ঢাকা, ২২ নভেম্বর শুক্রবার, ২০২৪ || ৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
৩২৫

ব্যাংক ঋণের জামিনদার হওয়ার আগে যেসব বিষয় জানা অত্যন্ত জরুরি

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৪:৫৪ ২১ নভেম্বর ২০২৩  

ঋণের প্রয়োজনে ২০১৯ সালে ব্যাংকে আবেদন করেন আনিসুর রহমান। কিন্তু সিআইবি রিপোর্টের কারণে সেটি আটকে যায়। এর আগে নিজে কখনও ঋণ নেননি তিনি। তবে কর্মক্ষেত্রে এক সহকর্মীর ব্যাংক ঋণের জামিনদার হয়েছিলেন। কিন্তু সেই সহকর্মী সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে পারেননি। ফলে কেবল জামিনদার হওয়ার জন্যই এই সমস্যার মুখে পড়েন আনিসুর।

 

তার মতো এই সমস্যায় পড়েছেন আরও অনেকে। কেবল ব্যাংক ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত না হওয়া এবং অসচেতনতার কারণে এই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে পারেন যে কেউ। তাই কারও ব্যক্তিগত ঋণের জামিনদার হওয়ার আগে কিছু বিষয় জেনে নেয়া অত্যন্ত জরুরি।

 

যে কারণে জামিনদার প্রয়োজন 

ব্যাংক মূলত দুই ধরনের ঋণ দেয়। একটি হলো সম্পত্তি জামানত নিয়ে। অন্যটি কোনও ধরনের জামানত ছাড়া। প্রথম ক্ষেত্রে সম্পত্তি জামানত বলতে বোঝানো হয় জমিজমা, সম্পত্তি, সঞ্চয়পত্র বা ফিক্সড ডিপোজিটের মতো সম্পত্তি কিংবা আর্থিক সম্পদ বন্ধক রাখার বিপরীতে ঋণ নেয়া। গ্রহীতা তা শোধ করতে না পারলে এসব সম্পত্তি বিক্রি করে ব্যাংক অর্থ আদায় করে।

 

দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ঋণ নিতে হলে একজন জামিনদারের দরকার পড়ে। কোনও কারণে যদি গ্রহীতা দেনা পরিশোধে অপারগ হন, তাহলে সেই অর্থ উদ্ধারের জন্য জামিনদারের কাছে যায় ব্যাংক। জামিনদার নির্বাচনে ব্যাংকের কিছু মানদণ্ড থাকে বলে জানান বেসরকারি প্রাইম ব্যাংকের ফাস্ট এসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং সিনিয়র রিলেশনশিপ ম্যানেজার মো. এহতেশামুল হক খান।

 

তিনি বলেন, আমরা মূলত দেখি যাকে জামিনদার করা হচ্ছে; তার সামর্থ্য (আর্থিক) আছে কিনা। অর্থাৎ আবেদনকারী যদি ঋণ পরিশোধ করতে না পারেন, সেক্ষত্রে যেন জামিনদার সেটা ফেরত দেয়ার ক্ষমতা রাখেন। এই মানদণ্ডের মধ্যে জামিনদারের বয়স, ব্যক্তিগত আয় এবং সিআইবি রিপোর্টের মতো বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়া হয়।

 

সিআইবি রিপোর্ট 

সিআইবির পূর্ণ রূপ হলো ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো। এটি মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেটাবেজ সিস্টেম। ঋণগ্রহীতা বা আবেদনকারীর বিশ্বস্ততা নির্ধারণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক এই ক্রেডিট ডেটাবেস তৈরি করেছে। যাতে আবেদনকারীর ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা এবং আগে নেয়া ঋণের ক্ষেত্রে তার আচরণ বিশ্লেষণ করা যায়।

 

দেশের কোনও ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে যদি কেউ ব্যক্তি ঋণ নেয় কিংবা কারও ঋণের জামিনদার হয়, তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সেই তথ্য নথিভুক্ত থাকে। ফলে নতুন করে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংক ব্যক্তির সিআইবি রিপোর্ট দেখেই তা অনুমোদনের সিদ্ধান্ত নেয়।

 

অসচেতনতায় জামিনদার 

প্রায় ৮ বছর আগে সহকর্মীর জামিনদার হওয়ার সময় অনেকটা চিন্তা না করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আনিসুর। তিনি বলেন, ওই মুহূর্তে অত কিছু ভাবিনি। উনি আমার কলিগ (সহকর্মী)। একসঙ্গে চাকরি করছি। স্মার্ট স্যালারি পাচ্ছেন, যা দিয়ে অনায়াসে লোন ফেরত দিতে পারবেন। মানুষও ভালো। সবমিলিয়ে আসলে কোনও কিছু চিন্তা না করে বিশ্বাসের কারণে এটা করেছিলাম।

 

এক্ষেত্রে ঋণ প্রদানের সময় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তারা ঠিকভাবে তাকে এই বিষয়ে বোঝাননি বলে অভিযোগ করেন আনিসুর। তবে এমন অভিযোগ মানতে নারাজ ব্যাংক কর্মকর্তা এহতেশামুল। তার মতে, অন্তত তিনটি ধাপ পেরিয়ে একটি ঋণ অনুমোদন হয়। আর প্রতিটি ধাপেই জামিনদারকে ঋণের পরিমাণ সম্পর্কে অবগত করা হয়। একইসঙ্গে বিভিন্ন নথিতে সই করাসহ জামিনদারকে বেশ কিছু প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। সেক্ষেত্রে এতগুলো ধাপ পেরিয়ে ঋণের সম্পর্কে একজন জামিনদারের না জানার কোনও সুযোগই নেই। তবে অসচেতনতার কারণে অনেকে বিষয়গুলো সম্পর্কে যথেষ্ট গুরুত্ব দেন না।

 

আইনে যা আছে 

ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার পর গ্রহীতা যদি তা পরিশোধ করতে না পারেন, তাহলে তার দায়ভার জামিনদারের ওপর আসবে। ২০০৩ সালের অর্থ ঋণ আদালত আইনের ৬-এর ৫ ধারায় তা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান মূল গ্রহীতার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার সময় তৃতীয় পক্ষ বন্ধকদাতা বা জামিনদারকে বিবাদী করা হবে। আদালতের রায়, আদেশ বা ডিক্রি সবার বিরুদ্ধে যৌথ ও পৃথকভাবে কার্যকর হবে। মামলাও সবার বিরুদ্ধে একইসঙ্গে পরিচালিত হবে। অর্থাৎ গ্রহীতা যদি ঋণ পরিশোধে অপারগ হয়, তাহলে সেই ঋণের দায়ভার সমানভাবে জামিনদারের ওপর যাবে। আদালতের মাধ্যমে তাকে এই অর্থ ফেরত দিতে হবে।

 

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এএসএম সাকিব শিকদার বলেন, ব্যক্তিগত ঋণে ব্যাংকে কিছু গচ্ছিত রাখা হয় না। ফলে অর্থ আদায় না হলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে দুজনের বিরুদ্ধে মামলা করবে। সেক্ষেত্রে আদালত থেকে ব্যাংক রায় পেয়ে গেলে একই আইন অনুযায়ী প্রথমে গ্রহীতা থেকে অর্থ নেবে। তার কাছ থেকে না পেলে জামিনদার থেকে বাকি অর্থ উদ্ধার করবে। মূল গ্রহীতার কাছে অর্থ নেই বলে ফেরত দিতে পারেননি। তাই বড় দায়ভার চলে যায় জামিনদারের কাঁধে।

 

তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ঋণ ১০ লাখ টাকার জামিনদার হলেও যিনি নিয়েছেন, তিনি দিতে পারেন না। ফলে ঋণ বাড়তে বাড়তে ৩০ লাখ পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে। কিন্তু গ্রহীতার যেহেতু ঋণ শোধের অবস্থা থাকে না, সেক্ষেত্রে জামিনদারের ওপর ৩০ লাখ টাকার পুরোটাই চলে আসে।

 

হতে পারে কারাদণ্ড 

সাধারণত গ্রহীতা পরপর তিনটি কিস্তি দিতে না পারলে প্রথমে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ বিভাগগুলো পদক্ষেপ নেয় বলে জানান এহতেশামুল। আইনজীবী শিকদার বলেন, ঋণের অর্থ উদ্ধার না করা গেলে শুরু হয় আইনি প্রক্রিয়া। সেক্ষেত্রে প্রথমে গ্রহীতা ও জামিনদারের বিরুদ্ধে চেকের মামলা করা হয়। পরে অর্থঋণ মামলা করা হয়। দেওয়ানি ক্ষেত্রে অর্থ ঋণ আদালত ৬ মাস পর্যন্ত জামিনদার ও গ্রহীতাকে টাকা শোধের জন্য দায়ী করে আটকাদেশ দিতে পারে। আইনের ৩৪ ধারায় এটা বলা আছে।

 

এই ধরনের বিষয়ে কোনও আর্থিক লাভ থাকে না। তাই এসব ক্ষেত্রে জামিনদার হওয়ার বিষয়টি এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেন তিনি। এছাড়া ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে হলেও যার জামিনদার হচ্ছেন, তার সেই দেনা পরিশোধের সামর্থ্য আছে কি না তা জেনে-বুঝে সিদ্ধান্ত নেয়ার পরামর্শও দেন।

 

জামিনদার হওয়ার আগে যেসব বিষয় জানা জরুরি  

জামিনদার হওয়ার ক্ষেত্রে আগে কেবল স্বাক্ষর প্রয়োজন হলেও চলতি বছর আগস্টে জামিনদারের বৃদ্ধাঙ্গুলির ছাপ নেয়া বাধ্যতামূলক করে সার্কুলার জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া ঋণ দেয়ার সময় জামিনদার হওয়ার আইনি বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে জামিনদারকে জানানোর দায়িত্ব ব্যাংকারদের। সবশেষ এই সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে বেশ কিছু পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাপিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে বলা হয়েছে-

 

১. ঋণ নেয়ার কারণ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জামিনদারকে জানতে হবে। একইসঙ্গে নেয়া গ্রহীতা ফেরত দিতে পারবে কি না সেই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।

২. জামিনদার হওয়ার আগে ঋণ সংক্রান্ত চুক্তির শর্ত ভালো করে জানা ও বোঝা উচিত। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের মতামত নেয়া যেতে পারে।

 

৩. সাদা কাগজে সই করা থেকে বিরত থাকা।

৪. গ্রহীতা যদি ঋণ পরিশোধ করতে না পারে, তাহলে তার সঙ্গে জামিনদারও খেলাপি হবেন। সিআইবি রিপোর্টে প্রভাব পড়বে।

৫. গ্রহীতা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে জামিনদাতা তা পরিশোধে বাধ্য হবে। সেক্ষত্রে ওই পরিমাণ অর্থ দেয়ার সামর্থ্য আছে কি না তা ভেবে দেখা।

এছাড়া জামিনদার হওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে লিখিতভাবে সম্ভাব্য দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে জেনে নেয়া প্রয়োজন