ঢাকা, ১২ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার, ২০২৪ || ২৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
২২০৬

রক্ষক যখন ধর্ষক

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২২:৩৩ ৮ জুলাই ২০১৯  

সামাজিক মূল্যবোধের ব্যাপক অবক্ষয়ের কারণে হঠাৎ করেই আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে ধর্ষণ এবং খুনের মতো অনৈতিক জঘন্য ঘটনা। নুসরাতকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারার ঘটনা শেষ হতে না হতেই রিফাতকে দিনে দুপুরে জনসম্মুখে মরতে হলো সন্ত্রাসীদের হাতে। সম্প্রতি আটককৃত নারায়নগঞ্জের ফতুল্লার মাদ্রাসা প্রিন্সিপাল নিজে র‌্যাবের কাছে স্বীকার করেন যে, তিনি ধর্ষক এবং সাজা হিসেবে নিজেই তার মৃত্যুদণ্ড চেয়েছেন। সম্প্রতি জনৈক স্কুল শিক্ষককে ২০ জন ছাত্রীকে ধর্ষণের দায়ে জেল-হাজতে পাঠানো হয়েছে। নুসরাত হত্যার সঙ্গে জড়িত মাদ্রাসা প্রিন্সিপাল জেল খাটছেন। ময়মনসিংহে এক নার্স গাড়ির মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হন। এর আগে কুমিল্লায় তথাকথিত রাঘব বোয়ালদের ধর্ষণের বলির পাঁঠা হন তনু। তারও আগে প্রেমের ডাকে সাড়া না দেয়ায় সিলেটে ছাত্রলীগ নেতার চাপাতির কোপে গুরতর জখম হয় খাদিজা।

অর্থাৎ যারা রক্ষকের ভূমিকায় রয়েছেন, তারাই ধর্ষক হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেন। একের পর এক কুকীর্তি ঘটিয়ে চলেছেন। সমাজের  সর্বস্তরের মানুষ অবাক দৃষ্টিতে দেখছেন এইসব শিক্ষিত নরপশুদের কর্মকাণ্ড। ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের নিজস্ব সামাজিক-সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় রাজনৈতিক ঐতিহ্য রয়েছে। প্রত্যেক মানুষের সঙ্গে সৌহার্দপূর্ণ সহাবস্থানের ইতিহাস রয়েছে। স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন, ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, পুলিশ-জনগণ এই সম্পর্কগুলো অতীব পুত ও পবিত্র। সামাজিক পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণভাবে সমাজে বসবাসের কথা। কিন্তু হঠাৎ করেই কেন যেন এই মধুর সম্পর্কগুলো আর সুহৃদ অবস্থানে থাকছে না।

পারষ্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মারাত্মক অবক্ষয় পরিলক্ষিত হচ্ছে। সম্প্রতি ভারতের জাতীয় অপরাধ ব্যুরোর রিপোর্ট অনুযায়ী, ধর্ষণকে নারীদের বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের অন্যতম একটি ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ২০১৩ সালের এন.সি.আর.বি- রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতিবেশি দেশটিতে ২৪ হাজার ৯২৩ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ২৪ হাজার ৪৭০ জন পরিচিত জনের দ্বারা আক্রান্ত। অনেককে ধর্ষণের পর হত্যাও করা হয়েছে।

গত জুলাই ২০১৮  ঢাকা ট্রিবিউন এর রিপোর্ট অনুযায়ী, গত ০৬ মাসে বাংলাদেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৫৯২ জন। যার মধ্যে প্রায় ২৯ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। এই সংখ্যা প্রতিদিন বেড়েই চলেছে। তুলনা করলে দেখা যায়,  পড়শী ভারতের তুলনায় আমাদের দেশে ধর্ষণের হার আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এমনটি চলতে থাকলে দেশে শিশু কিশোরী, তরুণী, যুবতীদের চলাফেরার স্বাধীনতা, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় লেখাপড়ার অগ্রগতি মুখ ধুবড়ে পড়বে। আজ মাদ্রাসার মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মেয়েরা নিরাপদ বোধ করছে না। শিক্ষক, প্রিন্সিপাল ধর্ষণের দায়ে গ্রেফতার হচ্ছেন।

অনেকেই যৌন নিপীড়নের কথা লজ্জায় অভিভাবকদের বলতে পারছে না। আমরা কোন যুগে বসবাস করছি? এখন প্রশ্ন হলো হঠাৎ করে ধর্ষণ হত্যার মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণ কি? আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, হঠাৎ এই  নৈতিক অবক্ষয়ের কারণ হলো-সোশাল মিডিয়ার অপব্যবহার, ভারতীয় একাধিক চ্যানেলে সমাজের নানাধরনের জটিলতা, বিবাহ-বিচ্ছেদ, পরকীয়া প্রেমের প্রামাণ্য ঘটনাসমূহ। এছাড়া ক্রাইম-পেট্রোল, অপরাধ জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন সিরিয়ালের সম্প্রচারও এজন্য অনেকাংশে দায়ী।

দেশে সর্বস্তরের মানুষের কাছে এনড্রয়েড মোবাইলের সহজলভ্যতা এবং যথেচ্ছা ব্যবহার আমাদের মতো অপ্রস্তুত জাতিকে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। আমরা কোনটি সঠিক আর কোনটি ভুল। সেটি বুঝে উঠতে ব্যর্থ হচ্ছি। ফেসবুকে নিজের ছবি এবং বন্ধুবান্ধবের শালীন-অশালীন ছবি পোস্ট করে নিজেদের উন্মোচন করার ব্যর্থ প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছি। এসব রুচিহীন, কুরুচিপূর্ণ ছবির স্ট্যাটাস সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনরকম নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই প্রকাশ করা হচ্ছে। এ কারনে সব শ্রেণিপেশার মানুষ নানাভাবে অনৈতিক-অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। এসব প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি নিয়ন্ত্রণ। রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র, অনলাইন ওয়েবপোর্টালসহ মূলধারার গণমাধ্যমগুলোর ওয়াচডগ ভূমিকা পালন করা।

সরকার অবশ্যই আইন করে স্কুল- কলেজগামী ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষকদের মোবাইল ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আনতে পারে। এর সঙ্গে অভিভাবককেও অবশ্যই সতর্ক হতে হবে। সন্তানদের মোবাইল ব্যবহারের প্রতি নিয়ন্ত্রণ আনয়ন জরুরী। কারণ, হ্যান্ডসেট হচ্ছে এমন এক ডিভাইস, যাকে বলা যেতে পারে (অল-ইন-ওয়ান) অর্থাৎ একের ভেতর সব। শুধু কারণেই আজকের প্রজন্মের মধ্যে দেখা যাচ্ছে অতি নাটকীয়তা, ন্যাকামি, বেহায়াপনা, বন্ধু-বান্ধবদের অশ্লীল ভাষায় বাপ-মা, গোষ্ঠী  তুলে গালাগালি।
 

শেকড়কে ভুলে মেকী বিষয়ে অতিরিক্ত আগ্রহের অসুস্থ্য প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। আজকের যুব-সমাজ জ্ঞাতি সম্পর্ক কি তা বুঝতে পারছে না। বুঝতে পারছে না বাবা-মায়ের সঙ্গে, সমাজের মুরব্বিদের সঙ্গে কেমন আচরণ করা উচিত। স্কুল-কলেজগুলোতে নৈতিক ও ধর্ম শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকার কারণে বেশিরভাগ ছেলে মেয়েদের মধ্যে সামাজিক ধর্মীয় অনুশাসন অনুপস্থিত। যার কারণে যেকোনও ধরনের অন্যায় সন্ত্রাসীমূলক কাজ করতে তাদের বিবেকে বাধা দেয় না।

আজ আমরা বিশেষ করে, যারা রক্ষকের দায়িত্বে আছি; তাদের অবশ্যই সতর্ক হতে হবে। সমাজে যত ক্রাইম হচ্ছে, বেশিরভাগই মোবাইল ফোনকেন্দ্রিক। কাজেই আমাদের সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে। তাই বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী হায়দার হোসেনের গানের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে ইচ্ছা করছে,কি বলার কথা, কি বলছি, কি করার কথা, কি করছি, স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পরে এসে তনু, নুসরাত, রিফাত হত্যা ধর্ষকদের দৃশ্য দেখছি

জালাল উদ্দীন, সহকারী অধ্যাপক

ইংরেজী বিভাগ, উত্তরা কমার্স কলেজ

             

মুক্তমত বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর