ঢাকা, ২৪ নভেম্বর রোববার, ২০২৪ || ১০ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
৩২৮

প্রতিদিন এক মুঠো ম্যাকাডেমিয়া বাদামে রোগ থাকবে দূরে

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১২:১৭ ১৮ জুলাই ২০২২  

বিশ্বজুড়ে যত ধরনের বাদাম পাওয়া যায়, সেই প্রজাতিগুলোর মধ্যে ম্যাকাডেমিয়া বাদাম সবচেয়ে মূল্যবান ও সুস্বাদু এবং আমার নিজের অত্যন্ত প্রিয়। অস্ট্রেলিয়ায় বিশ্বের সবচেয়ে দামি বাদাম হল ম্যাকাডেমিয়া। এতে মূল্যবান ফ্যাটি অ্যাসিড এবং ভিটামিন রয়েছে, যা ত্বক এবং চুলের জন্য বিশেষ উপকারী।

 

ম্যাকাডেমিয়া বাদাম (Macadamia) কাইন্ডাল প্রোটিন উদ্ভিদের পরিবারের অন্তর্গত, যা পৃথিবী গ্রহের কয়েকটি স্থানেই জন্মায়। এখানে প্রায় নয় ধরনের ম্যাকাডেমিয়া বাদাম আছে, যা খাওয়া হয় এবং ফার্মাকোলজিক্যাল ও চিকিৎসা কাজেও ব্যবহৃত হয়।

 

নয় ধরনের ম্যাকাডেমিয়া বাদামের মধ্যে পাঁচটি কেবল অস্ট্রেলিয়ান মাটিতেই জন্মায়। উদ্ভিদের অবশিষ্ট জাতগুলো ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র (ক্যালিফোর্নিয়া), হাওয়াই এবং দক্ষিণ আফ্রিকা ও কেনিয়ায় চাষ করা হয়।

 

তবে অস্ট্রেলিয়াকে ম্যাকাডেমিয়া বাদামের জন্মস্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অস্ট্রেলিয়ান ম্যাকাডেমিয়া বাদাম তার বিখ্যাত নামটি বিখ্যাত রসায়নবিদ জন ম্যাকাদামের কাছ থেকে পেয়ে গেলেন। উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ফার্দিন্যান্ট ফন মোলারের সেরা বন্ধু। যিনি ফলশ্রুতিতে উদ্ভিদের আবিষ্কারকারী হন। গত শতাব্দীর শুরুতে উদ্ভিদবিদরা ম্যাকাডেমিয়া বাদামের উপকারী বৈশিষ্ট্যগুলো অধ্যয়ন করতে শুরু করেছিলেন।

 

এটি লক্ষণীয় যে ম্যাকাডেমিয়া বাদাম সেই বিরল প্রজাতির ফল-ফলবাহী উদ্ভিদের অন্তর্ভুক্ত, যা তাপমাত্রা পরিবর্তন ভালোলভাবে সহ্য করে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠে ৭৫০ মিটার উচ্চতায়ও বৃদ্ধি পেতে পারে। ম্যাকাডেমিয়া বাদাম গাছগুলো ৭-১০ বছর বয়সে ফল ধরে। অধিকন্তু একটি গাছ কমপক্ষে ১০০ কেজি ম্যাকাডেমিয়া বাদামের ফসল দেয়।

 

বাদামটি গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ুতে বৃদ্ধি পায় এবং এটি খুবই "মজাদার" বাদাম হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি প্রায়শই পোকার আক্রমণ করে এবং গাছটি কেবল দশম বছরেই ফল দেয়। এটি একে তুলনামূলকভাবে বিরল করে তোলে এবং মান যোগ করে।

 

ম্যাকাডেমিয়া ১৫০ বছর আগে প্রথম বর্ণিত ছিল। প্রাথমিকভাবে সংগ্রহটি কেবল হাতে হাতে করা হতো। ধীরে ধীরে আরও অলক্ষিত উদ্ভিদের জাত উদ্ভাবিত হয়েছিল, যা এটি আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব করেছিল: হাওয়াই, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকাতে। তবে প্রধানত ম্যাকাডেমিয়া এখনও অস্ট্রেলিয়ায় বাড়ছে।

 

ম্যাকাডেমিয়া পুষ্টিগুণে ভরপুর। সর্বাধিক এটি বি ভিটামিন, ভিটামিন ই, এবং পিপি, সেই সঙ্গে খনিজ রয়েছে: ক্যালসিয়াম, সেলেনিয়াম, তামা, ফসফরাস, দস্তা, পটাসিয়াম। অন্যান্য বাদামের মতো ম্যাকাডেমিয়াতে ফ্যাটি অ্যাসিডের উচ্চ ঘনত্ব রয়েছে।

 

খাবারে ম্যাকাডেমিয়ার নিয়মিত ব্যবহার ত্বকের সমস্যা হ্রাস করে। এর রঙ এবং তেলাপূর্ণতাকে স্বাভাবিক করে তোলে। পুষ্টিকর ফ্যাটগুলোর জন্য চুলের অবস্থার উন্নতি করে।

 

নিউট্রিশনিস্টরা ওজন হ্রাসের জন্য এক মুঠো ম্যাকাডেমিয়ার সঙ্গে এক খাবারের পরিবর্তনের পরামর্শ দেন, যা অনুপস্থিত শক্তি পুনরায় পূরণ করবে এবং ক্ষুধা কমাবে। এছাড়াও বাদামের সংমিশ্রণে ওমেগা -৩ রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস করে, যা হৃৎপিণ্ড এবং ভাস্কুলার রোগ প্রতিরোধ করে।

 

ম্যাকাডেমিয়ায় প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম জয়েন্টগুলো এবং হাড়ের রোগগুলোর জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হতে পারে। এই বাদাম অন্যতম পুষ্টিকর। তাই প্রতিদিন সর্বোচ্চ পরিমাণ একটি ছোট মুঠো পণ্যটির প্রতি ব্যক্তিগত অসহিষ্ণুতা সম্ভব। তাই অ্যালার্জি আক্রান্তদের ম্যাকাডেমিয়া। সেই সঙ্গে নার্সিং মহিলাদের সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে, যাতে শিশুর প্রতিক্রিয়া না হয়। পেট, অন্ত্র, অগ্ন্যাশয় এবং লিভারের রোগের তীব্র পর্যায়ে ম্যাকাডেমিয়া খাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয় না।

 

ম্যাকাডেমিয়া থেকে একটি প্রসাধনী তেল উৎপাদিত হয়। এতে কুঁচকে মসৃণকরণ এবং ক্ষতিগ্রস্ত ত্বকের পুনরুত্থানকে ত্বরান্বিত করার বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এটি চুলের ফলিকেলগুলো শক্তিশালী করতেও ব্যবহৃত হয়।

 

ডিসট্রফিতে আক্রান্ত মানুষের ডায়েটে এই বাদামকে অন্তর্ভুক্ত করা দরকারী। গর্ভাবস্থায় দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতার পরে ম্যাকাডেমিয়া শক্তি পুনরুদ্ধারে সহায়তা করবে। এটি অকারণে নয় যে ম্যাকাডেমিয়া অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের ডায়েটের একটি ঐতিহ্যবাহী উপাদান, যারা বাচ্চাদের বিকাশে পিছিয়ে রয়েছে এবং সেই সঙ্গে যারা অসুস্থ তাদের বাদাম দেয়।

 

এই বাদামগুলোর উচ্চ ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম এবং আয়রন উপাদানগুলেঅ চিনির আকাঙ্ক্ষা হ্রাস করতে সহায়তা করে। একটি হাইপোথিসিস রয়েছে, যার অনুসারে মিষ্টিতে ঝাঁকুনির আকাঙ্ক্ষা অন্যান্য বিষয়গুলোর মধ্যেও ডায়েটে ফ্যাট এবং খনিজগুলোর ঘাটতির কারণে ঘটে। যাই হোক না কেন, মুষ্টিমেয় বাদাম অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর মিষ্টি।

 

ম্যাকাডেমিয়ার একটি মিষ্টি স্বাদ রয়েছে। এটি মিষ্টি এবং সালাদ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এক পাউন্ড ম্যাকাডেমিয়া বাদামের মূল্য ২৫ আমেরিকান ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় দুই হাজার টাকা)।

 

শুনতে অবাক লাগলেও এটিই সত্যি। ২০১৮ সালে ম্যাকাডেমিয়া বাদামের ওপর গবেষণা করা হয়। শুধু অস্ট্রেলিয়ায় নয়, হাওয়াইয়ের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও বাদাম সংগ্রহ করা হয়।

 

বাদামগুলোর ডিএনএ নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করে জানা যায়, তাদের ডিএনএ গঠনে অদ্ভুত রকমের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া গেছে।

 

‘প্ল্যান্ট সায়েন্স’-এর এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, অস্ট্রেলিয়ায় কুইন্সল্যান্ড এলাকার জিম্পি নামে একটি ছোট শহরে ১৯ শতকের পুরনো ম্যাকাডেমিয়া গাছ রয়েছে। সেই গাছ থেকে যে বাদাম পাওয়া যায়, তার ডিএনএ গঠনের সঙ্গেই সাদৃশ্য রয়েছে ম্যাকাডেমিয়া বাদামের।

 

কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ববিদ ক্রেইগ হার্ডনারের তথ্য অনুযায়ী, ১৮৯৬ সালে রবার্ট জর্ডন নামে এক ব্যক্তি কুইন্সল্যান্ড থেকে এই গাছের বীজ হনুলুলুতে নিয়ে যান। তার ভাইয়ের বাড়ির পেছন দিকে যে বাগান রয়েছে, সেখানে বীজগুলো পোঁতা হয়েছিল। কিন্তু সেই বীজ থেকে মাত্র ছটি গাছ বেড়ে ওঠে। কুইন্সল্যান্ডের গাছ এভাবেই হাওয়াই অঞ্চলে পৌঁছায়।

 

গবেষকরা জানিয়েছেন, এই গাছের বীজ থেকেই অধিকাংশ বাদাম উৎপাদন করা হয়। তাই উৎপাদনের মূল উৎস হিসেবে এই গাছটিকেই ধরা হয়। এজন্য এটি ‘ম্যাকাডেমিয়া গাছের চেঙ্গিজ খাঁ’ নামেও প্রসিদ্ধ।

 

জানা যায়, কুইন্সল্যান্ডের রাজধানী ব্রিসবেনে বোটানিক্যাল গার্ডেনে ১৮৫৮ সাল থেকে প্রথম ম্যাকাডেমিয়া বাদামের চাষ শুরু হয়। তার ঠিক দুই বছর পর এই বাদামের কেনাবেচা শুরু করেন কিং জ্যাকি। লোগান নদীর তীরে যে সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল, তার রাজা ছিলেন তিনি।

 

শুধু পুষ্টিগত উপাদানে ভরপুর থাকার জন্য নয়, ম্যাকাডেমিয়া বাদামের দাম বেশি হওয়ার পেছনে কারণ ভিন্ন। অস্ট্রেলিয়ার ৫০টি বৃহত্তম স্থাপত্যের মধ্যে উমবাইয়ের ‘বিগ ম্যাসেমেডিয়া নাট’ উল্লেখযোগ্য। ১৯৭৮ সালে এই থিম পার্কটি তৈরি করা হয়।

 

কুইন্সল্যান্ডের পর্যটন কেন্দ্রের মধ্যে এটি ছিল অন্যতম। ম্যাকাডেমিয়া বাদাম উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্রস্থল হিসেবে কুইন্সল্যান্ডকে মান্যতা দিতেই এই পার্কটি তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু ২০১৩ সালে এই পার্কটি বন্ধ হয়ে যায়।

 

লেখক: ইফতেখার মাহমুদ

খাদ্য বিশেষজ্ঞ ও পরামর্শক