ঢাকা, ২৫ নভেম্বর সোমবার, ২০২৪ || ১১ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
৬৬৯

করোনাভাইরাসের নিরাপদ আশ্রয়স্থল ফ্রিজ?

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২০:৩৫ ১০ জুন ২০২০  

২০১৯ সালের শেষভাগে চীনের উহান প্রদেশ থেকে ছড়িয়ে পড়ে মানবঘাতী নভেল করোনাভাইরাস। ধীরে ধীরে তা মহামারিতে পরিণত হয়। সেই প্রাদুর্ভাবে এখন পর্যন্ত সারাবিশ্বে ৪ লাখের বেশি মানুষ মারা গেছে। 

প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের উৎস, চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য, গতি প্রকৃতি বা বিবর্তনের ধরণ সম্পর্কে এখন পর্যন্ত নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। এটি কোন ধরণের সমতলে কতক্ষণ বেঁচে থাকে, হাঁচি-কাশির মাধ্যমে কত দ্রুত ছড়ায়, কোন ধরণের আবহাওয়া বা তাপমাত্রায় এর প্রকোপের কতটা তারতম্য হয় - এসব বিষয়ে একেকবার একেক মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। 

আবার নতুন গবেষণা প্রকাশিত হওয়ার প্রেক্ষিতে দফায় দফায় বিশেষজ্ঞদের মত পরিবর্তন করার ঘটনাও ঘটেছে। শুরুতে মানুষের ধারণা ছিল,উচ্চ তাপমাত্রায় এ ভাইরাস বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারে না। তবে অদ্যাবধি এ দাবি প্রমাণের পক্ষে বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি পাওয়া যায়নি।

সেরকম আরেকটি ধারণা হলো, অন্যান্য স্থানের তুলনায় ফ্রিজের ভেতরে অপেক্ষাকৃত বেশি সময় ভাইরাসটি বেঁচে থাকতে পারে। তবে করোনা সংক্রান্ত অন্যান্য মতবাদের মতো এ বিষয়টি নিয়েও শতভাগ নিশ্চিত হতে পারেননি বিজ্ঞানীরা।

ফ্রিজে কি করোনাভাইরাস বেশি সময় ধরে টিকে থাকে?

এর আগে যেসব করোনাভাইরাস পরিবেশে ছিল, সেগুলোর কয়েকটি প্রজাতি হিমাঙ্কের নিচে তাপমাত্রায় পুরোপুরি কার্যকরভাবে বেঁচে থাকতে পারেনি। তবে স্থিতিশীল অবস্থায় টিকে থাকে বলে প্রমাণ পান বিজ্ঞানীরা।

২০১০ সালে আমেরিকান সোসাইটি অব মাইক্রোবায়োলোজি'র এক গবেষণায় উঠে আসে সার্স একটি করোনাভাইরাস (যেটি অনেকটা কোভিড-১৯ ভাইরাসের মতো)। এটি ৪০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় (প্রায় ৪.৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস) যেরকম আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা থাকে, ওই পরিবেশে টিকে থাকতে পারে।

সাধারণত গৃহস্থালিতে যেসব রেফ্রিজারেটর ব্যবহার করা হয়, সেগুলোতে এ তাপমাত্রা থাকে। গবেষণায় উঠে আসে, তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং আর্দ্রতা ২০ শতাংশের নীচে হলে সার্স প্রায় ২৮ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকে। আর যেখানে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং আর্দ্রতা ৮০ শতাংশ সেখানে ভাইরাসটির স্থায়িত্বকাল থাকে ৬ ঘণ্টার মতো।

অনেক বিশেষজ্ঞ এ প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে আর পরবর্তী গবেষষণার জন্য অপেক্ষা না করে ফ্রিজ ব্যবহারে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন। তারা বলছেন, যেহেতু কাছাকাছি প্রজাতির একটি করোনাভাইরাস ফ্রিজে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারে, কাজেই নভেল করোনাভাইরাসেরও একই বৈশিষ্ট্য থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

গত এপ্রিলে স্যান ফ্র্যান্সিসকোর গ্ল্যাডস্টোন ইনস্টিটিউটের রিসার্চ সাইন্টিস্ট ও ভাইরোলজিস্ট ড. ওয়ার্নার গ্রিন মার্কিন সংবাদ সংস্থা এনবিসিকে এক সাক্ষাৎকার দেন। তাতে তিনি বলেন, করোনা চরিত্রগতভাবে একটি 'আঠালো' ভাইরাস।
ড. গ্রিন বলেন, সার্স বিভিন্ন সমতলে আশ্চর্যজনকভাবে লম্বা সময় টিকে থাকে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট নজরুল ইসলাম বলেন, নভেল করোনাভাইরাস ফ্রিজে কতদিন বেঁচে থাকতে পারে, সেই সম্পর্কে এখন পর্যন্ত কিছু জানা যায়নি। তবে অন্য জায়গার তুলনায় অপেক্ষাকৃত ফ্রিজের আবহাওয়ায় এটি বেশি সময় বাঁচতে পারে বলে ধারণা করা যায়।

তিনি বলেন, এটি যে ধরণের ভাইরাস, তা সাধারণত ফ্রিজের পরিবেশে বেশি সময় বাঁচতে পারার কথা। কিন্তু সেখানে ঠিক কতদিন বাঁচতে পারবে, এ ধরণের কোনো গবেষণা নেই। কোনো তথ্যপ্রমাণাদি নেই।

তবে সার্স নিয়ে করা গবেষণার ভিত্তিতে নভেল করোনাভাইরাসের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা তৈরি করতে চান না বিশেষজ্ঞদের অনেকেই।
গেল এপ্রিলে অস্ট্রেলিয়ার এবিসি রেডিওকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে অস্ট্রেলিয়ার ডেপুটি চিফ মেডিক্যাল অফিসার মাইকেল কিড বলেন, কোভিড-১৯ ফ্রিজে টিকে থাকতে পারে কিনা আর থাকলেও কতক্ষণ টিকতে সক্ষম, তা গবেষণার আগে বলা সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, সার্স নিয়ে গবেষণা হলেও নভেল করোনাভাইরাস সম্পর্কে তেমন কোনো কিছু হয়নি। কাজেই আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না, এ ভাইরাসটির বৈশিষ্ট্য সার্স করোনাভাইরাসের মতো কি না।
তাই ফ্রিজ ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু সাধারণ সতর্কতা অবলম্বন করার পরামর্শ দেন মাইকেল কিড।

ফ্রিজ ব্যবহারের ক্ষেত্রে কী ধরণের সতর্কতা নেবেন?

তিনি মন্তব্য করেন, ফ্রিজে রাখার পরে তো বটেই, আগেও সব খাদ্যপণ্য অথবা পণ্যের প্যাকেট অন্তত একবার জীবাণুমুক্ত করে নেয়া জরুরি।

মাইকেল কিড বলেন, বাইরে থেকে বাজার ঘরে এনে ফ্রিজে রাখার আগে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি বারবার হাত ধোয়ার বিষয়টিও মনে রাখতে হবে সবাইকে।

অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, সার্স’র মতো ফ্রিজে রাখা খাদ্যপণ্যের গায়ে বা প্যাকেটে নভেল করোনাভাইরাস লেগে থাকলে তা সপ্তাহ চারেক বেঁচে থাকতে পারে।

তাই বাজার করার পর পণ্য ফ্রিজে রাখার আগে ও ফ্রিজ থেকে বের করার পর তা জীবাণমুক্ত করার ব্যাপারে জোর দিচ্ছেন তারা।
ভাইরোলজিস্ট নজরুল ইসলাম বলেন, ফ্রিজে রাখা খাবারের প্যাকেট বের করার পর সেটি জীবাণুনাশক মেশানো কাপড় দিয়ে ভালো করে মুছে নেয়া প্রয়োজন।

ফ্রিজে রাখা শাকসবজি রান্না করার আগে কিছুক্ষণ সাবান মিশ্রিত পানিতে রেখে ধুয়ে নেয়ার উপদেশ দেন তিনি। 
তবে মাছ বা মাংসের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। তাই এগুলো যে প্যাকেটে বা পাত্রে রাখা হবে, সেটিকে জীবাণুমুক্ত করে নেয়া জরুরি বলে মন্তব্য করেন এ ভাইরোলজিস্ট।

নজরুল ইসলাম বলেন, এছাড়া যারা ফ্রিজ থেকে বের করা মাছ-মাংস কাটাকাটির দায়িত্বে থাকবেন, তাদের আক্রান্ত হওয়ার বেশি ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ফ্রিজ থেকে খাবার বের করা এবং রান্নার কাজ করার সময় বারবার হাত ধোয়ার অভ্যাস তৈরি করার উপদেশ দেন তিনি।

খ্যাতনামা এ ভাইরোলজিস্ট বলেন, ফ্রিজ থেকে বের করা মাছ-মাংস নিয়ে কাজ করবেন যারা, তাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং নিয়মিত ভিত্তিতে হাত ধোয়ার মতো বিষয়গুলো মেনে চলা গুরুত্বপূর্ণ। যে কাজে ভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনা রয়েছে, সেরকম প্রত্যেকটি ছোট ছোট কাজ শেষে মনে করে হাত ধোয়া জরুরি।