ঢাকা, ২১ নভেম্বর বৃহস্পতিবার, ২০২৪ || ৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
১০৫৭

তবুও ভালোবাসি নিউইয়র্ক

শামীম আল আমিন

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১১:৪৫ ৪ এপ্রিল ২০২০  

শামীম আল আমিন  :  যখন এই লেখাটি লিখছি তখন চারপাশ ঘন অন্ধকারে ঢেকে আছে। ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেও যেন ভয়। অন্ধকার কখনো এত তীব্র হয়, দেখিনি! রাতের এই সময়টাতেও অনেক মানুষের আনাগোনা থাকার কথা। ছুটির আগের রাতে রাস্তায় অসংখ্য গাড়ী থাকবে, মানুষ একটু দেরি করেই ঘরে ফিরতে থাকবে; এমনটাই নিয়ত চিত্র।

কিন্তু যখন লেখাটি লিখছি তখন যেনো কোথাও কেউ নেই। কেবল হঠাৎ বুকের মধ্যে কাঁপন তুলে দু’একটি অ্যাম্বুলেন্সের যাওয়া আসার শব্দ কানে আসছে। বাইরের অন্ধকার এমনি, যেন চোখ খুলে রাখা কিংবা বন্ধ রাখা দুটোই সমান।

এমন পরিস্থিতিতে হঠাৎ করেই কেন জানি আর “ভয়” লাগছে না। বরং চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে “ভালোবাসি নিউইয়র্ক” তবুও ভালোবাসি প্রাণের শহর।

জানি রহস্যময় একটি ভাইরাস থামিয়ে দিয়েছে নিউইয়র্কের প্রাণচঞ্চল জনজীবন। এ যেন এক রূপকথার গল্প। বাস্তবে এর আগে যা দেখা হয়নি কখনো। পৃথিবীর রাজধানী বলা হয় যে নিউইয়র্ককে, যে শহরে মানুষে মানুষে ঠাসা, পৃথিবীর প্রতিটি দেশের অন্তত একজন হলেও মানুষের বাস যে শহরে; সেই শহর হঠাৎ করে এমন নিরব নিথর হয়ে গেল! ভাবতে অদ্ভূত লাগে।

নিয়ন আলোয় ভূতুরে এক একটি রাস্তা। সভ্যতার সমৃদ্ধির উজ্জ্বলতম সময়েও এমন চিত্র যেন কল্পণার বাইরে। কেবল মানুষের মৃত্যুর মিছিল। মৃত্যুর কোন জাতপাত নেই। মরছে সবদেশি। সবাই আমেরিকান। করোনা কোন রাজা-উজির-ভৃত্য চেনে না। কার শরীরের কি রঙ, করোনা চেনে না। মারা যাচ্ছে প্রবাসী প্রিয় ভাইটি; মারা যাচ্ছে অন্য কোন আমেরিকান; হয়তো তারও এই শহরটাকে নিয়ে গর্বের শেষ ছিল না।

আমেরিকার এমন দুর্দিনে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে থাকা কিছু “অপমানুষ” এক ধরণের দানবীয় উল্লাসে ফেটে পড়ছেন। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে কিছু কিছু দেখি। চুপ করে থাকি। কারণ জানি, মানুষ হিসেবে তারা “ভুল মানুষ”। দুর্যোগের এই কালে তারা বরং নিজেদেরকে “মানুষ” হিসেবে পরিচয় দিতে পারতেন। আমি বলি কি, “সংকটকাল থাকবে না। চিরদিন থাকে না”।

এখনো বেঁচে আছি এই শহরে। সামনে অনিশ্চয়তা। যদিও ফ্লোরিডা থেকে বন্ধুরা বলেছিলো, শহর ছেড়ে চলে যেতে। গরমের ঐ স্টেটে সংক্রমণ একটু কম। কিন্তু পালিয়ে কি সত্যিই বাঁচা যায়! কোথায় যাবো এই নিউইয়র্ক ছেড়ে? নিউইয়র্কের প্রতিটি মানুষকে কি সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া সম্ভব? এই শহরটি বেঁচে যাবে, এমন আশায় লড়ছে। বরং সেই লড়াইয়ে আমিও আছি। আছে আমার ছোট্ট পরিবারটি। “আমি আছি নিউইয়র্ক”।

দিনে দিনে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। কিছুক্ষণ আগেই সবগুলো মোবাইলে অ্যালার্ট জারি হয়েছে, স্বাস্থ্যকর্মীদের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে খোঁজা হচ্ছে। নিশ্চিত জানি, যারা এখনো নাম লেখাননি, তারাও ঝাঁপিয়ে পড়বেন। কারণ পালিয়ে থাকার মানুষ নিউইয়র্কাররা নয়। করোনার বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে এই শহর।


বিপুল সংখ্যক মানুষকে একসাথে স্বাস্থ্যসেবা দিতে হয়, এমন দৃশ্য পৃথিবীর কোথাও চেনা নয়। অদৃশ্য আততায়ীর বিরুদ্ধে এ এক অন্য লড়াই। অসংখ্য ডাক্তার, নার্স অবসর ভেঙে এগিয়ে এসেছেন। পালিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা; বরং অন্য স্টেট থেকে বিমান বোঝাই করে অনেক ডাক্তার ও নার্স আসছেন নিউইয়র্কের পাশে দাঁড়াতে। আর এটাইতো আমেরিকার সৌন্দর্য!

যাদের বাইরে না গেলে চলে, নিয়ম মেনে তারা নিজেদের বন্দী রাখছেন এই শহরে। যারা বের হচ্ছেন, এমন দূর্যোগে তারা ঠিকই রাস্তায় নিয়ম মেনে গাড়ী চালাচ্ছেন। কোন অঘটনে এখনো দ্রুত পুলিশ চলে আসছে। দূরত্ব মেনে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে মুখ ঢেকে প্রয়োজনীয় ওষুধ কিংবা খাবার কিনছেন মানুষ।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি তো হতে দেখিনি এখনো। কেউ তো কারো খাবার ছিনিয়ে নিচ্ছে না! প্রতিটি মানুষ হৃদয় দিয়ে এই লড়াইয়ে যুক্ত। অপ্রস্তুতির শুরুর অভিযোগ কাটিয়ে উঠে, প্রশাসনও চেষ্টা চালাচ্ছে। জীবন বাঁচানোর এই যুদ্ধে সবাই আছে।

করোনা রোগীতে ভর্তি হাসপাতালগুলো। সাধারণ অন্য জরুরী চিকিৎসায় নগরের মানুষ কি করবে, বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে! তাতো হতে পারে না। তাই ছুটে এসেছে জাহাজ হসপিটাল ইউএসএনএস কমফোর্ট। পৃথিবী বিখ্যাত জ্যাকব জেভিট কনভেশন সেন্টার হয়ে গেছে হাসপাতাল। মনোরম সেন্ট্রাল পার্কে গেলেও দেখবেন চিকিৎসা দেয়ার সব ব্যবস্থা সেখানে করা হয়েছে।

চিকিৎসা সামগ্রীর অপ্রতুলতা আছে। ঘাতকের চরিত্র ও চিকিৎসা এখনো জানা নেই। এরপরও ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা জান বাজি রেখে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। কারো মধ্যে পালিয়ে যাওয়ার কোন তাড়া নেই। এত এত লাশের মিছিলে এরপরও তারা দাঁড়িয়ে আছেন। পরম মমতা আর আত্মবিশ্বাসের ছোঁয়ায় তারা যেনো বলছেন, “এই মৃত্যুপুরীতে তুমি তো একা নও”। যে কারণে মৃত্যু ভয় উপেক্ষা করেই একজন ডাক্তার ফেরদৌস খন্দকার শক্ত ঝাণ্ডা নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে যান।

আমেরিকার সেনাবাহিনী, পুলিশ, জরুরী সেবাদানকারী মানুষগুলো জীবনকে সংশয়ে ফেলে দিনরাত কাজ করছেন। তাদের দেশপ্রেম আমার ভেতরে অন্য এক ভালোবাসা জাগায়। যে মানুষগুলোর প্রতিদিনের গার্বেজ নিয়ে যাওয়ার কথা, দায়িত্ব ভুলছেন না তারাও।

ধনী মানুষ, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো হাত গুটিয়ে বসে নেই। বসে নেই সরকার। বিজ্ঞানীরা প্রতিষেধক ও ওষুধ তৈরির প্রাণান্ত চেষ্টায় আছেন। আমাদের হয়তো কিছু “ভুল” আছে, তবুও এই যুদ্ধে দেশপ্রেমিক আমেরিকানরা যেভাবে নিজেদের আত্মোৎস্বর্গ করেছেন, তাতে এতটুকু “ভুল” নেই।

অনেক ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীও আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন। কর্নেলিয়া গ্রিগস নামে নিউইয়র্কের একটি হাসপাতালের একজন চিকিৎসক তার অবুঝ সন্তানের উদ্দেশ্যে কয়েকদিন আগে একটি টুইট করেছেন। অত্যন্ত আবেগঘন ভাষায় তিনি লিখেছেন, “যদি আমার সন্তানেরা আমাকে হারায়, তাহলে অন্তত বড় হয়ে তারা জানবে, মা মানুষকে বাঁচানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন”।

ডা. গ্রিগস চোখে জল এসে গেলো। বার বার এই জলে ভেজা চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে। আপনারা আছেন। অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে জেনেও, আমি মনোবল হারাতে চাই না। যুদ্ধতো চলছে! হারি জিতি, “তবুও নিউইয়র্ক তোমাকেই ভালোবাসি”।

 

লেখক : শামীম আল আমিন, আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক  

প্রবাস বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর