ঢাকা, ২১ নভেম্বর বৃহস্পতিবার, ২০২৪ || ৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
৩৮৫

দই ও বইয়ের ফেরিওয়ালা জিয়াউল হক

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২১:০২ ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪  

চাঁপাইনবাবগঞ্জের জিয়াউল হক ফেরি করে করে দই বিক্রি করেন। সংসার চালানোর পর বাড়তি টাকা থাকলে তা দিয়ে বই কিনে গরিব ছাত্রদের মধ্যে বিলি করেন। তাঁর দেওয়া বই ও আর্থিক সহায়তা পেয়ে অনেকেই স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে চাকরি করছেন। দই বিক্রির টাকায় তিনি বাড়িতে একটা লাইব্রেরী গড়ে তুলেছেন যেখানে ১৪ হাজার বই আছে। এ ছাড়াও তিনি গরিব–অসহায় নারীদের অনেককে বাড়ি করে দিয়েছেন। গ্রামে গ্রামে নলকূপ বসিয়ে দিয়েছেন। অসহায় মানুষদের খাদ্য ও বস্ত্র দিয়েও সহায়তা করে আসছেন অনেক বছর থেকে।

 

সাধারণের মতো দেখতে অসাধারণ এই মানুষটা এবার সমাজসেবায় একুশে পদক পেয়েছেন।‌ মানুষজন তাকে শুভেচ্ছা জানাতে বাড়িতে গিয়ে দেখেন, জীবিকার তাগিদে তিনি তখন দই বিক্রি করতে বেরিয়েছেন ৯০ বছরের জিয়াউল হক! কারণ বাড়িতে চাল কেনার টাকা নেই।

 

কী অসাধারণ মানবজীবন! সত্যি বলছি আজকাল রাষ্ট্রীয় পদক পাওয়া অনেক মানুষের নাম আর আমাকে বিস্মিত বা বিমোহিত করে না। কিন্তু জিয়াউল হকের পুরস্কার এবং জীবনী জেনে বিমোহিত! মনে হলো পদকটা অন্তত একজন সত্যিকারের মানুষ খুঁজে পেয়েছেন। আমি মনে করি আমাদের পাঠ্যবইয়ে বিখ্যাত মানুষের জীবনীর সাথে এইসব মহৎ প্রাণ মানুষের গল্পগুলো থাকা উচিত যাতে ভবিষ্যতে প্রজন্ম মানবিক হতে শেখে।

 

জিয়াউল হক চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলার মুসরিভূজা বটতলা গ্রামের বাসিন্দা। প্রথম আলোয় আমার সাবেক সহকর্মী চাঁপাইনবাবগঞ্জের আনোয়ার ভাই লিখেছেন, পুরস্কার পাওয়ার খবরে তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, শুভাকাঙ্ক্ষীদের ভিড়। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রহনপুর স্টেশন বাজারে গিয়ে দেখা যায়, একটি ওষুধের দোকানের সামনে বসে দই বিক্রিতে ব্যস্ত তিনি। কারণ ভীষণ যত্ন করে বানানো তাঁর দই আশেপাশের সবাই পছন্দ করেন। আর সেই দিন বিক্রির টাকায় চলে তাঁর জীবন। চলে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কাজ।

 

জিয়াউল হক জানান, ১৯৫৫ সালে তিনি পঞ্চম শ্রেণি পাস করে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হতে চান। কিন্তু বাড়ি বাড়ি গরুর দুধ দোহন করে জীবিকা নির্বাহ করা বাবা বই কেনার জন্য দেড় টাকা দিতে পারেননি। উচ্চবিদ্যালয়েও ভর্তি হওয়া হয়ে ওঠেনি আর। এরপর বাবার সংগ্রহ করা দুধ দিয়ে দই তৈরি করে ফেরি করে বিক্রি করা শুরু করেন। দু–তিন বছর পর কিছু টাকা জমলে ভাবেন যারা তাঁর মতো টাকার অভাবে বই কিনতে না পেরে লেখাপড়া থেকে ছিটকে পড়তে পারে, তাদের তিনি এই টাকা দিয়ে বই কিনে দেবেন। তবেই তাঁর বিদ্যালয়ে পড়তে না পারার বেদনা লাঘব হবে।

 

এরপর থেকে গরিব ছাত্রদের মধ্যে বই বিলি শুরু করেন। যত দিন পর্যন্ত সরকার বই বিনা মূল্যে দেওয়া শুরু করেনি, তত দিন পর্যন্ত তিনি বই দিয়েছেন। আর সরকার বিনামূল্যে স্কুলে বই দেওয়া শুরু করলে উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক শ্রেণির ছাত্রদের বই দিতে থাকেন জিয়াউল। তাঁর দেওয়া বই পড়ে ও আর্থিক সহায়তা পেয়ে অনেকেই স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে চাকরি করছেন। শুধু তা–ই নয়, দই বিক্রি করা টাকায় যে লাইব্রেরী করেছেন তাতে এখন ১৪ হাজার বই আছে। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধের বইও আছে পাঠাগারে। কারণ জিয়াউল হক মনে করেন শুধু পাঠ্যবই পড়ে ছাত্রদের জ্ঞান অর্জন হবে না।

 

জিয়াউল হকের কথা পড়তে পড়তে চোখ ভিজে যাচ্ছিল। কী অসাধারণ মানবজীবন! আমি সবসময় বলি লিখি আরেকজন মানুষের জন্য যিনি ভাবতে পারেন তাদের জন্য করতে পারেন তিনিই সত্যিকারের মানুষ। জিয়াউল হক তেমনি মানুষ। আজকের সকালটা তাই জিয়াউল হককে শ্রদ্ধা জানিয়ে শুরু করছি। শ্রদ্ধা সব মানবিক মানুষের জন্য যারা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ান! আসুন আমরা মানবিক হই। নিজের যেটুকু আছে তাই নিয়ে আরেকজনের পাশে থাকি। মানুষকে ভালোবাসি। এই ভালোবাসায় ভরে উঠুক এই দেশ, এই পৃথিবী!

 

লেখক: শরিফুল হাসান

গবেষক ও সাংবাদিক

মুক্তমত বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর