ঢাকা, ২৬ নভেম্বর মঙ্গলবার, ২০২৪ || ১২ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
২১৪

করোনাভাইরাসে যেভাবে ব্রিটিশ- বাংলাদেশি আক্রান্ত হন ও মৃত্যু হয়

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২১:১২ ১০ মার্চ ২০২০  

ব্রিটেনে করোনাভাইরাসে রোববার তৃতীয় ব্যক্তি মারা গেছেন। তিনি একজন ব্রিটিশ-বাংলাদেশি। সংক্রমণ ধরা পড়ার মাত্র পাঁচ দিনের মাথায় ম্যানচেস্টারের এক হাসপাতালে মারা যান। তার ছেলে বর্ণনা করেছেন কীভাবে ইতালিতে বেড়াতে গিয়ে বাবা করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শিকার হয়েছিলেন- 

‘প্রতিবছরের শুরুতে আমার বাবা ইতালিতে বেড়াতে যান দুই/তিন সপ্তাহের জন্য। এটা তার একটা প্রিয় বেড়ানোর জায়গা। কারণ বহু বছর উনি ইতালিতে ছিলেন। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ থেকে দেশটিতে আসেন। তখন বয়সে তরুণ ছিলেন।
উত্তর ইতালির এক শহরে আমরা থাকতাম। সেটা মিলান থেকে ৫০ মাইল দূরে। সেখান থেকে সুইজারল্যান্ডের সীমান্তও বেশি দূরে নয়। বহু বছর আমরা সেখানে ছিলাম। আমার জন্ম সেখানেই। বড় হয়েছি সেখানে।
পাঁচ-ছয় বছর আগে আমরা পাকাপাকিভাবে ব্রিটেনে চলে আসি। আমরা থাকি ম্যানচেস্টারের কাছে। কিন্তু আমার বাবা ইতালিতে বেড়াতে যেতে পছন্দ করতেন। আমরাও প্রতিবছর গ্রীষ্মে পরিবারের সবাই মিলে সেখানে বেড়াতে যেতাম। তবে বাবা প্রতিবছরের শুরুতে নিয়ম করে বেড়াতে যেতেন ইতালিতে তার পুরোনো শহরে। এ বছরও গিয়েছিলেন।
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি তিনি সেখানে যান। তখনও ইতালিতে করোনাভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়ানোর কথা শোনা যায়নি। কিন্তু যে দুই সপ্তাহ সেখানে ছিলেন। এর মধ্যেই পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ হয়। ব্যাপকভাবে সেখানে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে।
২৯ ফেব্রুয়ারি বাবা ফিরে আসেন ইতালি থেকে। তখনও তিনি সুস্থ। কিন্তু তিনদিন পর সব যেন ওলট-পালট হয়ে গেল। ৩ মার্চ, মঙ্গলবার। সেই দিনটা ছিল আর যেকোনও দিনের মতোই। আমাদের বাড়ির কাছে হেলথ সেন্টার ছির। বাবা সেখানে গিয়েছিলেন ডাক্তার দেখাতে। এ অ্যাপয়েন্টমেন্টটা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল।
বাবার বয়স ছিল ৬০ বছর। তার নানা ধরনের অসুস্থতা ছিল। এ নিয়ে তিনি বেশ ভুগছিলেন। কোলেস্টরেল, আর্থ্রাইটিস, হৃদরোগ, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট ছিল। তবে এসবের পরও মোটামুটি ভালোই ছিলেন। একশো ভাগ সুস্থ ছিলেন, এটা বলা যাবে না। কিন্তু মোটামুটি ভালো ছিলেন।
করোনাভাইরাস নিয়ে আতংক ছড়িয়ে পড়েছিল। তাই আমি কিছু মাস্ক কিনেছিলাম। আমি আমার মা-বাবাকে বললাম। বাইরে যাওয়ার সময় যেন তারা মাস্ক পরে বের হন। গেল মঙ্গলবার বাড়ির কাছের হেলথ সেন্টারে যান বাবা। তখন ডাক্তার ও নার্সরা তাকে জিজ্ঞেস করেন, কেন মাস্ক পরে আছেন। তিনি বলেন, মাত্র দুদিন আগে ইতালি থেকে এসেছেন।

সঙ্গে সঙ্গে সেখানে আতংক ছড়িয়ে পড়ল। তাকে আলাদা করে ফেলা হলো। নর্থ ম্যানচেষ্টার জেনারেল হাসপাতাল থেকে একটা জরুরি দল চলে এলো। উনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। তার সঙ্গে আমাদের সেদিনই শেষ দেখা। আমরা বুঝতে পারিনি যে, আর কোনও দিন দেখা হবে না।
হাসপাতালে প্রথম কয়েক দিন তিনি বেশ ভালোই ছিলেন। কিন্তু পরে ডাক্তাররা বলেন, তার রক্তে যথেষ্ট অক্সিজেন যাচ্ছে না। হার্টবিট অনিয়মিত। এভাবেই চলছিল কয়েকদিন।েএরপর রোববার তিনি মারা গেলেন।
বাড়িতে আমাদেরও রীতিমতো আলাদা করে রাখা হয়েছিল। আমরা ঘর থেকে বেরুতে পারছিলাম না। কোথাও যেতে পারছিলাম না। বাবার খবরাখবর পেতাম টেলিফোনে। যে ওয়ার্ডে তাকে রাখা হয়েছিল, সেখানে ফোন করতাম। সেখান থেকেই আমরা খবর পেতাম। তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারতাম না।
গতকাল সকালে হাসপাতাল থেকে ফোন এলো আমাদের কাছে। তারা বলল, আধ ঘণ্টা আগে বাবা মারা গেছেন। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। খবরটা শুনে ধাতস্থ হতে আমার কয়েক ঘণ্টা সময় লেগেছিল। আমার বাবাকে আমি আর কোনও দিন দেখতে পাব না!
এরকম একটা খবর যখন আপনি পান, সেটা বুঝতেই অনেক সময় লেগে যায়। আমি ছিলাম শোকাহত। আমাদের বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে গেল। বাবার মৃত্যুর খবর পেলেও আমরা কিছুই করতে পারছি না। কোথাও যেতে পারছি না। কারণ, আমাদের সবাইকে 'আইসোলেশনে' রাখা হয়েছে। প্রতিদিন পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড থেকে আমাদের সবার কাছে টেক্সট আসে।
 তারা জানতে চায়, আমাদের সব ঠিক আছে কি-না। আমাদের মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কোনও লক্ষণ আছে কি-না। প্রতিদিন আমাদের সেই টেক্সটের জবাব দিতে হয়। এখন পর্যন্ত আমরা সবাই ভালো আছি। আমাদের কারো মধ্যে করোনাভাইরাসের কোনও লক্ষণ নেই।
আমরা এক সপ্তাহ এ অবস্থায় আছি। আরও এক সপ্তাহ থাকতে হবে। যেহেতু আইসোলেশনে আছি, তাই আমার বাবার জানাজা বা দাফন কোনও কিছুই করতে পারছি না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা লাশ আরও কিছুদিন মর্গে রেখে দেবে। আরও এক সপ্তাহ পর  আমাদের মুক্তি মিলবে। তখন আমরা বাবার জানাজা, দাফন এগুলোর আয়োজন করতে পারব।
আমরা এখনো জানি না, তার জানাজা-দাফন এগুলো আমরা স্বাভাবিকভাবে করতে পারব কি-না। কারণ তিনি তো স্বাভাবিকভাবে মারা যাননি। পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড যা বলে, সেই মোতাবেক আমাদের কাজ করতে হবে। মাত্র দু'মাস আগেও আমরা জানতাম না করোনাভাইরাস জিনিসটা কী। এ ভাইরাসটাই ছিল না। এখন এ ভাইরাস আমার বাবাকে কেড়ে নিল।’

বাংলাদেশ বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর