ঢাকা, ২০ ডিসেম্বর শুক্রবার, ২০২৪ || ৬ পৌষ ১৪৩১
good-food
১৬

পূর্বাচল লেকে কিশোর-কিশোরীর লাশ: কীভাবে মৃত্যু?

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৪:৪৯ ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪  

একদিনের ব্যবধানে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার পূর্বাচলের একটি লেকে ভেসে উঠে দুই কিশোর-কিশোরীর মরদেহ। তাদের একজন দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী এবং অপরজন দশম শ্রেণির ছাত্র। পরিবারের বলছে, তারা দুজন বন্ধু। বিজয় দিবসের দিন বিকালে তারা বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন; পরে আর তারা বাসায় ফেরেনি।

 

পুলিশের ভাষ্য, দুই বন্ধু মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। তাদের মোটরসাইকেলটিও লেক থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। তবে পুলিশের এই ভাষ্যে পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন নিহতদের পরিবারের লোকজন। তারা তাদের সন্তানের মৃত্যুর ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেছেন। বুধবার সকালে পূর্বাচল উপ-শহরের ৪ নম্বর সেক্টরের বউরারটেক এলাকার লেক থেকে ১৬ বছর বয়সী সাঁইনুর রশীদ কাব্যের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ওই লেকেই পাওয়া যায় কাব্যের নীল রঙের মোটরসাইকেলটি।

 

রাজধানীর কাফরুল থানার কচুক্ষেত বউবাজারের হারুনুর রশীদের ছেলে কাব্য আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের ব্যবসায় শিক্ষা শাখার দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল।একদিন আগে মঙ্গলবার সকালে ভেসে ওঠে কাব্যের বন্ধু সুজানা আক্তারের মরদেহ। ওইদিন সুজানার ভ্যানিটি ব্যাগ ও একটি হেলমেট পাওয়া যায়।

 

প্রয়াত আব্বাস মিয়ার কন্যা ১৭ বছর বয়সী সুজানাও তার মা ও বড়ভাইয়ের সঙ্গে কাফরুল থানার কচুক্ষেত এলাকায় থাকতেন। সে ভাসানটেক সরকারি কলেজের বিজ্ঞান শাখার দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ত।বুধবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের মর্গের সামনে সুজানার মা চম্পা বেগমের সঙ্গে কথা হয়। ময়নাতদন্তের পর আইনি জটিলতা শেষ করে কন্যার মরদেহ বুঝে পেতে সকাল থেকে মর্গের সামনে অপেক্ষা করছিলেন তিনি। যদিও তখনও ময়নাতদন্ত হয়নি।

 

সুজানার মা চম্পা বেগম জানান, বিজয় দিবসের সন্ধ্যায় টিউশন পড়ানোর জন্য বাসা থেকে বের হয় সুজানা। মেয়েকে বাসা থেকে রাস্তায় কিছু পথ এগিয়েও দিয়ে আসেন তিনি। এরপর আর বাসায় ফেরেনি এ কলেজছাত্রী। রাত ৯টার দিকে তার মোবাইল নম্বরে কল করলে সেটি বন্ধ পান মা।কথা বলতে বলতে একমাত্র কন্যার শোকে মর্গের সামনেই চিৎকার করে কেঁদে উঠেন চম্পা।

 

কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, “সারারাত মেয়ের জন্য টেনশন করছি। নানান জায়গায় খোঁজ-খবর করেও কোনো কিছু পাইনি। পরে থানায় যোগাযোগ করলে ওর মৃত্যুর খবর পাই। আমার মেয়ের এমন মৃত্যু হইব ভাবতেও পারিনি।”

 

সুজানার বাবা মারা গেছেন চার বছর। বড়ভাই মেহেদী হাসান আহসানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করে বেরিয়েছেন। চাকরি খুঁজছেন তিনি। বাবাহীন সুজানা নিজের পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য টিউশনি করতেন। একইসঙ্গে জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য উচ্চ মাধ্যমিকের নির্বাচনি পরীক্ষারও প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। চিকিৎসক হবার স্বপ্ন ছিল সুজানার।

 

“আমাদের ভালো ব্যবসা ছিল। ওর বাবা মারা যাওয়ার পর আমাদের আর্থিক পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যায়। মেয়েটা আমার টিউশনি করে নিজের টুকটাক খরচ চালাত। নিজের পরীক্ষার জন্য কয়েকটা টিউশনিও ছেড়ে দিয়েছিল। কত স্বপ্ন ছিল আমার মায়ের। ওর মুখটা আমি এখন কেমনে দেখমু, সহ্য করতে পারি না বাবা”, কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন চম্পা।

 

পরিবারের সদস্যরা জানান, জুলাই-অগাস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেও সক্রিয় ছিল সুজানা। ছোটবেলা থেকে সাইকেল চালাতে পছন্দ করত সে। মোটরসাইকেল চালানোরও শখ ছিল তার। প্রায়শই বন্ধুদের সঙ্গে বাইকে করে ঘুরতে বের হত। তবে, বিজয় দিবসের সন্ধ্যায় কাব্যর সঙ্গে মোটরসাইকেলে ঘুরতে বেরিয়েছে, এ বিষয়টি জানতেন না সুজানার পরিবারের সদস্যরা।

 

বিষয়টি জানত না কাব্যর পরিবারও। তবে কাব্য ও সুজানার বন্ধুত্বের বিষয়ে উভয় পরিবারের সদস্যরা অবগত ছিলেন।কাব্যর মা সোনিয়া রশিদ বলেন, নিজের মোটরসাইকেল নিয়ে প্রায়ই ঘুরতে বের হত কাব্য। ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায়ও মোটরসাইকেল নিয়ে বের হয় সে। রাত ৯টার দিকে সর্বশেষ মোবাইলে মায়ের সঙ্গে কথা হয় তার। যদিও পরে আর বাসায় ফেরেনি সে। বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগের পরও কাব্যের কোনো সন্ধান না পেয়ে রাজধানীর কাফরুল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করা হয়।

 

যদিও সাধারণ ডায়েরি শুরুতে থানা পুলিশ নিতে চায়নি বলে অভিযোগ করেন তিনি। পরে তারা র‌্যাবের দ্বারস্থ হন। কিন্তু র‌্যাব জানায়, জিডি ছাড়া তারা তদন্তকাজ শুরু করতে পারবেন না। অনেক অনুরোধের পর ভোর ৪টার দিকে জিডি রেকর্ড করা হয় বলে জানান সোনিয়া।

 

তিনি জানান, কাব্যের ফুফাতো ভাই আর সুজানা সহপাঠী। একই কোচিংয়ে যাতায়াতের সুবাদে সুজানার সঙ্গে কাব্যের পরিচয় হয়। মাসখানেক হয়েছে তাদের বন্ধুত্ব হয়েছে।“সুজানা একাধিকবার আমাদের বাড়িতেও এসেছে। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর যে তারা দুজন একত্রে মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়েছে তা জানতাম না। ওই রাতে কাব্য বাসায় না ফেরায় সুজানার আরেক বন্ধুকেও কল করেছিলাম, কিন্তু সেও তখন কিছু বলেনি। আমরা তখনও জানতাম না তারা দুজন ঘুরতে বেরিয়েছে। এমনটা জানলে সেই স্পটগুলোতেই তাদের খুঁজতাম।”

 

সোনিয়ার দুই ছেলের মধ্যে কাব্য ছিল বড়। তার ছোট ছেলে শাহনূর রশীদ কল্প নৌবাহিনী স্কুল অ্যান্ড কলেজের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র।ছেলের মৃত্যুকে ‘বিনা প্রশ্নে’ স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিতে পারছেন না কাব্যের মা সোনিয়া। তিনি বলেন, “পুলিশ জানিয়েছে, ওরা মোটরসাইকেল নিয়ে দুর্ঘটনা করেছে। কিন্তু আমার কাছে ব্যাপারটা এত স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। আমি রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি।

 

“আমার কেবল দাবি থাকবে, পুলিশ যেন বিষয়টা নিয়ে ডিটেইলে তদন্ত করেন। আসলেই দুর্ঘটনা হয়েছে নাকি অন্য কিছু। দেশে তো কত কিছুই ঘটছে।”সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়েছেন সুজানার পরিবারের সদস্যরাও। তার মামা সাদ্দাম চৌধুরী বলেন, “আমরা চাই, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে রহস্য উদঘাটন হোক। কোনো কিছু বলে দিলেই তো হবে না। গুরুত্ব দিয়ে যেন পুলিশ এই কাজটি করে, সেই দাবি জানাই।”

 

এদিকে দুপুরে নিজ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর বিষয়ে কথা বলেন জেলা পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার। নারায়ণগঞ্জ শহরের আরেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর হত্যাকাণ্ডেরর বিষয়ে ওই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল।তখন সাংবাদিকরা পূর্বাচলের দুই শিক্ষার্থীর প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পুলিশ সুপার বলেন, “প্রাথমিক তথ্য ও আলামতের ভিত্তিতে মনে হচ্ছে, দুই শিক্ষার্থী মোটরসাইকেলে থাকা অবস্থায় ওভারস্পিডের কারণে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন এবং মোটরসাইকেলসহ তারা লেকে পড়ে যান।

 

“এবং মোটরসাইকেলটি সুজানা চালাচ্ছিলেন বলেও আলামত পাচ্ছি। কিন্তু মৃত্যুর সঠিক কারণ জানার জন্য দুজনের মরদেহের ময়নাতদন্ত হবে। তাছাড়া, আশপাশের এলাকার সিসিটিভি ক্যামেরার ভিডিও সংগ্রহের কাজ করছে পুলিশ।”তিনি বলেন, “তাদের মৃত্যুর পেছনে অন্য কোনো কারণ থাকলেও তা তদন্তে জানা যাবে।”

 

রাত ১০টার দিকে এ ঘটনায় দুটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে জানিয়ে রূপগঞ্জ থানার ওসি লিয়াকত আলী বলেন, “দুই পরিবারের পক্ষ থেকে দুটি মামলা হয়েছে। ময়নাতদন্তের পর মরদেহ দুটিও তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।”পূর্বাচল উপ-শহরের পাশে পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ে মানুষের কাছে ‘৩০০ ফুট সড়ক’ নামে অধিক পরিচিত। রাজধানীর অদূরে পূর্বাচলে রাজধানী ও আশপাশের এলাকা থেকে লোকজন ঘুরতে আসেন। উৎসব ও বিশেষ কোনো দিবসকে ঘিরে লোকজনের আনাগোনাও দিন দিন বাড়ছে।

 

অধিকাংশ লোকজনই মোটরসাইকেল কিংবা ব্যক্তিগত গাড়িতে আসেন। ঘুরতে আসা লোকজনকে কেন্দ্র করে পূর্বাচলের ৩০০ ফুট সড়কটির পাশে কিছু পিঠা ও খাবারের দোকানও গড়ে ওঠেছে। পর্যটকদের এই উঠতি চাপে সেখানে প্রায়ই ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। প্রশস্ত সড়কে অতিরিক্ত গতিতে যানবাহন চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনার সংবাদও পাওয়া যায়।

 

স্থানীয় সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী শিমুল বলেন, “৩০০ ফুট সড়কটির আশপাশে সেভাবে বাসস্থান গড়ে উঠেনি। জনশূন্য সড়কটির নীলা মার্কেট, বউরারটেক, জয় বাংলা চত্বর, ময়েজ উদ্দিন চত্বর এলাকাগুলো এখন ঢাকা এবং আশপাশের এলাকার লোকজনের কাছে জনপ্রিয় পর্যটন স্পট। রাত-বিরাতে তারা এখানে ঘুরতে আসেন।

 

“এরই সুযোগ নিচ্ছে ছিনতাইকারীসহ অপরাধীরা। পাশাপাশি দেখা যায়, এই সড়কটি দেশের সবচেয়ে প্রশস্ত সড়কগুলোর একটি। সে তুলনায় যানবাহনের চাপ তেমন থাকে না। ফলে গাড়ি ও মোটরসাইকেলগুলো এই সড়ক ও আশপাশের এলাকায় বেপরোয়া গতিতে চলাচল করতে গিয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়ছে।” বুধবার দুপুরেও পূর্বাচলের ৩ নম্বর সেক্টরের ভূঁইয়াবাড়ি ব্রিজ এলাকায় ৩০০ ফুট সড়কে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়কে প্রাণ গেছে আব্দুর রউফ (৩২) ও মো. শিপন (৩৫) নামে দুই ব্যবসায়ীর।

অপরাধ বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর