ঢাকা, ১৮ ডিসেম্বর বুধবার, ২০২৪ || ৪ পৌষ ১৪৩১
good-food
১৯

এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে নির্বাচন, ধারণা দিলেন প্রধান উপদেষ্টা

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ০২:৪০ ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪  

বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে এসে আগামী নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সূচি নিয়ে ধারণা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, ভোট কবে হবে তা নির্ভর করবে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে কতটা সংস্কার করে নির্বাচনে যাওয়া হবে, তার ওপর। মোটাদাগে এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে হতে পারে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন।

 

প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে বলেন, “আমি সকল প্রধান সংস্কারগুলি সম্পন্ন করে নির্বাচন আয়োজন করার ব্যাপারে বারবার আপনাদের কাছে আবেদন জানিয়ে এসেছি। তবে রাজনৈতিক ঐকমত্যের কারণে আমাদেরকে যদি, আবার বলছি ‘যদি’, অল্প কিছু সংস্কার করে ভোটার তালিকা নির্ভুলভাবে তৈরি করার ভিত্তিতে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হয় তাহলে ২০২৫ সালের শেষের দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়ত সম্ভব হবে।

 

“আর যদি এর সঙ্গে নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কার যোগ করি তাহলে অন্তত আরও ছয় মাস অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে। মোটা দাগে বলা যায়, ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়।”

 

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রথম পর্যায়ে যে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে, সেসব কমিশনের চেয়ারম্যানদের নিয়ে নির্বাচন সামনে রেখে একটি ‘জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন’ প্রতিষ্ঠা করার কথাও প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন। তিনি বলেন, “এর কাজ হবে রাজনৈতিক দলসহ সকল পক্ষের সঙ্গে মতামত বিনিময় করে যে সমস্ত বিষয়ে ঐকমত্য স্থাপন হবে সেগুলি চিহ্নিত করা এবং বাস্তবায়নের জন্য সুপারিশ করা।”

 

ছয় কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাবার পর আসছে জানুয়ারি মাসেই জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন কাজ শুরু করতে পারবে বলে আশা করছেন সরকারপ্রধান। তিনি বলেছেন, যেহেতু জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব’, সেহেতু তিনি নিজেই এ কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন। তার সঙ্গে এ কমিশনের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন অধ্যাপক আলী রিয়াজ।

 

সোমবার বিজয় দিবসের সকালে প্রধান উপদেষ্টার এই ভাষণ রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে সম্প্রচার করা হয়। ভাষণের শুরুতেই তিনি স্মরণ করেন মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদ আর অগণিত শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ জনতার আত্মত্যাগের কথা; যার ফলে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে।

 

তিনি বলেন, “আমরা সেই অর্জনকে আমাদের দোষে সম্পূর্ণতা দিতে পারিনি। সর্বশেষ এবং প্রচণ্ডতম আঘাত হানল এক স্বৈরাচারী সরকার। সে প্রতিজ্ঞা করেই বসেছিল এদেশের মঙ্গল হতে পারে এমন কিছুই সে অবশিষ্ট থাকতে দেবে না।”

 

গত জুলাই-অগাস্টের অভ্যুত্থানে সেই ‘স্বৈরাচারী’ সরকারের পতনে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচিত হওয়ার কথা তুলে ধরে ইউনূস বলেন, “এ বছরের বিজয় দিবস বিশেষ কারণে মহা আনন্দের দিন। মাত্র চার মাস আগে একটি অসম্ভব সম্ভব হয়ে গেল, দেশের সবাই মিলে একজোটে হুংকার দিয়ে উঠল, পৃথিবীর ঘৃণ্যতম স্বৈরাচারী শাসককে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে আমাদের প্রিয় দেশকে মুক্ত করেছে ছাত্র-জনতার সম্মিলিত অভ্যুত্থান।

 

“যে হাজার হাজার শহীদ এবং আহতদের আত্মত্যাগ এবং ছাত্র-জনতার অটুট ঐক্যের মাধ্যমে এই গণ-অভ্যুত্থান সম্ভব হল, তাদের সবাইকে স্মরণ করি এবং আজ এবারের মহা বিজয়ের দিনে সমগ্র জাতির পক্ষ থেকে তাদের প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম জানাই।”

 

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “নাগরিক অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিতের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, একটি বৈষম্যহীন দেশ গড়ার তাগিদে ছাত্র জনতা স্বৈরাচারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে রক্ত দিয়ে চার মাস আগে নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য যে ঐক্য গড়ে তুলেছিল, সে ঐক্য এখনো পাথরের মতো মজবুত আছে। মাত্র কয়েক দিন আগে জাতি আবার গর্জে উঠে সমগ্র পৃথিবীকে সেকথা জানিয়ে দিয়েছে।”

 

চার মাসের ব্যবধানে সেই ঐক্য কোথাও ‘শিথিল হয়নি’ মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “নতুন বাংলাদেশ গড়ার সংকল্পে আমরা অটুট আছি।” ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনে গত ৫ অগাস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে।

 

এর তিন দিন পর ৮ অগাস্ট নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ বঙ্গভবনে শপথ গ্রহণ করে। তখন থেকেই একটি প্রশ্ন বার বার ফিরে আসছে– কতদিন দায়িত্ব পালন করবে অন্তর্বর্তী সরকার, কবে হবে নির্বাচন, যার মধ্য দিয়ে একটি নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব বুঝে নেবে?

 

এর মধ্যে সরকারের বিভিন্ন উপদেষ্টা, এমনকি সেনাপ্রধানও নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সূচি নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন, তবে সেগুলো ছিল তাদের ব্যক্তিগত অভিমত, অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন পূর্তিতে গত ১৭ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে এসে মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, ‘নির্বাচনের ট্রেন’ যাত্রা শুরু করেছে, সেই ট্রেন আর ‘থামবে না’।

 

কিন্তু তার আগে রাষ্ট্র সংস্কারে সরকারের নেওয়া উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেছিলেন, “যেতে যেতে আমাদের অনেকগুলো কাজ সেরে ফেলতে হবে। এই ট্রেন শেষ স্টেশনে কখন পৌঁছাবে সেটা নির্ভর করবে কত তাড়াতাড়ি আমরা তার জন্য রেললাইনগুলো বসিয়ে দিতে পারি আর তা হবে রাজনৈতিক দলসমূহের ঐক্যমত্যের মাধ্যমে।”

 

ইউনূস সেদিন বলেছিলেন, “আমরা চাইব, আমরা যেন এমন একটি নির্বাচন ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে পারি যা যুগ যুগ ধরে অনুসরণ করা হবে। এর ফলে সাংবাৎসরিক রাজনৈতিক সংকট থেকে আমাদের দেশ রক্ষা পাবে। এজন্য প্রয়োজনীয় সময়টুকু আমি আপনাদের কাছে চেয়ে নিচ্ছি।” তার এক মাসের মাথায় বিজয় দিবসের সকালে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে এসে প্রথমবারের মত নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সূচি নিয়ে কথা বললেন ইউনূস ।

 

সরকারের গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর কাজের অগ্রগতির তথ্য তুলে ধরার এক পর্যায়ে তিনি বলেন, “আমাদের সংস্কারের যে আকাঙ্ক্ষা, সেটি বাস্তবায়নে প্রতিটি কমিশনই আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার ও সংবিধান সংস্কার কমিশনের কথা আমি একটু আলাদাভাবে বলতে চাই, কেননা এই দুটি কমিশনের সুপারিশের ওপর প্রধানত নির্ভর করছে আমাদের আগামী নির্বাচন প্রস্তুতি ও তারিখ।”

 

ইতোমধ্যে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়টি মনে করিয়ে দিতে তিনি বলেন, “এখন থেকে তাদের হাতে দায়িত্ব ন্যস্ত হল ভবিষ্যৎ সরকার গঠন করার প্রক্রিয়া শুরু করার। তারা তাদের প্রস্তুতির কাজ শুরু করেছেন। তাদের হাতে অনেক কাজ।”প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টিতে প্রথমে সবচেয়ে বড় কাজ হল ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা।

