ঢাকা, ৩১ মার্চ সোমবার, ২০২৫ || ১৭ চৈত্র ১৪৩১
good-food
৩২

ও আলোর পথযাত্রী, এখানে থেমো না

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ০৩:৪৪ ২৭ মার্চ ২০২৫  

১.মুক্তি পেলেন সনজীদা খাতুন। জাগতিক সকল মায়ার বন্ধন ছিন্ন করে অনন্ত নক্ষত্র বীথিতে ঠাঁই করে নিলেন। বাঙালির প্রত্যাশা সেখান থেকে তিনি আলোর পথযাত্রীদের সঠিক কম্পাসে আলোকিত পথ দেখাবেন। 

 

২.আজন্ম বৈরী বাতাসে লড়েছেন। তাঁর বহুমাত্রিক সকল পরিচয় ছাপিয়ে ভাষাসৈনিক আর মুক্তিযোদ্ধা এই দুই পরিচিতিই তাঁকে আমাদের আত্মার আত্মীয় করেছে। তাঁর মাতৃরুপিনী স্নেহার্দ ছায়ায় আর বিপুলপ্লাবী সাংগঠনিক দক্ষতায় সহযোদ্ধাদের নিয়ে গড়েছেন ছায়ানট। পশ্চিমাদের রক্তচক্ষুতে নিষিদ্ধ হওয়া রবীন্দ্র সংগীতকে পশ্চাৎপদতা আর অচলায়তন ভেঙে যে মুক্তধারা বইয়ে দিয়ে ছিলেন সেটি সরোষে আজও প্রবহমান। ধর্মীয় উগ্রবাদীরা রমনার বটমূলে বোমা মেরে মানুষ হত্যা করলেও তাঁকে ভয় দেখানো যায়নি। বরং ছায়ানটের মায়া আর ছায়ায় জীবনের প্রায় শেষ দিন পর্যন্ত নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন। 

 

৩. সময়টা ছিল অন্ধকারের যুগ। এই জনপদের গালভরা নাম ছিল পূর্ব পাকিস্থান। কিন্তু পশ্চিমা শাসকদের  কূট-কৌশলের বেড়াজালে আমাদের সাংস্কৃতিক বোধের উন্নয়ন আর মুক্ত-উদার মানবিক সমাজ নির্মাণের লাল সূর্যকে পূর্ব দিগন্তে উদিত হতে না দেয়ার চক্রান্তের বিরুদ্ধে যে সাংস্কৃতিক গণজাগরণ সৃষ্টি হয় তিনি ছিলেন তার অন্যতম ভ্যানগার্ড। আজ যে কিশোরেরা মাতৃক্রোড়ের স্নেহডোর ভেঙে অথবা যেসব নারী অন্তঃপুরের আগল ভেঙে দেশকে বুকে ধারণ করে কবিতা রচনা করে, মুষ্টিবদ্ধ উত্তোলিত দু’হাতে মিছিল করে ,মিটিংয়ে অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে আঙুল উঁচিয়ে জ্বালাময়ী শ্লোগান দেয়, বক্ষভেদী সত্য উচ্চারণ করে অনলবর্ষী ভাষণ দেয় সনজীদা খাতুন তাঁদেরই সুযোগ্য পূর্বসূরি,তাঁদেরই পথ প্রদর্শক। 

 

৪. প্রগতিশীল পিতা মোতাহার হোসেনের আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছেন সেই শিউলি শৈশবে। ধর্মীয় গোঁড়ামি আর কঠোর পর্দাপ্রথার বিরুদ্ধ বাতাসে পঞ্চাশের দশকে ঢাকা মহাবিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষা অর্জন তাঁকে সেই প্রজন্মের সামনে "বেগম রোকেয়া" হিসেবে বাতিঘরের মতো আলো ছড়িয়েছেন। বহুমুখী কর্মযজ্ঞে সবামী ওয়াহিদুল হক, সন্তান পার্থ তানভীর নভেদসহ পুরো পরিবার সমভাবে জড়িয়ে পড়েন। অর্থবিত্তের প্রলোভনের অসীম ক্ষমতার বিরুদ্ধে ব্রতচারী জীবনাচার পালন করেছেন। মুকুল ফৌজ যুক্ত থেকে সেই প্রজন্মের শিশু মানসে আলোকচ্ছটা ছড়িয়ে দেন। হিন্দি ,উর্দু, পশ্চিমাসহ বিজাতীয় সকল সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধ স্রোতে বাংলা নামের অবহেলিত জনপদকে নিজস্ব সংস্কৃতির প্রদীপের শিখায় জ্বলতে শেখান। বাঙালির গৌরব অতীশ দীপংকরের যুগের আলোকবর্ষী প্রতিষ্ঠান নালন্দা আর অরণির নামে  জীবনমুখী শিক্ষাংগন গড়ে তোলেন।

 

৫. শিক্ষাগুরু সোহরাব হোসেনের কাছে সংগীতে হাতেখড়ি হয়। মৃত্যুর প্রায় কিছুদিন আগেও শিল্পী হিসেবে তাঁর কন্ঠ সরব ছিল। গুরুমুখী বিদ্যার্জনে তিনি শৈলাজারঞ্জন মজুমদার, আবদুল আহাদ, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেনের মতো দেশবরেণ্য শিল্পীদের কাছ থেকে তালিম নেন।

 

৬. গ্রন্থ সহস্র বছরের কল্লোলকে ধারণ করে। তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ২০টিরও অধিক। শুধু রবীন্দ্রনাথ নয় বরং কাজী নজরুল ইসলাম, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তসহ অন্যান্য সাংস্কৃতিক জনের উপর তিনি গবেষণা করেন, গ্রন্থ রচনা করেন। 

 

৭. চিকিৎসা বিজ্ঞান শিক্ষার অ,আ,ক,খ শুরু করবার বিজ্ঞানের নাম "এনাটমি"। মানুষের শব, কংকাল নিবিড়ভাবে পঠনের মাধ্যমে গড়ে উঠে আগামীদিনের এক একজন চিকিৎসক। মৃত্যুর পর নিজ শরীরটুকুও দানের মাধ্যমে নিজেকে মানুষের অগ্রযাত্রার "বাহক" হিসেবেই রেখে গেলেন এই মহীয়সী। 

 

৮. দুর্ভাগা দেশকে মঙ্গলময় নানা ভীতি দিয়ে পরীক্ষা করেন। জিতে যাওয়া বিপ্লব হারানোর ভয়, কান্ডারী হুঁশিয়ার না হওয়ার ভয়ের সাথে সনজীদা খাতুনকে হারিয়ে যুক্ত হলো সমষ্টিরোহিত জাতির বিভান্ত-ক্লেদাক্ত পথে আরেকবার হাঁটবার ভয়। নবকুমারের কাছে কপালকুন্ডলার চিরায়িত প্রশ্ন "পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছো? "এর জবাবে উচ্চকন্ঠে বলি,"না,পথ হারাইনি। যে পথে সনজীদা হেঁটে গেছেন, যে পথে আলোর পথযাত্রীরা হেঁটে গেছেন সে পথের মঞ্জিল এখনও অনেক দূর। সে পথে আরো হাঁটতে হবে যে!"

 

লেখক: মেজর ডা. খোশরোজ সামাদ 

ক্লাসিফাইড স্পেশালিস্ট বাংলাদেশ আর্মড ফোর্সেস।

মুক্তমত বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর