ঢাকা, ২৪ নভেম্বর রোববার, ২০২৪ || ১০ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
৪১৭

স্বচ্ছতা ছিল কেলেংকারির!

ঢাকাই মসলিন : যতো অজানা কাহিনি

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৩:১৪ ৯ এপ্রিল ২০২১  

ঢাকাই মসলিন। প্রায় দুশো বছর আগে এটি  ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে দামী কাপড়। কিন্তু তার পর পুরোপুরিই হারিয়ে গেছে এটি।

 

ঢাকায় এখনো জামদানি নামে মসলিনের শাড়ি তৈরি হয় বটে - কিন্তু তার সাথে দুশো বছর আগের ঢাকাই মসলিনের অনেক তফাত।

 

সেই মসলিন তৈরির পদ্ধতি ছিল একেবারে অন্যরকম - তাতে ব্যবহৃত হতো বিশেষ ধরনের তুলা - যা এখন আর পাওয়া যায় না।

 

কীভাবে বিলুপ্ত হলো প্রাচীন ঢাকাই মসলিন? একে কি আবার পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব? এ নিয়ে বিস্তারিত ফিচার তৈরী করেছে বিবিসি। 

 

মসলিনের স্বচ্ছতা ছিল কেলেংকারির!

 

অষ্টাদশ শতাব্দীর ইউরোপে শুরু হয়েছিল এমন এক নতুন ফ্যাশন - যা আবার জন্ম দিয়েছিল এক আন্তর্জাতিক কেলেংকারির।

 

সমাজের একটি গোটা শ্রেণীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল যে, তারা নগ্ন অবস্থায় জনসমক্ষে উপস্থিত হচ্ছেন। এর জন্য দায়ী জিনিসটি ছিল ঢাকাই মসলিন - এক ধরনের দামী কাপড় - যা তৎকালীন ঔপনিবেশিক ভারতের বেঙ্গল প্রদেশের ঢাকা শহর থেকেই আসতো - যা আজকের বাংলাদেশের রাজধানী।

 

মসলিনের শাড়ি এখনো বাংলাদেশে তৈরি হয় - যার নাম জামদানি - তবে আধুনিক কালের মসলিনের সাথে সেই প্রাচীন যুগের মসলিনের অনেক তফাৎ।

 

সেকালে মসলিন তৈরি হতো ১৬ ধাপের এক জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে। তাতে ব্যবহৃত হতো এক দুর্লভ জাতের তুলা থেকে তৈরি সূতা। সেই তুলা জন্মাতো মেঘনা নদীর পাড়ে।

 

সে যুগে মসলিনের মর্যাদা ছিল ধনরত্নের মতই। আর ঢাকাই মসলিনের সমাদর ছিল সারা পৃথিবী জুড়ে।

 

সেই সুখ্যাতি তৈরি হয়েছিল হাজার হাজার বছর ধরে। প্রাচীন গ্রিসে মনে করা হতো মসলিনই হচ্ছে দেবীদের মূর্তিকে পরানোর উপযুক্ত কাপড় । দূরদূরান্তের বহু রাজ্যের রাজারা পরতেন এই মসলিন। আর ভারতের মোগল রাজবংশে তো অনেক প্রজন্ম ধরে পরা হয়েছিল মসলিনের পোশাক।

 

সে যুগেও মসলিন ছিল অনেক রকমের। তবে এর মধ্যেও সবচেয়ে সূক্ষ্ম আর দামী মসলিনের প্রশংসা করে নানা নাম দিতেন রাজকীয় কবিরা। একটি নাম ছিল 'বাফৎ হাওয়া' - অর্থাৎ 'বাতাস দিয়ে বোনা কাপড়'।

 

নামেই বোঝা যাচ্ছে, এসব উচ্চস্তরের মসলিন ছিল হাওয়ার মতই হালকা আর নরম।

 

একজন ভ্রমণকারী বর্ণনা করেছেন তিনশ' ফুট লম্বা (৯১ মিটার) মসলিনের থান গোটানো-অবস্থায় এতই নরম ছিল যে তা একটা আংটির মধ্যে দিয়ে গলে যেতো। আরেকজন লিখেছেন ৬০ ফুট লম্বা একটি মসলিন ভাঁজ করে রাখা যেতো একটি নস্যির কৌটায়।

 

তার ওপরে - ঢাকাই মসলিন ছিল একেবারে স্বচ্ছ।

 

ঐতিহ্যগতভাবে অত্যন্ত দামী এই কাপড় দিয়ে তৈরি হতো শাড়ি আর পুরুষদের জামা। কিন্তু ব্রিটেনে এই মসলিন আসার পর তা সমাজের বিত্তশালীদের পোশাকের ধরন পাল্টে দিল। তাদের মধ্যে এমন এক ধরনের হালকা লম্বা ধরনের 'শেমিজ-গাউন' পোশাক জনপ্রিয় হলো - যা অনেকটা তারও আগের যুগে অন্তর্বাস বলে গণ্য হতো।

 

সেযুগে ব্যঙ্গাত্মক ছবি এঁকে জনপ্রিয় হয়েছিলেন আইজাক ক্রুইকশ্যাংক বলে একজন শিল্পী। তার একটি প্রিন্ট আছে যার শিরোনাম "১৮০০ সালের শীতের পোশাকে প্যারিসের মহিলারা"। এতে কয়েকজন মহিলাকে দেখা যাচ্ছে তারা উজ্জ্বল রঙের লম্বা ছাঁটের মসলিনের পোশাক পরে আছেন। সে পোশাক এতই স্বচ্ছ যে তাদের নিতম্ব, স্তনের বোঁটা, এমনকি যৌনকেশ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে।

 

তার পরেও ঢাকাই মসলিন ছিল 'হিট' পোশাক - অবশ্য তাদের জন্য যাদের এটা কেনার মত অর্থ ছিল।

 

সে যুগে সবচাইতে দামী পোশাক ছিল মসলিন। এর বিখ্যাত ভক্তদের মধ্যে ছিলেন ফ্রান্সের রানি মেরি আঁতোয়ানেৎ, ফরাসী সম্রাজ্ঞী জোসেফিন বোনাপার্ত, এবং লেখিকা ইংরেজ লেখিকা জেন অস্টেন।

 

কিন্তু মসলিন সেই 'এনলাইটমেন্ট' যুগের ইউরোপে যেমন হঠাৎ চমক সৃষ্টি করেছিল - তেমনি হঠাৎ করেই তা আবার অদৃশ্যও হয়ে গেল।

 

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে পুরো পৃথিবী থেকেই অদৃশ্য হয়ে যায় ঢাকাই মসলিন। তার যে ক'টি নমুনা টিকে ছিল - তার স্থান হয়েছে ইউরোপের জাদুঘরে, বা মূল্যবান ব্যক্তিগত সংগ্রহে।

 

মসলিন বোনার যে জটিল প্রক্রিয়া - তা-ও লোকে এক সময় ভুলে গেল। শুধু তাই নয় - মসলিন বানাতে যে "ফুটি কার্পাস" নামে বিশেষ ধরনের তুলা ব্যবহৃত হতো - হঠাৎ করে তাও গেল বিলুপ্ত হয়ে।

 

এই ফুটি কার্পাসের বোটানিক্যাল নাম ছিল গোসিপিয়াম আরবোরেটাম ভার নেগ্লেক্টা। এটা ছাড়া আর কোন তুলা দিয়ে মসলিন তৈরি হতো না।

 

প্রশ্ন হলো, কেন আর কি করেই বা এমন হলো? একে আবার ফিরিয়ে আনার কি কোন উপায়ই নেই?

 

এক নাজুক আঁশ


ঢাকাই মসলিনে ব্যবহৃত তুলার গাছ জন্মাতো মেঘনা নদীর তীর ঘেঁষা মাটিতে। এই মেঘনা হচ্ছে গঙ্গা অববাহিকার সবচেয়ে বড় নদীগুলোর একটি। এর পাতা দেখতে অনেকটা মেপলের মত।

 

প্রতি বসন্তকালে ধূসর পলিমাটিতে এই গাছ জন্মাতো, আর পূর্ণবয়স্ক গাছে বছরে দু'বার একটি করে ড্যাফোডিলের মত হলুদ রঙের ফুল হতো। সেই ফুল থেকে পাওয়া যেতো তুষারশুভ্র তুলা।

 

এই তুলা কোন সাধারণ তুলা নয়।

পৃথিবীতে এখন যে তুলা উৎপাদিত হয় - তার ৯০ শতাংশই হচ্ছে মধ্য আমেরিকা থেকে আসা গোসিপিয়াম হিরসুটাম জাতের তুলা। তার আঁশ হচ্ছে সরু আর লম্বা আকৃতির।

 

কিন্তু ফুটি কার্পাস থেকে যে সূতা হয় তা খাটো আর মোটা ধরনের, তার আঁশ সহজেই আলগা হয়ে যায়। এ বর্ণনা শুনলে মনে হতে পারে, এ তুলা কোন কাজে লাগার মতো নয়।

 

আসলেই, ছোট আঁশওয়ালা এই তুলা মেশিন ব্যবহার করে সস্তা কাপড় বোনার উপযোগী ছিল না। এটা হাতে ধরে কাজ করা কঠিন, একে পেঁচিয়ে সূতা বানাতে গেলে খুব সহজেই ছিঁড়ে যায়।

 

কিন্তু স্থানীয় লোকেরা এই তুলাকেই কাপড় বোনার উপযুক্ত করে তুললেন - তাদের নিজস্ব কিছু পদ্ধতি ব্যবহার করে ।

পুরো প্রক্রিয়াটাতে ১৬টি ধাপ আছে।

 

সেই টেকনিক এতই বিশেষ ধরনের যে তা করতে জানতেন শুধু ঢাকার কাছে অন্য আরেকটি গ্রামের লোকেরা। এতে যোগ দিতেন গ্রামের ছেলে-বুড়ো, নারী-পুরুষ সবাই।

 

প্রথমে সেই তুলোর দলাগুলো পরিষ্কার করা হতো বোয়াল মাছের দাঁত দিয়ে - যে রাক্ষুসে মাছ তখন ওই এলাকার নদীতে বা বিলে পাওয়া যেতো।

 

তুলাকে চরকা দিয়ে সূতায় পরিণত করা হয়। এই তুলার আঁশ যেহেতু ছোট ছোট তাই একে টেনে লম্বা করার জন্য বাতাসে উচ্চ আর্দ্রতা দরকার হতো। সে জন্য এই কাজটা করা হতো নৌকার ওপর, ভোরে বা সন্ধ্যায় যখন বাতাসে আর্দ্রতা বেশি থাকে। চরকা কাটার কাজ করতেন দক্ষ অল্পবয়সী মহিলারা। কারণ এই সূতা এতই সূক্ষ্ম হতো যে বয়স্ক মানুষরা তা দেখতে পেতেন না।

 

"এভাবে বোনা সূতাতে একটা রুক্ষতা থাকতো -যা হাতে ধরলে একটা চমৎকার অনুভূতি হতো" - বলছিলেন ডিজাইন ইতিহাসবিদ সোনিয়া এ্যাশমোর, যিনি ২০১২ সালে মসলিনের ওপর একটি বই লিখেছেন।

এর পর হচ্ছে আসল কাজটা - সেই সূতা দিয়ে কাপড় বোনা।

 

শত কোটি টাকার শাড়ি কিনেও নারীদের খুশি করা যায়নি

এই প্রক্রিয়ায় কখনো কখনো মাসের পর মাস লেগে যেতো। কারণ মসলিন কাপড়ে যে বিশেষ ধনরনের জ্যামিতিক ফুলেই ডিজাইন থাকতো তা সরাসরি কাপড় তৈরির সময়ই যোগ করা হতো।

 

এতে যে টেকনিক ব্যবহৃত হতো তা মধ্যযুগের ইউরোপে রাজকীয় কাপড়ের ডিজাইনের পদ্ধতির সাথে মিলে যায়। এর পলে যে কাপড় তৈরি হতো - তা দেখতে হতো হাজার হাজার রেশমি-রূপালি সূতোর স্তরের ওপর তৈরি করা সূক্ষ্ম শিল্পকর্মের মতো।

 

এশিয়ার বিস্ময়


পশ্চিমা ক্রেতারা সে যুগে মসলিন দেখে বিশ্বাস করতে পারতেন না যে ঢাকাই মসলিন মানুষেরই হাতে বোনা। এমন গুজবও ছিল যে এই মসলিন বুনেছে মৎস্যকন্যা, পরী বা ভূতেরা।

 

"মসলিন ছিল এত নরম আর এত হালকা যে এ যুগের কোন কাপড়ের সাথেই তার কোন তুলনা চলে না" - বলছিলেন রুবি গজনভী, বাংলাদেশের ন্যাশনাল ক্র্যাফট কাউন্সিলের ভাইস প্রেসিডেন্ট।

 

মসলিন বোনার আসল কৃতিত্ব ছিল এর বুননের সূক্ষ্মতায় - এত মিহি বুননের কাপড় কিভাবে এর কারিগররা বানাতে পেরেছিলেন।

 

এই হিসাবকে একে বলে থ্রেড কাউন্ট - অর্থাৎ প্রতি বর্গইঞ্চি কাপড়ে লম্বালম্বি এবং আড়াআড়ি কতগুলো সূতা ব্যবহৃত হয়েছে।

 

ঢাকাই মসলিনকে পুনরুজ্জীবিত করার একটি প্রকল্পের প্রধান হচ্ছেন সাইফুল ইসলাম। তিনি ব্যাখ্যা করছেন, "আজকাল যে মসলিন তৈরি হয় তাতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই থ্রেড কাউন্ট থাকে ৪০ থেকে ৮০র মধ্যে । যেমন সাধারণভাবে ৮০ থ্রেড কাউন্ট মানে হলো প্রতি বর্গ ইঞ্চি কাপড়ে আড়াআড়ি-লম্বালম্বি মোটামুটি ৮০টি সূতো আছে। "

"কিন্তু সে যুগের ঢাকাই মসলিনে এই থ্রেড কাউন্ট হতো ৮০০ থেকে ১২০০-র মধ্যে"- বলছেন তিনি।

এত বেশি থ্রেড কাউন্ট মানে হলো সেই কাপড় হতো অত্যন্ত নরম এবং টেকসই ।

ফুটি কার্পাস থেকে সূতা তৈরি করা খুব কঠিন। পুরোনো যুগের মসলিনের থ্রেড কাউন্ট হতো ১২০০ পর্যন্ত, তবে সম্প্রতি ঢাকায় ৩০০ কাউন্ট পর্যন্ত মসলিন বানানো হয়েছে। 

 

যদিও আমরা যে ঢাকাই মসলিনের কথা বলছি তা এক শতাব্দীরও বেশি আগে বিলুপ্ত হয়ে গেছে - কিন্তু অনেক দেশের জাদুঘরে পুরোনো মসলিনের শাড়ি, ওড়না, বা অন্যান্য পোশাক দেখা যায়। ক্রিস্টি বা বনহ্যামসের মতো উচ্চস্তরের নিলামে কখনো কখনো এরকম দু-একটি মসলিন উঠতে দেখা যায় - আর তা বিক্রি হয় হাজার হাজার পাউণ্ড দামে।

 

ঔপনিবেশিক যুগের বিপর্যয়


"মসলিনের বাণিজ্য গড়ে উঠেছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে - একে ধ্বংসও করেছে তারাই" - বলছিলেন এ্যাশমোর।

 

ইউরোপের অভিজাত মহিলাদের গায়ে মসলিনের পোশাক ওঠার অনেক আগে তা বিক্রি হতো সারা দুনিয়া জুড়ে।

প্রাচীন গ্রিকদের মধ্যেও জনপ্রিয় ছিল এই মসলিন।

 

প্রাচীন যুগে মসলিন ব্যবহারের উল্লেখ প্রথম সম্ভবত দেখা যায় রোমান লেখক পেট্রোনিয়াসের লেখায় - সেখানে তিনি মসলিন কাপড় কত স্বচ্ছ তা নিয়ে মন্তব্য করেছেন।

 

"একজন নববধূর জন্য মসলিনের মেঘের নিচে প্রকাশ্যে নগ্ন হয়ে দাঁড়ানো - আর বাতাস দিয়ে তৈরি পোশাক পরে দাঁড়ানো একই কথা" - লিখেছিলেন তিনি।

 

পরবর্তী কালে বহু বিদেশী পর্যটকের লেখায় মসলিনের প্রশংসা দেখা গেছে। এদের অন্যতম চতুর্দশ শতাব্দীর বারবার-মরোক্কান ইবনে বতুতা, এবং পঞ্চদশ শতাব্দীর চীনা পর্যটক মা হুয়ান।

 

সম্ভবত মোগল শাসনকালই ছিল ভারতবর্ষে মসলিনের স্বর্ণযুগ। এই সাম্রাজ্য স্থাপিত হয়েছিল ১৫২৬ সালে এখনকার উজবেকিস্তানের একজন সমরনায়কের হাতে। অষ্টাদশ শতক নাগাদ প্রায় পুরো ভারতীয় উপমহাদেশই ছিল মোগল শাসনাধীন।

 

এই সময়টায় পারস্য (আধুনিক যুগের ইরান) ইরাক তুরস্ক আর মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা বণিকদের সাথে বিপুল পরিমাণ মসলিনের বাণিজ্য হতো।

 

মোগল বাদশাহ এবং তাদের স্ত্রীরা মসলিনের খুব ভক্ত ছিলেন। সেযুগের চিত্রকলায় তাদেরকে মসলিন ছাড়া অন্যকিছু পরিহিত অবস্থায় প্রায় দেখাই যায়না।

 

মসলিনের সেরা কারিগরদের তারা পৃষ্ঠপোষকতা করতেন, তাদের সরাসরি নিয়োগ দিতেন এবং তাদের সেরা কাপড়গুলো অন্য কারো কাছে বিক্রি করতে দেয়া হতো না।

 

মসলিনের স্বচ্ছতা মোগল যুগেও সমস্যার কারণ হয়েছিল।

 

জনশ্রুতি আছে যে বাদশাহ আওরঙ্গজেবের কন্যা সাত পাক দিয়ে মসলিন পরার পরও সম্রাট তাকে 'নগ্ন হয়ে প্রকাশ্যে আসার জন্য' তিরস্কার করেছিলেন।

 

সবকিছু ভালই চলছিল - ব্রিটিশরা ভারতে আসার আগ পর্যন্ত।

 

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৯৩ সাল নাগাদ মোগল সাম্রাজ্য দখল করে নেয়। তার এক শতাব্দীরও কম সময়ের মধ্যে ভারত চলে যায় ব্রিটিশ রাজের নিয়ন্ত্রণে।

 

যুক্তরাজ্যে মসলিনের প্রথম প্রদর্শনী হয় ১৮৫১ সালে - 'ওয়ার্ক অব ইন্ডাস্ট্রি অব অল নেশন্স' নামে এক মহা-প্রদর্শনীতে।

 

এর পরিকল্পনা করেছিলেন রানি ভিক্টোরিয়ার স্বামী প্রিন্স অ্যালবার্ট। তার চিন্তাটা ছিল, তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নানা চমকপ্রদ জিনিস তার প্রজাদের সামনে তুলে ধরবেন। লন্ডনের ক্রিস্টাল প্যালেসে ৪০ মিটার উঁচু কাচের গ্যালারিতে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আনা প্রায় ১ লক্ষ জিনিস তুলে ধরা হলো সেই প্রদর্শনীতে।

 

তখনকার দিনে এক গজ ঢাকাই মসলিনের দাম ছিল ৫০ থেকে ৪০০ পাউণ্ড পর্যন্ত - আজকের মূল্যমানে ৭,০০০ থেকে ৫৬,০০০ পাউণ্ড। সেই যুগের সবচেয়ে ভালো সিল্কের চাইতেও এই মসলিন ছিল ২৬ গুণ বেশি দামী।

 

কিন্তু ভিক্টোরিয়ান লন্ডনের অভিজাতরা যখন মসলিন নিয়ে মুগ্ধ - তখন সেই মসলিনের উৎপাদকরা ঋণের বোঝা আর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে আটকা পড়েছে।

 

গুডস ফ্রম দি ইস্ট নামে একটি বইয়ে বলা হয়েছে, অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ঢাকাই মসলিন তৈরির প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করতে শুরু করে।

 

ওই অঞ্চলে মসলিনের যারা স্বাভাবিক ক্রেতা ছিল - তাদের পরিবর্তে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের লোকেরা নতুন ক্রেতা হয়ে দাঁড়ায়।

 

এ্যাশমোর বলছিলেন, কোম্পানি নানা ভাবে উৎপাদনের প্রক্রিয়া এবং সম্পূর্ণ বাণিজ্যটিই নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। তাঁতীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়, কম দামে আরো বেশি পরিমাণ মসলিন কাপড় তৈরির জন্য।

 

সাইফুল ইসলাম - যিনি একটি ফটো এজেন্সির পরিচালনার সাথেও জড়িত - তিনি বলছেন, "মসলিন উৎপাদন একটা কঠিন এবং পরিশ্রমসাধ্য প্রক্রিয়া। এর জন্য দরকার বিশেষ ধরনের দক্ষতা। এক কিলোগ্রাম ফুটি কার্পাস থেকে মাত্র আট গ্রাম সূক্ষ্ম মসলিন তৈরি হয়। "

 

বর্ধিত চাহিদার সাথে তাল মেলাতে গিয়ে তাঁতীরা ঋণের জোলে আটকা পড়লো। একটা কাপড় তৈরি করতে এক বছর পর্যন্ত সময় লাগতো । কিন্তু কাপড় যদি মান অনুযায়ী না হতো তাহলে তাদের দাম ফেরত দিতে হতো। তারা কখনোই ঋণ শোধ করতে পারছিল না - বলছিলেন এ্যাশমোর।

 

আরো বড় আঘাত হয়ে এলো প্রতিযোগিতা।

 

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো ঔপনিবেশিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব শিল্পের ওপর নির্ভর করতো - তার সমস্ত খুঁটিনাটি তারা নথিভুক্ত করতো। মসলিন তৈরি প্রতিটি ধাপের প্রক্রিয়ার বিস্তারিত বিবরণ লিখে রাখতো তারা।

 

ইউরোপে যখন বিলাসবহুল কাপড়ের চাহিদা বাড়লো তখন তাগিদ তৈরি হলো যে ঘরের কাছেই এর অপেক্ষাকৃত সস্তা সংস্করণ উৎপাদন করতে হবে।

 

উত্তর-পশ্চিম ইংল্যান্ডের ল্যাংকাশায়ারের কাপড় ব্যবসায়ী স্যামুয়েল ওল্ডনো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অর্জিত জ্ঞান আর নতুন প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে উন্নত তাঁত দিয়ে লন্ডনের ক্রেতাদের জন্য বিপুল পরিমাণে কাপড় বানাতে শুরু করলেন। ১৭৮৪ সাল নাগাদ তার কারখানায় কাজ করতো ১০০০ তাঁতী।

 

ব্রিটিশদের তৈরি মসলিন মানের দিক থেকে ঢাকাই মসলিনের ধারেকাছেও ছিল না।

 

এই মসলিন বানানো হতো সাধারণ তুলা দিয়ে। এর থ্রেড কাউন্টও ছিল অনেক কম। কিন্তু এর ফলে হঠাৎ করেই ঢাকাই মসলিনের চাহিদা কমে গেল, তার সাথে ছিল দশকের পর দশকের অত্যাচার। দুয়ে মিলে ডেকে আনলো ঢাকাই মসলিন শিল্পের মৃত্যু ।

 

এর পর যুদ্ধ, দারিদ্র্য আর ভূমিকম্পের মত আরো কিছু কারণে অনেক তাঁতী নিম্ন মানের কাপড় বানানোর দিকে চলে গেল, অনেকে পেশা বদলে কৃষক হয়ে গেল।

 

শেষ পর্যন্ত মসলিন তৈরি পুরোপুরিই বন্ধ হয়ে গেল। ঢাকাই মসলিন কীভাবে বানাতে হয় সেই বিদ্যা হারিয়ে গেছে।

 

"এটা মনে রাখতে হবে যে এটা ছিল একটা পারিবারিক পেশা। আমরা তাঁতীদের কথা বলি, তাদের দারুণ কাজের কথা বলি - কিন্তু এসব কাজের পেছনে ছিল নারীরা - তাঁত-চরকার কাজ করতো তারাই" বলছিলেন হামিদা হোসেন, মানবাধিকার কর্মী যিনি বাংলার মসলিন শিল্পেও ওপর একটি বই লিখেছেন।

 

এর পর প্রজন্মের পর প্রজন্ম পার হয়ে গেল - আর ঢাকাই মসলিন কীভাবে বানাতে হয় সেই বিদ্যাও হারিয়ে গেল।

 

যেহেতু মসলিন নেই - তাই সেই ফুটি কার্পাসের গাছও ধীরে ধীরে অপরিচিত জংলী গাছে পরিণত হয়ে গেল।

 

দ্বিতীয় জন্ম


সাইফুল ইসলামের জন্ম বাংলাদেশে - তবে প্রায় ২০ বছর আগে তিনি লন্ডনে প্রবাসী হন।

 

তিনি যে প্রতিষ্ঠানে তিনি কাজ করতেন - সেই 'দৃক'কে ঢাকাই মসলিনের ওপর একটি ব্রিটিশ প্রদর্শনীকে বাংলাদেশী দর্শকদের জন্য পরিবেশনের প্রস্তাব দেয়া হয় ২০১৩ সালে। এর মধ্যে দিয়েই তিনি ঢাকাই মসলিন সম্পর্কে সচেতন হন।

 

তারা অনুভব করলেন যে উদ্যোগটিতে খুঁটিনাটি অনেক কিছুর অভাব আছে - তাই তারা নিজেরাই এ নিয়ে এক গবেষণা শুরু করলেন।

 

পরের এক বছরে সাইফুল এবং তার সহকর্মীরা স্থানীয় শিল্পের সাথে জড়িত লোকজনের সাথে কথা বললেন। যে অঞ্চলে এটা তৈরি হতো সেই এলাকাটা ঘুরে দেখলেন এবং ইউরোপের মিউজিয়ামগুলোতে ঢাকাই মসলিনের নমুনাগুলো সন্ধান করলেন।

 

"লন্ডনের ভিক্টোরিয়া এ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়ামে শত শত মসলিন আছে। ইংলিশ হেরিটেজ ট্রাস্টে ২০০০টি মসলিন আছে, কিন্তু বাংলাদেশে একটিও নেই" - বলছিলেন সাইফুল।

 

শেষ পর্যন্ত ঢাকায় মসলিনের ওপর একাধিক প্রদর্শনী হলো। একটি চলচ্চিত্র নির্মাণে হাত দেয়া হলো, সাইফুলের লেখা একটি বই প্রকাশিত হলো।

 

এক পর্যায়ে তারা ভাবতে শুরু করলেন, হয়তো এই ঐতিহাসিক বস্ত্রটি আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব হলেও হতে পারে।

এ লক্ষ্য নিয়েই তারা বেঙ্গল মসলিন নামে তারা একটি যৌথ উদ্যোগ চালু করলেন।

 

তাদের প্রথম কাজ ছিল মসলিন উৎপাদনের উপযোগী তুলার গাছ খুঁজে বের করা। তখন ফুটি কার্পাসের বীজ কারো সংগ্রহেই ছিল না।

 

কিন্তু লন্ডনের কিউ গার্ডেনের রয়াল বোটানিক গার্ডেনের সংগ্রহে তারা খুঁজে পেলেন ফুটি কার্পাসের শুকনো সংরক্ষিত অনেকগুলো পাতা - যা সংগৃহীত হয়েছিল উনবিংশ শতাব্দীতে।

 

এটা থেকে তারা ফুটি কার্পাসের ডিএনএ সিকোয়েন্স তৈরি করতে সক্ষম হলেন। তাদের হাতে এসে গেল এর জেনেটিক রহস্য। এ নিয়ে তারা বাংলাদেশে পিরে এলেন।

 

এর পর শুরু হলো ফুটি কার্পাস গাছ খুঁজে বের করার কাজ। তারা মেঘনা নদীর পুরোনো মানচিত্র পরীক্ষা করলেন, তাকে আধুনিক উপগ্রহ চিত্রের সাথে মিলিয়ে সম্ভাব্য জায়গাগুলো চিহ্নিত করলেন - যেখানে এখনো সেই গাছ পাওয়া যেতে পারে।

 

তার পর তারা নৌকা ভাড়া করে সে সব জায়গায় গিয়ে জংলী গাছের মধ্যে ফুটি কার্পাস খুঁজে বেড়াতে লাগলেন।

 

যেখানে যে তুলোর গাছ পাওয়া গেল তার জেনেটিক সিকোয়েন্স তৈরি করা হলো - আসলটির সাথে তা মিলিয়ে দেখা হলো। এক পর্যায়ে তারা এমন একটি কার্পাস গাছ খুঁজে পেলেন - যা ফুটি কার্পাসের সাথে ৭০ শতাংশ মিলে যায় ।

 

এই কার্পাস উৎপাদনের জন্য তারা ঢাকার ৩০ কিলোমিটার উত্তরে মেঘনার একটি দ্বীপ নির্বাচন করলেন। সাইফুল বলছিলেন, "জায়গাটি ছিল আদর্শ খুবই উর্বর এবং নদীর পলি দিয়ে তৈরি জমি।"

 

এখানে ২০১৫ সালে তারা পরীক্ষামূলকভাবে কিছু বীজ বপন করলেন। কিছুকালের মধ্যেই সেখান থেকে গজালো ফুটি কার্পাসের সারি সারি গাছ - কয়েক শতাব্দীর মধ্যে এই প্রথম আবাদ।

 

সেই বছরই দলটি ফসল হিসেবে তাদের প্রথম তুলা পেলেন। যদিও তারা শতভাগ খাঁটি ঢাকা মসলিন বানানোর জন্য যথেষ্ট ফসল পাননি, কিন্তু তারা ভারতীয় তাঁতীদের সাথে যৌথ উদ্যোগে সাধারণ ও ফুটি কার্পাস তুলা মিলিয়ে একটি হাইব্রিড সূতা তৈরি করলেন।

 

তবে এই সূতা দিয়ে মসলিন বুনতে গিয়ে তারা দেখলেন কাজটা অনেক জটিল।

 

বাংলাদেশে এখন যে মসলিন তৈরি হয় তার নাম জামদানী মসলিন - এটার থ্রেড কাউন্ট পুরোনো ঢাকাই মসলিনের চেয়ে অনেক কম। তবে এটা তৈরি করতে জানেন এমন অনেক তাঁতী বাংলাদেশে আছেন।

 

সাইফুল ভেবেছিলেন, তিনি এই কারিগরদের দক্ষতা বৃদ্ধি করবেন এবং তাদের শেখাবেন কিভাবে পুরোনো ঢাকাই মসলিনের কাছাকাছি মানের কাপড় তৈরি করা যায়।

 

সাইফুল তাঁতীদের বললেন, তিনি ৩০০ থ্রেড কাউন্টের শাড়ি উৎপাদন করতে চান।

 

"কিন্তু তাদের কেউই এ কাজ করতে চাইলো না। সত্যি কথা বলতে কি- তারা বললো এটা পাগলামি" - বললেন সাইফুল।

অন্তত ২৫ জন তাঁতীর সাথে কথা বললেন সাইফুল।

 

শেষ পর্যন্ত একজন রাজি হলেন। তার নাম আল-আমিন। তিনি এখন তাদের প্রকল্পের প্রধান তাঁতী।

 

আল আমিন তার ওয়ার্কশপে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ এবং আর্দ্রতা রক্ষার যন্ত্রপাতি বসালেন - যাতে সেই সূক্ষ্ম সূতা তৈরি করা যায়।

 

অন্তত ৫০টি মত যন্ত্র দরকার ছিল তাদের - যা এখন আর পাওয়া যায় না। সুতরাং প্রকল্পের কারিগররা নিজেরাই সেগুলো বানিয়ে নিলেন।

 

ছয় মাসের কঠোর পরিশ্রম শেষে আমিন ৩০০ থ্রেড কাউন্টের একটি শাড়ি বানাতে সক্ষম হলেন।

 

সেটা আসল ঢাকাই মসলিনের মানের কাছাকাছি নয়। কিন্তু গত অনেক প্রজন্মের তাঁতীরা যা বানিয়েছেন - তার চেয়ে অনেক উন্নত মানের।

 

এর পর কয়েক বছর পার হয়েছে। সাইফুল ও তার দল ২০২১ সাল নাগাদ অনেকগুলো শাড়ি বানিয়েছেন - তাদের হাইব্রিড মসলিন থেকে। ইতোমধ্যেই তা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রদর্শিত হয়েছে এবং তার কোন কোনটি হাজার হাজার পাউণ্ড দামে বিক্রিও হয়েছে।

 

সাইফুল এখন বলছেন, এই সমাদর থেকে তার ধারণা হয়েছে যে মসলিনের একটা ভবিষ্যৎ আছে।

 

"এটা হচ্ছে ম্যাস প্রোডাকশন বা একসাথে বিপুল পরিমাণ পণ্য উৎপাদনের যুগ, কিন্তু সে কারণেই যা বিশিষ্ট, অনন্য - এমন জিনিসের প্রতি মানুষের আগ্রহ আছে। মসলিন এখনো একটা শক্তিশালী ব্র্যান্ড" - বলেন তিনি।

 

সাইফুল আশা করেন, একদিন তারা এমন একটি বিশুদ্ধ ঢাকাই মসলিন শাড়ি বানাতে সক্ষম হবেন - যার থ্রেড কাউন্ট হবে ৩০০-র চেয়ে অনেক বেশি।

 

সাইফুল তার দেশের ভাবমূর্তি উন্নত করতে চান। তিনি বলছেন, "এটা জাতীয় মর্যাদার ব্যাপার। যেহেতু আমাদের দেশে অনেক গার্মেন্টস কারখানা আছে, তাই আমাদের পরিচয় এখন আর দরিদ্র নয়, কিন্তু এটাও গুরুত্বপূর্ণ যে এ দেশ পৃথিবীর সর্বকালের সূক্ষ্মতম কাপড়েরও দেশ।"

 

কে জানে, হয়তো একটি নতুন প্রজন্মকে শীগগিরই পরতে দেখা যাবে একটি প্রাচীন বস্ত্র - এবং তার অতি স্বচ্ছতার জন্য হয়তো একটু বিব্রতও হতে হবে।