 

“এটা এমনিতেই কঠিন কাজ। এখন কাজটা আরো কঠিন হল এজন্য যে গত তিনটা নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণ করার সুযোগ ছিল না। ভোটার তালিকা যাচাই করার সুযোগ হয়নি কারোর। গত ১৫ বছরে যারা ভোটার হবার যোগ্য হয়েছে তাদের সবার নাম ভোটার তালিকায় তোলা নিশ্চিত করতে হবে। এটা একটা বড় কাজ।

 

“ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের পর এখানে গলদ রাখার কোনো সুযোগ নেই। দীর্ঘদিন পর এবার বহু তরুণ তরুণী জীবনে প্রথমবারের মতো ভোট দেবে। অতীতে তাদেরকে সে অধিকার এবং আনন্দ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। তাই এবারের নির্বাচনে তাদের ভোটদান একটি স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে। এই অভিজ্ঞতাকে মসৃণ করার সমস্ত আয়োজন করতে হবে।”

 

এবারের নির্বাচনে প্রথমবারের তরুণ তরুণী ভোটারেরা ১০০ শতাংশের কাছাকাছি সংখ্যায় ভোট দিয়ে ‘ঐতিহ্য’ সৃষ্টি করবে, সেই প্রত্যাশার কথাও বলেন অধ্যাপক ইউনূস।তিনি বলেন, “নির্বাচন কমিশন এবং সকল সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক দলের প্রতি আমার আহ্বান, সবাই মিলে আমরা যেন এই লক্ষ্য অর্জনে নানা প্রকার সৃজনশীল কর্মসূচি গ্রহণ করি। এখন থেকে সবাই মিলে এমন একটা ঐতিহ্য সৃষ্টি করতে পারি যে স্থানীয় নির্বাচনসহ সকল নির্বাচনে সকল কেন্দ্রে প্রথমবারের ভোটাররা ১০০ শতাংশের এর কাছাকাছি সংখ্যায় ভোটদান নিশ্চিত করবে। এটা নিশ্চিত করতে পারলে ভবিষ্যতে কোনো সরকার মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেবার সাহস করতে পারবে না।”

 

নতুন ভোটার ছাড়াও যাদের আগে থেকে ভোটার তালিকায় নাম থাকার কথা ছিল, তারা ভোটার তালিকায় আছেন কিনা, তা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন প্রধান উপদেষ্টা। ভুয়া ভোটারদেরকে তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার কাজে ‘বিশেষ মনোযোগ’ দেওয়ার কথাও বলেন।তিনি বলেন, “এবার আমরা প্রবাসী বাংলাদেশিদেরকে ভোট দেওয়া নিশ্চিত করতে চাই। অতীতে আমরা এ ব্যাপারে অনেকবার আশ্বাসের কথা শুনেছি। এই সরকারের আমলে এটা যেন প্রথমবারের মতো বাস্তবায়িত হয় এটা আমরা নিশ্চিত করতে চাই। এর জন্য একটা নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা করতে হবে।”

 

তবে সব প্রস্তুতি এবং সংস্কারের জন্য যে সময় দরকার, সে কথা আবারও মনে করিয়ে দিয়ে ইউনূস বলেন, “সবকিছুই সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। এর সঙ্গে যদি আমরা নির্বাচন প্রক্রিয়া আরও উন্নত করতে চাই, নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালা বাস্তবায়ন করতে চাই, তাহলে প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিস্তৃতি ও গভীরতা অনুসারে নির্বাচন কমিশনকে সময় দিতে হবে।”

 

আর লক্ষ্য পূরণে সবাইকে গণঅভ্যুত্থানের ঐক্য বজায় রাখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “সজাগ থাকুন। নিজের লক্ষ্যকে জাতির লক্ষ্যের সঙ্গে একীভূত করুন। পৃথিবীর কোনো শক্তিই আমাদেরকে আমাদের লক্ষ্য অর্জন থেকে বিচ্যুত করতে পারবে না।”