ঢাকা, ০২ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার, ২০২৫ || ১৯ পৌষ ১৪৩১
good-food
২৯

বিবাহ ও পিকনিক: শীতে দুই সংক্রামক ব্যাধি

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১২:৪৮ ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪  

শীত এলে এদেশে দু'টি সংক্রামক ব্যাধি দেখা দেয়। বিবাহ এবং পিকনিক। চারিদিকে এখন বিয়ের হিড়িক চলছে - প্রতি সপ্তাহে গড়ে দুটি করে 'বিয়ে খাচ্ছেন' গণী সাহেব - অনুসংগ হিসেবে আছে এনগেজমেন্ট, গায়ে হলুদ , বৌভাত। প্রবাসী বঙ্গসন্তানেরাও এসময়টা দেশে আসে- আসে একা, ফিরে যায় জোড়া সাথে করে। শীত মৌসুমে কমিউনিটি হল ভাড়া পাওয়া সোনার হরিণ পাওয়ার মতো, এই সময়ের জন্য বুকিং দিতে হয় এক বছর আগে। 'মৌসুম' বলে কথা - পশু পাখির মৌসুম থাকে, মানুষের থাকতে দোষ কী!

 

আজকাল বিয়ের আয়োজন আনুষ্ঠানিকতা সবেতেই এলাহি কারবার। আগে পানচিনি বা গায়ে হলুদ এসব আনুষ্ঠানিকতা সারা হতো নিতান্তই ঘরোয়া পরিসরে সীমিত আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে। বিয়ের মূল অনুষ্ঠান ছিল একদিনই - যার ধকল সামলাতে হতো কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে, বাকিরা মোটামুটি ঐ দিন কব্জি ডুবিয়ে খাওয়ার আনন্দেই বিভোর থাকতেন। বরপক্ষের উৎসাহ ছিল আয়োজনের খুঁত আবিষ্কারে - কন্যাপক্ষকে নাজেহাল করতে না পারলে বিয়ের আনন্দই মাটি। 'খাদক' দলের কাজ ছিল ভোজনের চমৎকারিত্ব প্রদর্শন - প্রায় অবিশ্বাস্য ছিল তাদের উদরের ধারণক্ষমতা। খাবারে 'শর্ট' ফেলে দিতে পারলে তবেই না আসল তৃপ্তি!

 

এখন বিয়ে মানেই হৈ হৈ কাণ্ড রৈ রৈ ব্যাপার। কত যে আনুষ্ঠানিকতা আর কতরকম বাহারি নাম - এনগেজমেন্ট, গায়ে হলুদ, মেহেদি সন্ধ্যা, আকদ, ওয়ালিমা , বিয়ে, বৌভাত, রিসেপশন। গণী সাহেব ধান্দায় পড়ে যান, আকদ ওয়ালিমার পার্থক্য বোঝেন না, বৌভাত কখন যে রিসেপশন হয়ে গেছে তাও মালুম করতে পারেন না। সব অনুষ্ঠানের চেহারা তার কাছে মোটামুটি একই রকম লাগে- ফুলে ফুলে সাজানো স্টেজ, বাহারি সোফা, চোখধাঁধানো লাইটিং আর সারি সারি খাবারের টেবিল। আরো আছে ব্যস্ত সমস্ত ফটোগ্রাফারদের ছুটাছুটি, উৎসাহী আমন্ত্রিতজনের ছবি তোলার হিড়িক, আর বুকের ওপর হাতুড়ি পেটানো মিউজিক। দিশেহারা গণী সাহেব ভীড়ের মাঝে খুঁজে ফেরেন পরিচিত মুখ।

 

ছোটবেলায় দেখা গ্রামের বিয়ের কথা মনে পড়ে গণী সাহেবের। রাত জেগে মহাউৎসাহে স্টেজ সাজানো হতো। দুটো তক্তপোশ জোড়া দিয়ে বানানো মঞ্চ তার উপরে বিছানো শতরঞ্চি, আর চৌকি ঘিরে বাঁশের জাফরি, খুঁজে পেতে কার বাড়ি থেকে নিয়ে এসে পাতা হতো হাতল ওয়ালা চেয়ার। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ কাগজ কেটে কেটে ডিজাইন করে আঠা দিয়ে সেঁটে দেয়া হতো বাঁশের কেল্লায়। গেইট বানানো হতো বাঁশ , কলাগাছ , পাতা আর রঙ্গিন কাগজ দিয়ে- থাকত 'স্বাগতম' লেখা ব্যানার। সেসব কাজের বিশেষজ্ঞ ও থাকত গ্রামে হাতে গোণা দু'একজন। বিয়ে শাদিতে তাদের কদরই আলাদা ছিল।

 

বর আসত গরু কিংবা ঘোড়ার গাড়িতে - গলায় কাগজের ফুলের মালা - নতুনত্ব আনতে কেউ কেউ টাকা গেঁথে দিত তার সাথে। আর অবধারিত ছিল বরের হাতে রুমাল - সেটা মুখের উপর চাপা দিয়ে রাখাই ছিল ভব্যতা। আজকাল এমন লজ্জাশীল বর আর কোথাও দেখা যায় না।

 

বরের পথ আটকে চিপে চিপে কিছু বিয়ের মাশুল আদায় করে নিত বালক-বালিকার দল। এ নিয়ে বাক-বিতণ্ডা, কিঞ্চিত কলহ ও অপ্রত্যাশিত ছিল না। বর কে লবণের শরবত দিয়ে বোকা বানানো, বরের জুতা লুকিয়ে নাজেহাল করা- এ জাতীয় গ্রাম্য রসিকতা ছিল সর্বজনীন। বিয়ে 'পড়ানো'র পর বরকে উঠে দাঁড়িয়ে উপস্থিত অভ্যাগতদের "আস সালামু আলাইকুম" বলাটা অবশ্য কর্তব্য বলে বিবেচিত হতো। ওদিকে অন্দরমহলে কনে কে 'কবুল' বলানোর সাধ্যসাধনা চলত, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই 'বালিকা-বধু' কেঁদে কেটে অস্থির হয়ে যেতো। ব্যপারটা দীর্ঘায়িত না করতে অনেক সময় কনের মা খালারাই 'এজিন' দিয়ে দিতেন।

 

অতঃপর ভোজন পর্ব। সেকালে ক্যাটারার, ডেকোরেটর ছিল না, বিয়ের রান্না-বান্না আর পরিবেশনার দায়িত্ব 'সমাজ' এর লোকেরাই পালন করতেন। খাবারের আয়োজন ও ছিল সাদা মাঠা - ভাত, গরুর মাংস, মাছের ঘন্ট, শেষ পাতে দই মিষ্টি - মধুরেণ সমাপয়েৎ !

 

বিয়েশাদীর নেমন্তন ব্যাপারটার অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া; না পেলে রাগ হয়, অপমান বোধ হয়, পেলে দুশ্চিন্তা। বিয়ের দাওয়াত পেয়ে যুগপৎ উল্লসিত আর শংকিত হন গণী সাহেব। শুধু হাতে তো আর বিয়ে খাওয়া চলে না, উপহার ও কিনতে হয়, আজকাল অবশ্য সেটাকে 'গিফট' বলা হয়। গিফট কেনার ঝক্কিঝামেলা কম নয় - গিন্নিকে একা ছেড়ে ভরসা পাওয়া যায় না। মহিলারা বড়ই অবুঝ, সাধ ও সাধ্যের সমন্বয় করার ব্যাপারটা কিছুতেই বুঝতে চান না। কোথাও কোথাও অবশ্য নিমন্ত্রণ পত্রে লিখা থাকে, "উপহার নয়, দোয়াই কাম্য" - তবে সে কথায় কান না দেওয়াই উত্তম। মান ইজ্জতের হাঁড়ির হাল হয়ে যেতে পারে।

 

আফটার অল ইজ্জত ছাড়া বাঙালির আছে টা কী!

 

লেখক: আনহারুল ইসলাম

ইঞ্জিনিয়ার, বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি

মুক্তমত বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর