ঢাকা, ২৬ নভেম্বর মঙ্গলবার, ২০২৪ || ১২ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
৭১৮

এণ্ড্রু কিশোর বলতেন - শিল্পী নয়, আমি একজন কণ্ঠশ্রমিক

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২২:২৭ ৬ জুলাই ২০২০  

মারাত্মক অসুস্থ হবার পর চিকিৎসকের পরামর্শে গান করেছিলেন এণ্ড্রু কিশোর। ছবি : সংগৃহীত

মারাত্মক অসুস্থ হবার পর চিকিৎসকের পরামর্শে গান করেছিলেন এণ্ড্রু কিশোর। ছবি : সংগৃহীত

 

শিল্পী নয়, শ্রমিক হিসেবেই নিজেকে পরিচয় দিতে ভালবাসতেন কিংবদন্তী কণ্ঠশিল্পী এণ্ড্রু কিশোর। লাইফটিভি’কে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, আমি একজন কণ্ঠশ্রমিক। 

 

আজীবন শ্রম-সাধনা দিয়ে, কণ্ঠের অভূতপূর্ব মাধুর্য দিয়ে, শ্রোতাদের মোহিত করে, অগণিত ভক্ত-শ্রোতা-শুভানুধ্যায়ীকে কাঁদিয়ে নিলেন চিরবিদায়। জীবনের গল্প আর বাকি রইলো আর . . .

 

অসংখ্য গান গেয়ে যিনি মানুষকে আবেগে ভাসিয়েছিলেন, ক্যান্সারের করাল গ্রাসে সেই এন্ড্রু কিশোরের জীবনের শেষ দিনগুলো ছিল কষ্ট মাখা।

 

৬৪ বছর বয়সেই সোমবার পৃথিবীকে চিরবিদায় জানালেন জনপ্রিয় এই সঙ্গীতশিল্পী, যার গান এখনও মানুষের মুখে মুখে ফিরছে।

 

ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলেন চিকিৎসা করাতে। এক সময় পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছিল। কিন্তু পরে এক পর্যায়ে সেখানকার চিকিৎসকরা হাল ছেড়ে দেন। এ অবস্থায় গেল ১১ জুন ফিরে আসেন দেশে।

 

সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফিরে রাজশাহী মহানগরীর মহিষবাতান এলাকায় বোন ডা. শিখা বিশ্বাস ও ভগ্নিপতি ডা. প্যাট্রিক বিপুলের বাসায় ছিলেন এন্ড্রু কিশোর।

 

প্যাট্রিক বিশ্বাস ক’দিন আগেই জানিয়েছিলেন, এন্ড্রু কিশোরের শারীরিক অবস্থা ফের সংকটাপন্ন। লিম্ফোমা ফিরে আসায় তার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটছে। তার জন্য প্রার্থনা করা ছাড়া আর উপায় নেই।

 

তার শেষ দিনগুলো নিয়ে স্ত্রী লিপিকা এন্ড্রু গেল রোববার রাতে স্বামীর ফেইসবুকে এক পোস্টে লেখেন, “এখন কিশোর কোনো কথা বলে না। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। আমি বলি কী ভাব, বলে, ‘কিছু না, পুরনো কথা মনে পড়ে আর ঈশ্বরকে বলি আমাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যাও, বেশি কষ্ট দিয় না’।”

 

লিপিকা লিখেছেন, “ক্যানসারের লাস্ট স্টেজ খুব যন্ত্রণাদায়ক ও কষ্টের হয়। এন্ড্রু কিশোরের জন্য সবাই প্রাণ খুলে দোয়া করবেন, যেন কম কষ্ট পায় এবং একটু শান্তিতে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে যেতে পারে।”

 

স্বামীকে নিয়ে লিপিকা আরও লেখেন, “এটাই শেষ পোস্ট, এর পর আর কিছু বলা বা লেখার মতো আমার মানসিক অবস্থা থাকবে না। এখনও মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন মনে হয়, কিশোর থাকবে না, অথচ আমি থাকবো, মেনে নিতে পারছি না।”

 

করোনাভাইরাস সঙ্কটকালে সবাইকে সাবধান থাকার পরামর্শও দেন তিনি।

 

“এই অসময়ে সবাই সাবধানে থাকবেন, নিজের প্রতি যত্ন নিবেন, সুস্থ থাকবেন, ভাল থাকবেন আর এন্ড্রু কিশোরের প্রতি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি রাখবেন ও প্রাণ খুলে দোয়া করবেন।”


বেশ কিছু দিন অসুস্থ থাকার পর এন্ড্রু কিশোরের ক্যান্সার ধরা পড়ে। গত বছর সিঙ্গাপুরে যান চিকিৎসার জন্য।

 

সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চিকিৎসকের অনুমতি নিয়ে গত বছরের অক্টোবরে এক অনুষ্ঠানে গান গাইতে গিয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর। 


চিকিৎসা শেষে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ১১ জুন তার দেশে ফেরার কথা থাকলেও ১০ জুন এক পরীক্ষায় তার শরীরে আবারও লিম্ফোমার অস্তিত্ব মিলে। ফলে চিকিৎসকরা হাল ছেড়ে দেন।

 

তখনকার ঘটনা তুলে ধরে লিপিকা এর আগে বলেছিলেন, “আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম, মনে মনে শুধু ঈশ্বরকে ডেকেছি। কারণ শুরুতে ডাক্তার বলেছিলেন, লিম্ফোমা যদি একবারে নির্মূল না হয়, যদি ব্যাক করে তাহলে সেটা দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে ফিরে আসে। আর খুব দ্রুত ছড়ায়। কোনোভাবেই সেটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না।

 

“কিশোর আমাকে বলল, ‘ডাক্তারকে বলবা, হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিতে, আমরা দেশে ফিরব’। আমি ভয়ে চুপ করে বসে আছি, শুধু বললাম দেখি ডাক্তার লিম কী বলে। কিছুক্ষণ পরে একজন নার্স এসে আমার হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে গেল, বলল ডাক্তার ডাকছে। লিম আমার সামনে এসে একটাই কথা বললো, ‘লিম্ফোমা ব্যাক করেছে।”

 

লিপিকা তখন লিখেছিলেন, “চোখের জল ঠেকাতে পারছিলাম না, অনেক কষ্টে ডাক্তারকে বললাম, ‘হোয়াট নেক্সট?’ ডাক্তার বললেন, ‘আই অ্যাম স্যরি, আমার আর কিছুই করার নাই।’

 

“আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি, চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ে যাচ্ছে। নিজেকে এত অসহায় লাগছিল যে, কী করব বুঝতে পারছিলাম না। ডাক্তার কিশোরকে বলে, লিম্ফোমা ফিরেছে। কিশোর ডাক্তারকে বলে, ‘তুমি আজই আমাকে রিলিজ করো। আমি আমার দেশে মরতে চাই, এখানে না। আমি কালই দেশে ফিরব’।

 

“আমাকে বলে, ‘আমি তো মেনে নিয়েছি, সব ঈশ্বরের ইচ্ছা। আমি তো কাঁদছি না, তুমি কাঁদছ কেন?’ কিশোর খুব স্বাভাবিক ছিল, মানসিকভাবে আগে থেকে প্রস্তুত ছিল, যেদিন থেকে জ্বর এসেছিল সেদিন থেকে। কিশোর তখনই বাংলাদেশ হাই কমিশনে ফোন করে বলে, ‘কালই আমার ফেরার ফ্লাইট ঠিক করে দেন। আমি মরে গেলে আপনাদের বেশি ঝামেলা হবে, জীবিত অবস্থায় পাঠাতে সহজ হবে।’

 

১১ জুন রাতে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে দেশে ফিরে রাজশাহীতে চলে যান এন্ড্রু কিশোর। আর প্রিয় জন্মস্থানেই চিরিবিদায় নিলেন জনপ্রিয় এই কণ্ঠশ্রমিক।

বিনোদন বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর