ঢাকা, ২৬ নভেম্বর মঙ্গলবার, ২০২৪ || ১২ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
৯৫৬

আসল হিসেব নেই সরকারি খাতায়!

ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার আশংকাজনক

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৩:০৮ ১৮ জুলাই ২০১৯  

রাজধানী ঢাকায় ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু রোগ। মারাত্মক এই রোগে মৃত্যু হচ্ছে অনেকের। কিন্তু সরকারি হিসেবে আসছে না তাদের সবার তথ্য।

 

এ বছর ডেঙ্গুতে পাঁচজনের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু প্রকৃত চিত্র আরও ভয়াবহ। এবছর চলতি সপ্তাহ পর্যন্ত এ রোগে মারা গেছে আরও অন্তত ১৪ জন।  

 

সম্প্রতি একটি সংবাদমাধ্যমে ডেঙ্গুতে ১১ জনের মৃত্যুর খবর প্রকাশের পর এই রোগ নিয়ে বিভ্রান্তি না ছড়াতে সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন।

 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, ১৭ জুলাই পর্যন্ত ঢাকায় পাঁচ হাজার ১৬৬ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এখন বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন এক হাজার ১১৬ জন।

 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে ২৯ এপ্রিল বিআরবি হাসপাতালে ৫৩ বছর বয়সী এক ব্যক্তি এবং আজগর আলী হাসপাতালে ৩২ বছর বয়সী এক যুবকের মৃত্যু হয় ডেঙ্গুতে। এরপর ১৬ জুন অ্যাপোলো হাসপাতালে মারা যায় ১১ বছরের এক শিশু, ২৯ জুন ইবনে সিনা হাসপাতালে ৪২ বছর বয়সী এক ব্যক্তি এবং ৩ জুলাই স্কয়ার হাসপাতালে ৪২ বছর বয়সী একজন চিকিৎসকের মৃত্যু হয়।

 

তবে ঢাকার কয়েকটি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট ১৯ জনের মৃত্যুর খবর মেলে।

এর মধ্যে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুজন, মহাখালীর ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনজন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুজন, ঢাকা শিশু হাসপাতালে দুজন, স্কয়ার হাসপাতালে তিনজন, ল্যাবএইড হাসপাতালে একজন এবং পুরান ঢাকার সালাহউদ্দিন স্পেশালাইজড হাসপাতালে একজনের মৃত্যু হয়েছে।

 

গত ১৫ জুলাই হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ফারিয়া আফরিন নামে ১৬ বছরের এক তরুণী। মালিবাগের গুলবাগের বাসিন্দা ফারিয়া ১৪ জুলাই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন।

 

এর আগে ২৫ মে এই হাসপাতালের আইসিইউতে মারা যান টঙ্গীর দত্তপাড়া এলাকার বাসিন্দা ৩৫ বছর বয়সী কামরুল হাসান খান।

 

এই দুজনেরই ডেঙ্গুর ‘শক সিনড্রোমদেখা দিয়েছিল বলে জানিয়েছে হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল।

 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ৩ জুলাই স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে যার মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করেছে, তিনি ডা. নিগার নাহিদ দীপু, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এমবিবিএস পাস করেছিলেন।

 

এছাড়া এই হাসপাতালে আরও তিন শিশুর মৃত্যু হয়েছে, যা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে আসেনি।

 

গত ১৫ জুলাই স্কয়ার হাসপাতালে মারা গেছে লাবণ্য আলিনা কাজী নামে চার বছরের এক শিশু। আলিনার বাবা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব মোহাম্মদ কাজী ফয়সাল জানান, ১০ জুলাই আলিনাকে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ডেঙ্গুর কারণে তার মৃত্যু হয়েছে বলে মৃত্যু সনদে উল্লেখ করা হয়েছে।

 

রাজধানীতে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া হলি ফ্যামিলি রেডক্রিসেন্ট হাসপাতালে খোলা হয়েছে শিশুদের জন্য বিশেষ ওয়ার্ড। বেসরকারি এই হাসপাতালেই গত ৫ জুলাই মারা যায় মো. ইরতাজা শাহাদ প্রত্যয় নামে সাত বছরের এক শিশু। প্রত্যয়ের মা চাঁদ সুলতানা চৌধুরানী কাস্টসমসের ডেপুটি কমিশনার। ছেলের মৃত্যুর জন্য স্কয়ারের চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ করা এই নারী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওপরও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

তিনি বলেন, সব কাগজপত্র স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আইইডিসিআরে দিয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত যে পাঁচজন মারা যাওয়ার তথ্য তারা দিচ্ছে সেখানে আমার বাচ্চার তথ্য নেই।

 

এর আগে গত ২৪ জুন স্কয়ার হাসপাতালে মারা যায় মগবাজারের বাটার গলির বাসিন্দা ইকবাল হোসাইনের ৫ বছরের মেয়ে সাবিকুন নাহার।

 

ইকবাল জানান, জ্বর হলে ২৩ জুন সকালে মেয়েকে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ভর্তি করেন। পরীক্ষায় তার ডেঙ্গু ধরা পড়ে। সেদিন সন্ধ্যায় তাকে স্কয়ার হাসপাতালের পিআইসিইউতে নেয়া হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় সে।

 

মহাখালীর ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে  ডেঙ্গু আক্রান্ত তিন শিশুর মৃত্যু হয়েছে, তাদের তথ্যও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকায় নেই।

 

গেল মঙ্গলবার রাতে হাসপাতালের পিআইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরহাম নূর নামে এক শিশু মারা গেছে। সে তৃতীয়বারের মতো ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল। সে একজন চিকিৎসকের সন্তান।

এর আগে গত ১১ জুলাই মো. সাদি নামে আরেক শিশু ডেঙ্গুতে মারা যায় ইউনিভার্সাল হাসপাতালে। সে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য ইয়াসিন মিয়ার সন্তান।

 

শিশুদের আইসিইউ সুবিধা সংবলিত এই হাসপাতালে এর আগে গত ২ জুন মারা যায় উমাইজা হোসাইন নামে আরেক শিশু। তাদের বাসা ঢাকার শান্তিনগর।

 

তার বাবা মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে ২৭ মে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ভর্তি করেছিলেন ছেলেকে। সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় ২৯ মে তাকে এই হাসপাতালের পিআইসিইউতে ভর্তি করি। সেখানেই মারা যায় উমাইজা।

 

এদিকে ঢাকা শিশু হাসপাতালে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ২ শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ সফি আহমেদ। বর্তমানে ডেঙ্গু আক্রান্ত ১০ শিশু সেখানে চিকিৎসাধীন। এদের চারজন সিসিআইউতে, বাকিরা ডেঙ্গু ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছে। মঙ্গলবার ১০ বছরের একটি শিশু এবং দুই বছর বয়সের আরেকটি শিশু মারা যায়। দুজনই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল।

 

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত দুজনের মৃত্যু হয়েছে। ১২ জুলাই জায়েদা বেগম নামে ৪৫ বছর বয়সী এক গৃহিণীর মৃত্যু হয়। আগারগাঁওয়ের বাসিন্দা জায়েদা ১১ জুলাই এ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। হাসপাতাল থেকে দেয়া মৃত্যু সনদে তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে ‘ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের কথা বলা হয়েছে।

 

এর দুদিনের মাথায় ১৪ জুলাই ডেঙ্গু আক্রান্ত আরেকজনের মারা যাওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেছেন হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. মামুন মোর্শেদ।

 

পুরান ঢাকার টিকাটুলির সালাউদ্দিন স্পেশালাইজড হাসপাতালে গত ২৮ জুন মারা যান নিগার সুলতানা রিপা নামে এক গৃহিণী। রিপার স্বামী আনোয়ার পারভেজ বলেন, ডেঙ্গু হলে ২৭ জুন ওই হাসপাতালে ভর্তি করেছিলেন স্ত্রীকে। পরদিনই মারা যায় সে। মৃত্যু সনদে বলা হয়েছে, ডেঙ্গুর ফলে রিপার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।

 

বুধবার ভোরে ল্যাবএইড হাসপাতালে ডেঙ্গুতে মারা গেছেন হাসি সমাদ্দার নামে বক্ষব্যাধি হাসপাতালের একজন নার্স। তিনি মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে তিনি মারা যান।

 

সরকারি তথ্যের গরমিল বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের সহকারি পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার জানান, ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হলে তা নিশ্চিত করার জন্য রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডেথ রিভিউ কমিটি রয়েছে। তারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে - এমন তথ্য পেলে সরেজমিন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে সে সব তথ্য যাচাই-বাছাই করে। তবেই ডেঙ্গুজ্বরে মৃত্যু হয়েছে বলে জানা যায়। তখন ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা প্রকাশ করা হয়।

 

ডেঙ্গুতে মৃতের এ হিসেব সম্পর্কে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তারা মৃতের সংখ্যা প্রকাশ করেন। এ জন্য সংখ্যায় গড়মিল হতে পারে।

 

তিনি বলেন, আমাদের একটা ডেথ রিভিউ কমিটি আছে। তারা বিভিন্ন হাসপাতালের ডকুমেন্ট, টেস্ট রিপোর্ট, পেশেন্টের লোকজনের সঙ্গে কথা বলা এবং স্যাম্পল নিয়ে আসা হয়। এগুলো আমাদের এখানে পরীক্ষা করা হয়। সব কিছু কম্পাইল করার পর আমাদের এক্সপার্টরা যখন নিশ্চিত হন যে ডেঙ্গু, সেটা আমরা রিপোর্টে দেখাই। আপনি যাদের কথা বলছেন, হয়ত সেগুলো আমাদের এখানে এখনও রিভিউ পর্যায়ে আছে। যখন নিশ্চিত হব, সেগুলোও যোগ হয়ে যাবে।

 

মেয়র সাঈদ খোকন এতদিন বলে আসছিলেন, ঢাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে। গত মাসে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব শুরু হলে এ নিয়ে নগরবাসীকে আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন ‘ক্ল্যাসিকাল ডেঙ্গু সাত থেকে ১০ দিনের মধ্যে এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে।

 

তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, এবার ডেঙ্গু মারাত্মক হয়ে দেখা দিয়েছে। ডেঙ্গুতে রক্তের প্লাটিলেট কমার পাশাপাশি মস্তিষ্ক, ফুসফুস, লিভার, কিডনিসহ বিভিন্ন অঙ্গ আক্রান্ত হচ্ছে।

তাই জ্বর হলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পরামর্শ তদের।