ঢাকা, ১২ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার, ২০২৪ || ২৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
৫১৫

যে স্মৃতি কাঁদায়, কাঁপায়

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২২:০১ ২০ আগস্ট ২০২১  

সেদিন আমি পল্টনে সংবাদ পত্রিকা অফিসে ছিলাম। গল্পই করছিলাম। হঠাৎ কেমন যেন বোমা ফাটার শব্দ। বঙ্গবন্ধু এভিনিউ থেকে পল্টনের দূরত্ব বেশি নয়। প্রথমে মনে হলো আশপাশে কোথাও বোমা ফাটানো শব্দ। তবে সেটির শব্দ ভয়াবহ বিকট, কানে তালা লাগার মতো। সেই সংবাদ অফিস থেকেই সবাই এদিক-ওদিক উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন সেই বোমার উৎসটি কোথায়। তখনো উৎস পাওয়া যায়নি, তবে বোমার শব্দ শোনা গেল অনেক।

 

তখন অনেকেই দেখলাম বোমার উৎস খোঁজার চেয়ে কানে আঙুল দিয়ে কান রক্ষার চেষ্টা করছে। তবে মিনিটপাঁচেক পরই সংবাদ অফিসের দোতলার বারান্দায় রেলিং ধরে দাঁড়ালাম। ধোঁয়া ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু শুনতে পাচ্ছিলাম লোকজনের আর্তনাদ আর দৌড়াদৌড়ির শব্দ। কে যেন চিৎকার করে বলে উঠল ‘আওয়ামী লীগের জনসভায় বোমা হামলা হইছে।’ ধোঁয়ায় আমরা সত্যিকারভাবেই কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। বাতাসে তখনই ছড়িয়ে গেছে বোমাজাতীয় কিছুর গন্ধ।

 

মানুষ দৌড়াচ্ছে শুধু এটা বোঝা যাচ্ছে, আর শুনতে পাচ্ছিলাম কেমন যেন ‘আকুতির’ শব্দ। একে-ওকে ফোন দেওয়া হচ্ছে। আশায়Ñ যদি কেউ সঠিক তথ্য দিতে পারে। ঠিক আধা ঘণ্টা পরই একটি সংবাদ শোনা গেল যে, এই বোমা হামলায় মারা গেছেন আইভি রহমান। তবে শেখ হাসিনার খবর কেউ তখনো জানেন না। কী এক অস্বাভাবিক দম বন্ধ অবস্থা। সেখানে থাকা সাংবাদকিদের সঙ্গেও যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না। আস্তে আস্তে সবকিছু জানা গেল।
 

আরও বুঝলাম যেটিকে সবাই বোমা ভেবেছিলাম সেটি আসলে বোমা ছিল না। কারণ কেউই কী হতে পারে সেটির চূড়ান্ত কিছু কল্পনাও আনতে পারেননি। সেটি ছিল বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হওয়া গ্রেনেড। একটি নয়, একের পর এক বিস্ফোরিত হতে থাকল গ্রেনেড। এতটা দ্রুত একটির পর একটি বিস্ফোরণ সম্ভবত যুদ্ধক্ষেত্রেও খুব কমই দেখা যায়। এক সময় বিস্ফোরণের শব্দ থামল, কিন্তু রেখে গেল এক হৃদয় কাঁপানো, ভয়াবহ স্মৃতির ক্যানভাস।

 

তখন সবাই বুঝতে পারলেন, এ কেবল নিছক শব্দ ছিল না, এ ছিল এক নারকীয় পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ। ধোঁয়া ঠেলে মানুষ এগিয়ে যেতেই দেখতে পেল গ্রেনেডের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়া মানুষের দেহ এবং তার ওপর দিয়ে জ্ঞানশূন্য মানুষের দিশেহারাভাবে ছুটে চলা। আইভি রহমানের রক্তে ভেজা স্থির চাহনি, অঙ্গ হারানোদের রক্তাক্ত চেহারা।

 

ফিটফাট শাড়ি পরা আওয়ামী লীগের এক নারীকর্মীর কাত হয়ে হঠাৎ করেই লাশ হয়ে যাওয়া ছবিটি অনেকদিন চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পেতাম। নতুন ব্যাগটি তখনো তার হাতে ঝোলা ছিল। জীবনগুলো এমনই জীবন্ত ছিল। ইতিহাসের এই নৃশংস ঘটনাটি যখন ঘটেছিল ক্ষমতায় তখন বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার।
 

না, আমি খুব কাছে থেকেও সেই রক্তাক্ত জমিনের ওপর হাঁটতে পারিনি। এর কাছেও যেতে পারিনি। জীবন আমাকে তব্দা করে দিয়েছিল। রক্তাক্ত লাশের সারি, না ফোটা গ্রেনেড, গ্রেনেড বিস্ফোরণের কালো ধোঁয়ায় আর শত মানুষের বাঁচার আর্তনাদ, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জুতা, সেন্ডেল মুহূর্তেই বঙ্গবন্ধু এভিনিউকে বানিয়ে ফেলেছিল যেন এক সাক্ষাৎ মৃত্যুপুরী।
 

আজ সেই পনেরো বছর পরও সেই ধোঁয়া-আহাজারির জীবনটি আমার কাছে এক ভয়ঙ্কর স্মৃতি। আর আমি নিশ্চিত, যারা সেখানে থেকে সেই রক্তের ওপর দিয়ে হেঁটে বেড়িয়েছেন, নিজেকে বাঁচাতে ছুটে বেড়াচ্ছিলেন তাদের কাছে ২১ আগস্ট মানেই হলোÑ মনে করতে না চাওয়া সেই দিনটি।
 

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশের ইতিহাসের ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের কালরাতের বর্বরোচিত হত্যাকা-ের পর ২০০৪ সালের ২১ আগস্টই ছিল নৃশংস আরেকটি হত্যাকাণ্ডের দিন। সেদিনের সেই গ্রেনেড হামলায় আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলাবিষয়ক সম্পাদিকা ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন।

 

তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ প্রায় ৩০০ লোক আহত হন। তাদের অনেকেই আজও সারা শরীরে স্প্লিন্টারের ক্ষত নিয়েই ২১ আগস্টের হামলার স্মৃতি হয়ে আছেন। সেই ঘটনা নানা ঘাটে জল খায়, তবু মুছে যায় না সেই দুঃসহ স্মৃতি মানুষের মন থেকে।
 

গ্রেনেড হামলার ঘটনার পরের দিন মতিঝিল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে মামলা করেছিলেন। গ্রেনেড হামলার পর মামলা হয়েছিল পৃথক তিনটি। এর মধ্যে প্রথম সাত বছরের মধ্যেই তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয় মোট ছয়বার।
 

এ মামলাটির প্রথমে তদন্ত শুরু করে থানা পুলিশ। সবাইকে অবাক করে দিয়েই অত্যন্ত দ্রুত গতিতে মাত্র এক মাস ১০ দিনের মাথায় ওই বছরের ২ অক্টোবর কমিশন সরকারের কাছে ১৬২ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। প্রতিবেদনে খুব স্পষ্টভাবে বলা হয়, কমিশনের সংগৃহীত তথ্যপ্রমাণ সন্দেহাতীতভাবে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার পেছনে একটি শক্তিশালী বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত ছিল।

 

আরও জানানো হয়, অভিযানটি পরিচালনা করা হয়েছিল ভাড়া করা দুর্বৃত্তদের মাধ্যমে। এই কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া লোকদের প্রধানত একটি সংগঠনের সশস্ত্র ক্যাডারদের মধ্য থেকে নেওয়া হয়েছিল এবং তাদের সমাবেশে ভিড়ের মধ্যে মিশে যাওয়ার মতো ভালো দক্ষতা ছিল। এর পরই এই মামলায় প্রবেশ করানো হয় জজ মিয়া চরিত্র।
 

অধিক গুরুত্বের দাবি রাখা এই মামলাটি ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নতুন প্রাণ পায়। নতুন করে তদন্ত শুরু হলে অনেক নতুন তথ্য প্রকাশ পায় এবং মামলাটিও নতুন জীবনের দিকে আগায়। জজ মিয়াকে নিয়ে সন্দেহ এবং তীব্র সমালোচনা শুরু হলে এবং গণমাধ্যম এটি নিয়ে তোলপাড় শুরু করলে নাটিক আর বাস্তবতার পার্থক্য সামনে এসে হাজির হয়।

 

জানা যায়, জজ মিয়ার বিষয়টি পুলিশের সাজানো। চাপা পড়া ঘটনা নড়েচড়ে ওঠে। জানা যায়, আসামি করার বদৌলতে তার পরিবারকে টাকা দেওয়া হতো। এর পর নানা মোড় ঘুরে ২০০৮ সালে আসামির তালিকা থেকে জজ মিয়াকে বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র জমা দেয় সিআইডি।
 

২০০৯ সালে জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সম্পূরক চার্জশিটে তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে আরও অনেকের নাম আসে। সবকিছু ছাপিয়ে ১১৯তম কার্যদিবসে মামলার যুক্তিতর্ক শেষ হয়। এর মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষ ৩০ ও আসামিপক্ষ ৮৯ দিন ব্যয় করেছে। গত বছরের অক্টোবরে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলায় আদালত সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৯ জনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন।

 

এ ছাড়া তারেক রহমানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন এবং বাকিদের বিভিন্ন মেয়াদের কারাদ- দেওয়া হয়। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা মামলা দুটি পাঁচবার উচ্চ আদালতে নিয়ে যাওয়ায় এই মামলার রায় দেওয়ার জন্য আদালতের ২৯২ কার্যদিবস ব্যয় করতে হয়েছিল। এই নৃশংস হত্যাকা-ের রায়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৪ বছর এক মাস ২০ দিন।
 

বোমা ও গ্রেনেড নিক্ষেপ করে মানুষ হত্যা এ দেশে নতুন ছিল না। ২০০৪-এর আগেও হয়েছে। তবে উদ্দেশ্যগুলো হয়তো ভিন্ন ছিল। ১৯৯৯ সালের মার্চ থেকে ২০০৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ছয় বছরে এই জঙ্গিগোষ্ঠী দেশে ১৩টি বোমা ও গ্রেনেড হামলা চালায়। এতে ১০৬ জন নিহত হন।

 

আহত হন ৭০০-র বেশি মানুষ। বড় বড় জমায়েতগুলোতে বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও সিপিবির সমাবেশ, উদীচী ও ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর এসব হামলা চালানোই টার্গেট ছিল। তবে সবগুলোকে ছাপিয়েছিল ২১ আগস্টের হত্যাকা-।
 

নিপীড়ন এবং নৃশংসতার স্মৃতি মানুষ নানাভাবে বহন করে, স্মরণ করে, আর তাই তো হত্যাকা-ের ইতিহাসও বিস্মৃত হয় না। মানুষের শরীর, মনের সঙ্গে এই স্মৃতি মিলেমিশেই থাকে। আর এভাবে নৃশংসতার ইতিহাসও জড়াজড়ি করে থাকে আমাদের যাপিত জীবনে।
 

লেখকঃ ড. জোবাইদা নাসরীন

মুক্তমত বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর