়ে ভুটানের একটি বিশেষ অবস্থান এবং দেশের ইতিহাসে একটি স্থায়ী জায়গা রয়েছে। রক্তস্নাত স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য আপনার দেশের স্বীকৃতি আজও আমাদের হৃদয়কে ব্যাপক আবেগতাড়িত করে তোলে।

 

 

১৯৭১ সালের এই দিনে ভূটানের স্বীকৃতি প্রদানের ঘটনার স্মৃতি রোমন্থন করে তিনি বলেন, তারা তখন রাজধানীর একটি একতলা বাড়িতে তিন মাসের শিশু সজিব ওয়াজেদ জয় এবং শিশু রাসেলসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দি, বাবা বন্দি পাকিস্তানে। শেখ কামাল এবং শেখ জামাল পালিয়ে তখন মুক্তিযুদ্ধে চলে গেছে। এমন অবস্থায় সেদিন মেঝেতে বসে ছিলেন তখনই এই সংবাদটি পান।

 

শেখ হাসিনা বলেন, মুহূর্তেই আমাদের সব দুঃখ, কষ্ট ভূলে গেলাম, আমরা চিৎকার- চেচাঁমেচি, হুল্লোড় এবং কান্না জুড়ে দিলাম। যা আমি কখনও ভূলতে পারবো না। দীর্ঘ সময় বন্দি অবস্থায় কাটানোর পর এটি এমনই একটা ঘটনা ছিল। এটি এমন একটি উৎসাহ ব্যঞ্জক, প্রেরণাদায়ক এবং আনন্দময় ঘটনা ছিল যা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না।

 

সেদিনের ঘটনার স্বাক্ষী তিনি এবং বোন রেহানা এবং পুত্র সজিব ওয়াজেদ জয় ছাড়া ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট পরিবারের সকলে নির্মম হত্যাকাণ্ডের স্বীকার হয়। একাত্তরের সেই বিশেষ দিনটির কথা স্মরণ করে বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, ওই দিনটি আমাদের পরিবার এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি বিশেষ দিন ছিল। কাজেই, ভূটান আমাদের হৃদয়ে একটি বিশেষ জায়গা দখল করে আছে, এর বেশি আর আমি বলতে পারবো না।

 

বাংলাদেশ ও ভূটানের যোগসূত্রকে ‘অত্যন্ত প্রাচীন’ আখ্যায়িত করে সরকার প্রধান বলেন, সাধারণ সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ, ঐতিহ্য এবং ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় আমাদের সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো বাণিজ্য, পর্যটন, জলবিদ্যুৎ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, স্বাস্থ্য, জীব-বৈচিত্র, কৃষি-প্রক্রিয়াজাতকরণ, কৃষি, আইসিটি, শিক্ষা, জল সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং আরও অনেক ক্ষেত্রে বিস্তৃত হয়েছে। 

 

শেখ হাসিনা বলেন, আমি বিশ্বাস করি এই চুক্তি কার্যকর হওয়ার পরে বাংলাদেশের জনগণ ভূটানের তরতাজা আপেল, কমলালেবুসহ অন্যান্য তাজা ফলমূল ও শাকসবজি গ্রহণের সুযোগ পাবে। পাশাপামি ভূটানের ফ্যাশন সচেতন মানুষ বাংলাদেশ থেকে আরও মানসম্মত পোশাক নিতে পারবেন। বাংলাদেশের অবকাঠামো প্রকল্পগুলো ভূটানের পাথর ব্যবহারে লাভবান হতে পারে এবং বাংলাদেশে ওষুধগুলো ভূটানের স্বাস্থ্যখাতে অবদান রাখতে পারে।

 

তিনি বলেন, আরও অনেক ক্ষেত্র রয়েছে যেখানে আমরা পারস্পরিক সহযোগিতার সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে পারি। বাংলাদেশ সবসময় তার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। আমরা বাংলাদেশের চিলমারী বন্দরের উন্নয়ন করছি, নারায়ণগঞ্জের পানগাঁও ভূটানের জন্য উন্মুক্ত। শুধু তাই নয়, আমাদের তিনটি বন্দর চট্টগ্রাম, মংলা, পায়রা তারা চাইলে ব্যবহার করতে পারবে। আমাদের সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে অঞ্চলিক বিমানবন্দর হিসেবে গড়ে তুলতে এর উন্নয়ন করা হচ্ছে, যা দেশটির জন্য উন্মুক্ত।

 

প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং দেশকে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত এবং উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তোলা, যে স্বপ্ন জাতির পিতা দেখেছিলেন। আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো আরো শক্তিশালী এবং আমাদের অর্থনীতির একটি সুদৃঢ় ভিত্তি রয়েছে। আইনের শাসন, মানবাধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত এবং আমরা সব ধরনের সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থার বিরুদ্ধে শূন্য-সহনশীলতার নীতি কঠোরভাবে অনুসরণ করছি। পাশাপাশি, খাদ্য ও জ্বালানি সুরক্ষা, শিক্ষা, দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন, সমাজকল্যাণ এবং টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিকাশের ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।

 

তিনি বলেন, আমরা লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রচেষ্টা হিসাবে আমাদের বন্ধু বান্ধব এবং প্রতিবেশীদের মূল্যবান সহযোগিতাকে সরকারের কাজে লাগাতে চাই। যার মধ্যে এই অঞ্চলের উন্নয়নে গৃহীত আঞ্চলিক যোগাযোগও রয়েছে। ক্রমবর্ধমান করোনা মহামারি স্বাস্থ্য সংকটের পাশাপাশি সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং জীবন-জীবিকার জন্য হুমকিতে পরিণত হয়েছে। এই অজানা শত্রুর প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশ, ভূটানসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য প্রতিবেশী দেশ এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে চমৎকারসহযোগিতা বিনিময় করছে। 

 

শেখ হাসিনা বলেন, মহামারীটির প্রভাব হ্রাস এবং ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য আগামী দিনে শক্তিশালী আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জরুরি। কোভিড-১৯ মহামারি আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় আমাদের অবশ্যই নতুন বাস্তবতা বিবেচনা করতে হবে। সারাবিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সম্প্রদায় কোভিড-১৯ মহামারির নতুন ও গভীর সংকট মোকাবেলা করছে।

 

ভূটানের অগ্রগতির জন্য এর চতুর্থ রাজা জিগমে সিংহে ওয়াংচুকের দূরদর্শী নেতৃত্বের প্রশংসা করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ভূটান একটি গণতান্ত্রিক, আধুনিক এবং প্রগতিশীল দেশ। তার ’গ্রোস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস’ ধারণাটি বিশ্বের প্রশংসা অর্জন করেছে। জিগমে সিংহে ওয়াংচুকের পুত্র পঞ্চম রাজা জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক পিতার কাজকে সঠিকভাবে এগিয়ে নিচ্ছেন বলে তার প্রসংশা করেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী।