ঢাকা, ২৬ নভেম্বর মঙ্গলবার, ২০২৪ || ১২ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
১১০৪

জেনে নিন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা

লাগামহীন ডেঙ্গু : শক সিনড্রোমের উপসর্গ

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২৩:০০ ২৩ জুন ২০১৯  

 

লাগামহীন হয়ে উঠেছে ভয়াবহ ডেঙ্গু জ্বর। আষাঢ়ের বৃষ্টির পরেই ডেঙ্গুর বাহক এডিসের লার্ভার উপস্থিতি বাড়ছে। রাজধানী ঢাকার হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। মাত্র ২ দিনেই এ রোগে আক্রান্ত হয়ে ৯০ জনের বেশি মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

 

মহানগরীর মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত হয়েছে - পুরান ঢাকার দয়াগঞ্জ, নারিন্দা, স্বামীবাগ, গেণ্ডারিয়াসহ আশপাশের এলাকা।

এরপর ঝুঁকিতে আছে যথাক্রমে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ১২নং ওয়ার্ড, ১৭নং ওয়ার্ড, ৪ ও ৩৯নং ওয়ার্ড, দক্ষিণ মুগদাপাড়া ও বাসাবো, মানিকনগর বিশ্বরোড, শেরেবাংলা রোড ও হাজারীবাগ, মগবাজার ও রমনা, সেগুনবাগিচা, শাহবাগ, হাজারীবাগ, ফরাশগঞ্জ, শ্যামপুর, উত্তর যাত্রাবাড়ী ও ৪৮নং ওয়ার্ড।

 

অন্যদিকে, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে তেজগাঁও-এ। সেখানে লার্ভার ঘনত্ব সূচক (বিআই) সর্বোচ্চ ৪০ পাওয়া গেছে। এরপর আছে তুরাগ, পল্লবী, বনানী, গুলশান, বারিধারা।

 

চিকিৎসকরা জানান, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে জ্বরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশ বেড়ে যায়। জ্বর ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত উঠতে পারে। তবে, তরুণ ও শিশুদের ক্ষেত্রে ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পরও উপসর্গ দেখা যায় খুবই সামান্য। কখনও বা একেবারেই উপসর্গহীন থাকে। তবে ডেঙ্গুর ভাইরাসবাহী মশা কামড়ানোর চার থেকে সাত দিন পর এসব উপসর্গ স্পষ্টভাবে লক্ষণীয় হয়।

 

এ রোগের কিছু সাধারণ উপসর্গ হল - বিরামহীন মাথাব্যথা, হাড়, হাড়ের জোড় ও পেশিতে ব্যথা, বমিভাব ও বমি হওয়া, গ্রন্থি ফুলে যাওয়া, সারা শরীরের ফুসকুড়ি দেখা দেয়া, চোখের পেছনে ব্যথা হওয়া ইত্যাদি।

 

এ সময় পর্যন্ত স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া এবং প্রচুর পরিমাণে তরল গ্রহণ করার মাধ্যমে দ্রুত রোগমুক্ত হওয়া যায়।

 

এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে ডেঙ্গু সচরাচর সেরে যায়। তবে কিছু রোগীর ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়তে পারে। এসব ক্ষেত্রে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

 

ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের উপসর্গ হল :  শ্বাস-প্রশ্বাসে অসুবিধা হওয়া কিংবা শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যাওয়া। ত্বক শীতল হয়ে যাওয়া। অবিরাম অস্বস্তি, ত্বকের ভেতরের অংশে রক্তক্ষরণের কারণে ত্বকের উপরের অংশে লাল ছোপ সৃষ্টি হওয়া। বমি, মল কিংবা প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যাওয়া, প্রচণ্ড পেটব্যথা ও অনবরত বমি হওয়া, নাক ও দাঁতের মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণ ও অবসাদ। এ উপসর্গগুলো চোখে পড়লে আক্রান্ত রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের আবহাওয়া অনুযায়ী জুন-জুলাই ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার প্রজনন মৌসুম। এ সময় থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টির পানি জমে যায়। জমে থাকা পরিষ্কার পানিতে এডিস মশার জন্ম হয়। এসময় দরকার বাড়তি সতর্কতা।

নগরবাসীর অসাবধানতা আর অসচেতনতাই ডেঙ্গুতে আক্রান্তের বড় কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

 

এ বছর জুনের শুরু থেকে রাজধানীতে প্রতিদিন গড়ে সাতজন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলেও বর্তমানে সেই সংখ্যা প্রায় ১৪ জনে দাঁড়িয়েছে। এরমধ্যে দুই রোগীর রক্ত পরীক্ষা করে সেরোটাইপ-৩-এর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।

এবার ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে সেরোটাইপ-৩-এর প্রভাব বেশি।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, এবার দেশের সামগ্রিক আবহাওয়া ডেঙ্গুর যথেষ্ট উপযোগী। এ রোগ থেকে নিজেকে নিরাপদে রাখতে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি সরকারিভাবে সমীক্ষা চালিয়ে ডেঙ্গুর সেরোটাইপ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে।

 

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্যমতে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে গেল ২০ জুন পর্যন্ত নারী-পুরুষ-শিশু মিলিয়ে ৭০৭ জন রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৩৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১১৮, মার্চে ১২, এপ্রিলে ৪৪, মে-তে ১৩৯ জন ভর্তি হন। শুধু জুন মাসেই এ পর্যন্ত ৪৪০ জন ভর্তি হয়েছে। অর্থাৎ দিনে গড়ে ১৪ রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ১৯ ও ২০ জুন ৯১ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

ভর্তি রোগীদের মধ্যে এপ্রিলে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। সুস্থ হয়ে ৫৮৭ জন বাড়ি ফিরে গেছেন। গতবছর এ রোগে ৯ হাজার ২২৮ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং ২৪ জনের মৃত্যু ঘটে।

 

 

চিকিৎসকরা বলছেন, এবারও ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে সেরোটাইপ-৩-এর প্রভাব বেশি। তাই এ ক্ষেত্রে রোগীদের নিরাপত্তায় সরকারিভাবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।

 

চলতি বছর বর্ষার আগে করা জরিপে দেখা যায়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৭ টি আর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৫ টি ওয়ার্ড রয়েছে ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে।

সিটি করপোরেশন বলছে, রিপোর্ট আমলে নিয়েই ব্যবস্থা নিচ্ছেন তারা। আর এবারে একই সঙ্গে কাজ করবে দুই সিটি।

 

রোগ প্রতিরোধেও নেয়া হয়েছে প্রস্তুতি। রাজধানী ও এর আশেপাশে ২৮ টি সরকারি ও ৩৬টি বেসরকারি হাসপাতালের ১ হাজার ৩৫০ জন চিকিৎসক ও ১৫৯ জন সেবিকাকে দেয়া হয়েছে ডেঙ্গু চিকিৎসার বিশেষ প্রশিক্ষণ। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে বিকল্প নেই সচেতনতার।

 

বড় পরিসরে প্রচারণায় শিগগিরই একযোগে মাঠে নামছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সিটি করপোরেশন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা বলেন, প্রত্যেকটা ডিরেক্টরের কাছে আমরা মেইল ও চিঠি পাঠিয়েছি। বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে দ্রুত ডেঙ্গু রোগ শনাক্তকরণের বিশেষ কিট বিতরণ করা হয়েছে।

 

তিনি জানান, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ২০১৭ সাল থেকে নিয়মিতভাবে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বছরে তিনবার এডিস মশার জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। ২০১৯ সালের ৩-১২ মার্চ পর্যন্ত চালানো জরিপে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বেশকিছু এলাকায় এডিস মশার ঘনত্ব পরিমাপে ব্যবহৃত সূচকের মাত্রা বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের এ জরিপের ফল অনুসারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব সূচক (বিআই) সর্বোচ্চ ৮০ পাওয়া গেছে।

 

 

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শীত না আসা পর্যন্ত এর প্রাদুর্ভাব কমার সম্ভাবনা কম। এরইমধ্যে ডেঙ্গুজ্বরও ধরণ পাল্টেছে। তাই জ্বর হলে অবহেলা না করার পরামর্শ চিকিৎসকদের।

 

পূর্ণ বয়স্কদের পাশাপাশি এই জ্বরে আক্রান্তন শিশুর সংখ্যাও কম নয়। এতো রোগী সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে হাসপাতালগুলোকে।

 

 

বিএসএমএমইউ'র মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলছেন, অন্য বছরগুলোতে এই সময়টায় ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে আসেও এবার ধরণ পাল্টে আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছে।

 

তাই তার পরামর্শ জ্বর হলেই অবহেলা করা যাবে না। বাসা ও এর আশপাশে কোথাও যেন পানি না জমতে পারে সে সম্পর্কেও সচেতন থাকার পরামর্শ দিলেন এই চিকিৎসক।

 

একইসাথে সিটি করপোরেশনের মশা নিয়ন্ত্রণের যে কর্মসূচী, তাও জোরদার করার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের।