ঢাকা, ২৫ নভেম্বর সোমবার, ২০২৪ || ১১ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
৬১৬

`প্লাজমা থেরাপি` নিয়ে দেশে কী হচ্ছে?

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৭:৫৮ ৮ জুন ২০২০  

করোনাভাইরাস রোগীদের প্লাজমা থেরাপি দেয়া নিয়ে দেশে সম্প্রতি ব্যাপক আগ্রহ দেখা গেছে। কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে যারা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছেন, তাদের শরীরে একধরনের অ্যান্টিবডি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। এমন ব্যক্তির রক্ত থেকে সংগ্রহ করা হয় প্লাজমা।

করোনা সংক্রমিত ব্যক্তির শরীরে সেই অ্যান্টিবডি প্রয়োগ করা হলে, তার শরীরেও সেই অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে কেউ কেউ সুস্থ হয়ে উঠেছেন। পরীক্ষামূলক প্রয়োগে এমনটা দেখা গেছে।

এ অ্যান্টিবডি আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে করোনা মোকাবেলা করে। আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে ভাইরাসকে অকেজো করতে সাহায্য করে। অবশ্য সব রোগীর শরীরে কাজ করার ব্যাপারে সন্দেহাতীত প্রমাণ না থাকায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এটাকে শুধু পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রাখার পরামর্শ দিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন এক চিত্র।

ফেসবুকে প্লাজমা চেয়ে আহ্বান:

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইদানীং প্রচুর গ্রুপ তৈরি হয়েছে। তারা নভেল করোনা থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছেন-এমন ব্যক্তিদের প্লাজমা দিয়ে জীবন বাঁচানোর আহবান জানাচ্ছেন। সুস্থ হয়ে ওঠা ব্যক্তিদের সঙ্গে রোগীদের যোগাযোগ তৈরি করতে সাহায্য করছেন। প্রাণঘাতি ভাইরাস প্রতিরোধে স্বতঃস্ফূর্ত কাজটি করছেন অনেকেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তৈরি হয়েছে এ সম্পর্কিত 'হ্যাশট্যাগ'।

অনেক রোগীর আত্মীয় সরাসরি ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে কোভিড-১৯ থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা ব্যক্তিদের সন্ধান করছেন। প্রতিদিন করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা যত বাড়ছে-এ সম্পর্কিত পোস্ট আরও বেশি চোখে পড়ছে।
করোনা থেকে সুস্থ হয়ে প্লাজমা দান করেছেন-এমন ব্যক্তিরাও ফেসবুকে জানান দিচ্ছেন। 'প্লাজমা ব্যাংক' তৈরির ব্যাপারেও আগ্রহ প্রকাশ করেছেন অনেকে। ফেসবুকে 'প্লাজমা' শব্দটি লিখে খুঁজে অন্তত ২০টি গ্রুপ পাওয়া গেছে। প্রায় সবগুলোতে লেখা রয়েছে এদের মূল উদ্দেশ্য মানুষকে সাহায্য করা।

এমন কয়েকটি গ্রুপে দেখা গেলো প্রতি ঘণ্টায় বহু মানুষ প্লাজমা দানকারীর খোঁজে ফোন নম্বর আর হাসপাতালের নামসহ পোস্ট দেয়া হচ্ছে। ফেসবুকে এমন একটি গ্রুপের উদ্যোক্তা করোনা থেকে সেরে ওঠা টেলিভিশন সাংবাদিক শাহাদাত হোসেন। তিনদিনে তার গ্রুপের সদস্য দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার।  তিনি বলছেন, আমি নিজে ভুগেছি তাই বুঝতে পারছি। কারো প্রিয়জন যদি আক্রান্ত হয় সে নিশ্চয়ই চাইবে শেষ চেষ্টা করে দেখি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন কী

শুধু পরীক্ষামূলক প্রয়োগের পর্যায়ে এটিকে রাখার পরামর্শ দিচ্ছে সংস্থাটি। ডব্লিউএইচও একটি অন্তর্বর্তীকালীন গাইডলাইন দিয়েছে। যাতে প্লাজমা থেরাপিকে 'ইনভেস্টিগেশনাল থেরাপিউটিকস' বলা হয়েছে।
তাদের বক্তব্য, কোভিড ১৯-এর চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপি সর রোগীর ওপর সন্দেহাতীতভাবে কাজ করে এমন কোনও প্রমাণ নেই। তাই এটি চিকিৎসার উদ্দেশ্যে ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, গবেষণার অংশ হিসেবে এর প্রয়োগে অংশ নিতে চাইলে লাভক্ষতি যাচাই করার পর একটি যোগ্যতাসম্পন্ন বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা কমিটি এবং নৈতিকতা বিষয়ক কমিটির কাছে থেকে অনুমোদিত হতে হবে।
প্লাজমা থেরাপি ব্যাবহারের আগে রোগীর কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে।িএটি ব্যবহারের পর ফলাফল পর্যবেক্ষণ করে, তা সঠিকভাবে নথিভুক্ত পূর্বক চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের অবহিত করতে হবে।

এ 'প্রটোকল' কতটা মানা হচ্ছে?

শুধু পরীক্ষার জন্য প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে। তবে বাংলাদেশে বেশ কিছু বেসরকারি হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় এ থেরাপি দেয়া হচ্ছে। ফেসবুক গ্রুপগুলোতে গেলে বিভিন্ন মানুষের পোস্টে বহু হাসপাতালের নাম রয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া প্রটোকল তারা কতটা মানছেন? সেই প্রশ্নে বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক ওনার্স এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ডা. মনিরুজ্জামান ভুঁইয়া বলছেন, সব জায়গায় দেয়া হচ্ছে তা সঠিক নয়। কয়েকটি জায়গায় দেয়া হচ্ছে। বিশ্বের অনেক দেশে এটি ব্যবহৃত হচ্ছে। যেহেতু করোনাভাইরাস একদম নতুন। এর কোনো চিকিৎসা নেই, ভ্যাকসিন নেই। তাই প্লাজমা থেরাপির ব্যাপারে রোগী ও তাদের আত্মীয়রা নিজেরাই বেশি আগ্রহী।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা বলছেন, আমাদের নিজেদের কোনো গাইডলাইন নেই। ডব্লিউএইচও যেভাবে বলবে, সেভাবেই আমরা এগোবো। সবার জন্যই যে প্লাজমা থেরাপি তা নয়। এজন্য অ্যান্টিবডি ম্যাচিং’র একটি বিষয় আছে। করোনা সব চিকিৎসাই এখন পরীক্ষামূলক। প্লাজমা থেরাপিও তাই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যদি রেকমেন্ড না করে তাহলে আমাদের সরকার বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও তা করবে না।

তিনি পরামর্শ দিচ্ছেন, এটা যেহেতু নতুন জিনিস। মানুষ ভয়ে সামান্য কিছু দেখলেই সেটার পেছনে ছুটছে। আমরা সবাইকে বলছি প্লাজমা থেরাপির জন্য ছুটোছুটি করবেন না। এটা সবার জন্য না। এটি প্রয়োগের বিষয়টি যেহেতু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রেকমেন্ডেড না, সেহেতু সেটা হাসপাতালগুলোকে আমরা বলে যাচ্ছি।

মরিয়া চেষ্টা

ফেসবুকে একটি গ্রুপে করোনাভাইরাস আক্রান্ত মায়ের জন্য প্লাজমা দানকারীর সন্ধান চেয়ে আবেদন করেছেন তামান্না আজিম। ঈদের দিন রাতে জানতে পারেন ৫৬ বছর বয়সী মায়ের করোনা পজিটিভ। ডায়াবেটিসের রোগী হওয়ায় তৈরি হয় শারীরিক জটিলতা এবং এখন তার অবস্থা বেশ সংকটাপন্ন হয়ে উঠেছে।

তিনি বলছেন, আমার মায়ের অক্সিজেন লেভেল ৮৩ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যা হয় আমরা এখন এতটাই মরিয়া। আমরা শেষ চেষ্টা করছি।

প্লাজমা থেরাপিতে সন্দেহাতীতভাবে ভালো ফল মেলার যে কোনও প্রমাণ নেই সেই বিষয়ে তামান্না জেনেই মায়ের জন্য এর ব্যবস্থা করতে চাইছেন। তিনি বলছেন, আমাদের চিকিৎসক এটা রেকমেন্ড করেনি। আমরা নিজেরাই চেষ্টা করছি। হাসপাতাল আমাদের রিস্ক বন্ডে সই করিয়ে নিয়েছে।

ফেসবুক গ্রুপ থেকে পাওয়া ফোন নম্বরে যোগাযোগ করে এরকম আরও বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে মোটামুটি একইরকম তথ্য পাওয়া গেছে। করোনাভাইরাসে ৮০ বছর বয়সী বাবাকে হারিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলছেন তিনি নিজেও ফেসবুকে একটি গ্রুপে পোস্ট দিয়েছিলেন। সেখানে আবিষ্কার করেছেন প্লাজমা দানকারীরাও অর্থ নিচ্ছেন।

ওই ব্যক্তি বলছেন, আমি টাকা দিতে রাজি ছিলাম। একজন যোগাযোগ করার পর সে বেসরকারি হাসপাতাল ছাড়া দেবে না বলে জানালো। প্রথম যে হাসপাতালটি প্লাজমা তৈরি করতে রাজি হলো, তারা চেয়েছিল ১০ হাজার টাকা। কিন্তু ডোনার আসতে দেরি করায় সেখানে করা সম্ভব হয়নি। অন্য আর একটা বড় বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে দেখি, তারা নিচ্ছে ২৫ হাজার।

কিন্তু প্লাজমা তৈরি যে রক্ত দান করার মতো এত সহজ নয়, এর যে কিছু প্রটোকল রয়েছে; সেটি কেউ মানছেন না। যারা রক্ত দিচ্ছেন, তাদের দুটি নেগেটিভ রিপোর্ট থাকতে হবে। অনেকেই না জেনে এর আগেই প্লাজমা দান করছেন। রোগীরাও তা বুঝতে পারছেন না। এছাড়া বেসরকারি হাসপাতাল রক্তে অ্যান্টিবডি পরিমাপ করার সক্ষমতা নেই। তাহলে এভাবে নেয়া প্লাজমা কতটা নিরাপদ সেটিও একটি প্রশ্ন।

গত মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশে করোনা চিকিৎসার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হিসেবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্লাজমা থেরাপির প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। প্রথম দফায় ৪৫ জনের শরীরে এটি প্রয়োগের কথা ছিল।

প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগ সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের হেমাটোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মহিউদ্দিন আহমেদ খান বলছেন, আমরা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বৈজ্ঞানিক গবেষণা করছি। সরাসরি রোগীরা অনুরোধ করতে পারে না। তার যে চিকিৎসক উনার মাধ্যমে আসতে হয় এবং কারা প্লাজমা থেরাপি পাবেন, সেটারও একটি ক্রাইটেরিয়া আছে।

তিনি বলছেন, রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। যাদের শ্বাসকষ্ট আছে, অক্সিজেনের মাত্রা ৯৩ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে, নিউমোনিয়া আছে-এরকম মারাত্মক অসুস্থদের ব্যাপারে একটা গাইডলাইন দেয়া আছে। 'সিভিয়ারলি ইল' আর 'ক্রিটিকালি ইল' এ দুই ধরনের আক্রান্ত ব্যক্তিদের এ থেরাপি দেয়া হচ্ছে।

তিনি আরও বলছেন, তবে অ্যান্টিবডির একটি মাত্রা থাকতে হবে। কোভিড থেকে সেরে ওঠা সব রোগীর শরীরে অ্যান্টিবডি একরকম থাকে না। রক্তের প্লাজমায় যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, সেটার একটা নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত হলে তা আমরা নেই। একজনকে ২০০ মিলিমিটার পরিমাণ প্লাজমা দেয়া গেলে, সেটি ভালো ফল হতে পারে। প্লাজমা থেরাপির কোনো পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার কিছু নেই। তবে দেখতে হবে সেরে ওঠা ব্যক্তির মধ্যে কোভিড-১৯ এর লক্ষণ দেখা দেয়ার পর ২৮ দিন পার হয়েছে কিনা।

করোনা ধরা পড়ার পর যত দ্রুত সম্ভব প্লাজমা থেরাপি দেয়ার কথা বলছেন ডা. মহিউদ্দিন। সেই ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলছেন, শেষদিকে আসলে শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যা তীব্র হয়ে যায়। ফুসফুসের অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। শরীরে নানা ধরনের প্রদাহ দেখা দেয়। তখন এর কার্যকারিতা কম হয়। আক্রান্ত হওয়ার প্রথম দিকে যদি দেয়া যায়, তাহলে ফলটা ভালো পাওয়া যায়।

তবে রোগীদের সুস্থ করে তুলতে বাংলাদেশে প্লাজমা থেরাপি কতটা সফল হচ্ছে, সেই সম্পর্কে কোনো তথ্য এখনও নেই। কত রোগী প্লাজমা থেরাপি পেয়েছে, সেটারও কোনও হিসাব পাওয়া যায়নি। তিনি যেমনটা বলছিলেন খুব সংকটাপন্ন পরিস্থিতি তৈরি হলে আত্মীয়রা মরিয়া হয়ে প্লাজমা থেরাপির জন্য ছুটোছুটি করছেন।