ঢাকা, ২১ ডিসেম্বর শনিবার, ২০২৪ || ৭ পৌষ ১৪৩১
good-food
১৩৭৭

শত বছর অন্ধকারে রাজশাহী কলেজ যাদুঘর

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ০০:৫৬ ৮ জানুয়ারি ২০২৩  

বাঙালি ও বাংলাদেশের স্থাপত্যশিল্পের আদিম নিদর্শন পদ্মাপাড়ের রাজশাহী কলেজ। ভবনগুলোর শৈল্পিক-সুদৃঢ় কাঠামো অনায়াসে ভাবনার জগতে দাগ কাটে যে কারোর। উপমহাদেশে শিক্ষার বিস্তারে ১৮৮৪ সালে ব্রিটিশ রাজ রাজা হরনাথ রায় চৌধুরীর বদন্যতায় গড়ে উঠে এই শিক্ষা মহীরুহ।

 

কালান্তরের যাত্রী হয়ে থাকা প্রতিষ্ঠানে আনুমানিক কয়েক দশক পর প্রাচীন ঐতিহ্য সংরক্ষণে যোগ হয় জাদুঘর। তবে বিগত এক পুরুষ ধরে খোঁজ নেই যাদুঘরটির। বর্তমান কলেজ প্রশাসনের তথ্য মতে শত বছর তালাবদ্ধ-অন্ধকারে রয়েছে রাজশাহী কলেজের সংগ্রহশালা বা যাদুঘর!

 

ফুলার ভবন, প্রশাসন ভবন, হাজি মোহাম্মদ মুহসিন ভবনসহ কলেজটির রয়েছে ঐতিহাসিক বেশ কিছু স্থাপনা। তবে আদিম যাদুঘর সম্পর্কে জানেন না কলেজের শিক্ষার্থীরা। এমনকি কলেজের শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের আড়ালে রয়েছে এ গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহশালা। শিক্ষার্থীদের কাছে এ যেন নতুন কোনো আবিষ্কার!

 

সম্প্রতি একদিন সকাল ১০ টা বেজে ১৫ মিনিটে ঘড়ির কাঁটা। কলেজের লাইব্রেরিয়ান মো. মহিউদ্দিন জানালেন, কলেজ যাদুঘর সম্পর্কে তিনি জানেন না। পরে কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহা. আব্দুল খালেকের কাছে গেলে তিনি উপাধাক্ষ প্রফেসর মো. ওয়ালিউর রহমানকে দায়িত্ব দিলেন প্রতিবেদককে দেখানোর জন্য। কিন্তু পেলেন না সেই যাদুঘরের চাবি। পরের দিন গেইটম্যান মো. শাহীন আলম খুললেন সেই যাদুঘরের তালা। পাশে দাঁড়িয়ে কলেজ উপাধাক্ষ প্রফেসর মো. ওয়ালিউর রহমান।


ভেতরে ঢুকতেই চোখ আটকে গেলো দেয়ালে, টানানো রয়েছে পুরাতন ছবি। ছবিতে নেই কোনো নাম-পরিচয়। আন্দাজে আবছা ধারণা করা যায় এরা দেশি-বিদেশি কবি, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ কিংবা বিখ্যাত কোনো মনীষী। যাদুঘর নামক জায়গাটির মোটেই একটি কক্ষ। রয়েছে দুটি জানালা। জানালা খুলতেই মাকড়সার জাল ডিঙ্গিয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার ঠেলে আলোর রশ্মি ভেতরে ঢুকলো। ধুলোপড়া একটা টেবিল ও দুটি কাঠের আলমারি জানান দিলো তারা এখানকার বাসিন্দা।

 

আলমারির পেট খালি; নেই বই পুস্তকের বালাই। আরো ছোট-খাট পরিবারের সদস্য হিসেবে নিচে পড়ে আছে বিটিশ আমলে একটি ফ্যান ও কাঠের তিনটি পাখা। পাশে দেয়ালে সাঁটানো তাকে (আলমারি) সাজোনো রয়েছে ব্রিটিশ আমলের বই। তবে ধুলোপড়া কভারে; ছিঁড়ে যাওয়া পাতায় বোঝার উপায় কোন আমলের বই সেগুলো। সেই বইগুলোতেও নাই কোনো সংরেক্ষনের আলামত। নাই কোনো সাল তারিখ। এ যেন প্রাচীন পুথি চর্যাপদ আবিষ্কারের নেপালের গোয়ালঘর।

 

জ্বালানো হলো মোবাইল ফোনের টর্চলাইট। এবার যেন চোখের পর্দা নড়েচড়ে বসল। ব্রিটিশ আমলের ঘড়ি রয়েছে আটটি, রেডিও তিনটি, আয়না তিনটি, একটি মূর্তি, দুইটি বিজয়ী মেডেল একটি চ্যাম্পিয়ন অন্যটি রানার্স আপ, বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের ১২টি ছবি, কাঠের উপর প্রিন্টিং করে বিভিন্ন ঐতিহ্যের ছবি রয়েছে ৩৪টি।


এছাড়া একটি রয়েছে অফিসিয়াল ডেস্ক, ছয়টি বিভিন্ন ঝাড়বাতি, মাইক্রোস্কোপ দুইটি, একটি নিকতিসহ বিভিন্ন সায়েন্সের ইন্সট্রুমেন্ট রয়েছে মোট ছয়টি। রয়েছে কাগজ প্রিন্টিং’র জন্য ব্যবহৃত একটি প্রিন্টার মেশিন, টেস্টটিউব স্যান্ড, প্রিন্টিং অলমেট রয়েছে দুইটি ও বিভিন্ন সময়ের শিক্ষকদের একটি ওনারবোর্ড রয়েছে। এছাড়া একটি বড় টেবিল ও একটি চেয়ার ছিল যেটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানান কলেজ অধ্যক্ষ।

 

আধুনিক রাজশাহী কলেজের রূপকার সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর মহা. হবিবুর রহমান জানান, এসব বস্তুগত ঐতিহ্য সংরক্ষণে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। বিভিন্ন জিনিসের ছবি স্ক্যান করে ডিজিটাল আর্কাইভে রেখেছিলেন। তবে সেগুলোর কাগজে ডকুমেন্ট বা সাল তারিখ না জানার কারণে বিস্তারিত রাখা সম্ভব হয়নি।

 

রাজশাহী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শিক্ষাবিদ হবিবুর রহমান বলেন, এসব নিদর্শন শিক্ষার্থীদের জ্ঞান বিকাশের উৎস। আমার মনে হয় সবার আগে এই নিদর্শনগুলো হেফাজতে নেওয়া দরকার। এত পুরোনো নিদর্শন আর পাওয়া যাবে না। সেজন্য আর্কাইভ করা উচিৎ। ঐতিহ্য নিয়ে একটি স্মারক লেখা হয়। সেই স্মারকে এগুলোর নাম ঠিকানা ছিল শুনেছিলাম। তবে সে সারকগুলো নাকি পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল না জানা বসতে তাই পরে আর বিস্তারিত কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।


বস্তুগত নিদর্শনগুলো কতটুক সংরক্ষণ করা জরুরি বলে মনে করেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ঘড়ি, মিটসেফ, আলনাসহ বেশ কিছু বস্তুগত নিদর্শন রয়েছে সেগুলোকে সংরক্ষণ করা অতীব জরুরী। শুধু তাই নয়; বর্তমানে যেগুলো হবে সেগুলোও কিন্তু সংরক্ষণ করা জরুরী। কারণ ৫০ বছর পর এগুলো একটা ইতিহাস হবে। কলেজের প্রত্যেকটা জিনিস সংরক্ষণ করা জরুরি চিঠিপত্র বা বিভিন্ন জায়গার ছবি সংরক্ষণ করা এবং ডিজিটাল আর্কাইভে রাখা খুবই দরকার।

 

কলেজের ঐতিহ্য নিয়ে একটি জাদুঘর বা ঐতিহ্য স্থাপনা রয়েছে সে বিষয়ে তার কোন ধারণা আছে কিনা সে বিষয়ে কথা হয় কলেজের অর্থনীতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মৌ বিশ্বাসের সাথে। তিনি বলেন, কলেজটি আমাদের বেশ সুন্দর লাগে তবে কলেজের ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে এরকম কোনো স্থাপনা আছে কিনা আমার জানা নেই। আমার মনে হয় কোন শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে অবগত নন। তবে সেটি সম্পর্কে আমাদেরকে শিক্ষকরা যদি ধারণা দেন তাহলে সেটি যদি সরাসরি আমরা দেখতে পাই সেখান থেকে আমরা বেশ উপকৃত হব।

 

কলেজের ভূগোল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সৌমিত্র সরকার জানান একই কথা। তিনি বলেন কলেজের লাইব্রেরি সম্পর্কে আমাদের ধারণা রয়েছে সেখানে বেশ কিছু পুরনো বই রয়েছে। কিন্তু কলেজের ঐতিহ্য নিয়ে যে কোনো সংগ্রহশালা রয়েছে সেটি আমাদের জানা নেই। জানতে পারলে হয়তোবা একবার দেখতে যেতাম। আসলে একজন শিক্ষার্থীর জন্য জানা দরকার কলেজের ঐতিহ্য সম্পর্কে। আর সেটি যদি সরাসরি দেখতে পাই তাহলে তো আরো ভালো হয়।

 

ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সৌরভ আহমেদ জানান, আমি রাজশাহী কলেজে পড়াশোনা করছি। যে ঘরটির কথা বললেন সেটির কথা আজকেই আপনার মুখ থেকে প্রথম শুনলাম যে আমাদের কলেজে একটি ঐতিহ্যবাহী ঘর রয়েছে। যেখানে ঐতিহ্যের বিভিন্ন নিদর্শন সংরক্ষিত রয়েছে। এ বিষয়ে আমরা কখনো জানতাম না। আমার মনে হয় এ বিষয়ে আমাদের সহপাঠী বন্ধু-বান্ধব যারা রয়েছে তারা কেউই জানেন না। যদি আমাদেরকে উন্মুক্ত করে দেয়া হয় আর সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয় তাহলে অবশ্যই রাজশাহী কলেজের ইতিহাস সম্পর্কে আরো ভালোভাবে জানতে পারবো। কলেজ অধ্যক্ষের কাছে তিনি উন্মুক্ত দর্শনের ব্যবস্থা করে দেয়ার দাবি জানান।

 

ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. হাবিবুর রহমান জানান, তারা আসেন, ক্লাস নেন, চলে যান। কেবলই তাদের বিভাগের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। ইতিহাস চর্চার সুযোগ নেই। শুধু শিক্ষকরাই দায়ী নয়; এখানে শিক্ষার্থীদের অনেক দায়বদ্ধতা রয়েছে। তারা ইতিহাস সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রকাশ করছে না।

 

তিনি বলেন, তারা তো দেখতে চায় না, জানতে চায় না, কিভাবে জানতে পারবে? তাদেরও তো জানার আগ্রহ থাকতে হবে। শুধু ওখানে নয়; জানার যদি আগ্রহ থাকে রাজশাহী কলেজে অনেক কিছুই রয়েছে সেগুলো নিয়েও তারা জানতে পারে। আমাদের রাজশাহী কলেজে সমৃদ্ধময় একটি লাইব্রেরি রয়েছে যেখানে অনেকদিনের পুরনো বইপুস্তক রয়েছে সেখান থেকে অনেক কিছুই কিন্তু জানতে পারবে। কিন্তু সেই মন মানসিকতা শিক্ষার্থীদের মধ্যে তৈরি করতে হবে। তবে ইতিহাস চর্চায় প্রত্যেক বিভাগকে আলাদা উদ্যোগ নেয়া দরকার। উদ্যোগ নিতে হবে কলেজকেও।

 

কলেজের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে শ্রেণিকক্ষে তেমন চর্চা নেই স্বীকার করেন একাধিক শিক্ষক। তারা জানিয়েছেন, কলেজের লাইব্রেরিতে এ নিয়ে সমৃদ্ধ বই-পুস্তক রয়েছে। যে কেউ চাইলে সেখান থেকে জেনে নিতে পারেন কলেজের ইতিহাস। নিজেকে করতে পারেন আরও বেশি সমৃদ্ধ। ইতিহাসের অংশ রাজশাহী কলেজ। এ ইতিহাস চর্চার দায়িত্ব সবার। 

 

রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহা. আব্দুল খালেক বলেন, রাজশাহী কলেজ একটি ঐতিহ্যবাহী কলেজ। দীর্ঘ সময় এই পথ পরিক্রমায় বিভিন্ন সুনামধন্য ব্যক্তিবর্গ এসেছিলেন। এই কলেজের বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ কলেজে দায়িত্ব পালন করেছেন আবার বের হয়েও গেছেন। এছাড়া কিছু ব্যবহার্য জিনিস রয়েছে। যেহেতু কলেজ সার্ধশতবর্ষ বছর পদার্পণ করলো। সেখানে বেশ কিছু নিদর্শন থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এখানে কিছু সংরক্ষণ রয়েছে। তবে বেশি কিছু যে আছে সেটা বলা যাবে না। সর্বমোট ৩০ থেকে ৩৫ রকমের জিনিসপত্র হবে। তবে এই ঘরটি যে সব সময় খুলে রাখা হয় সেটি করা হয় না। প্রয়োজন হয় ঠিক তখনই খোলা হয় যেমন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বা কোন বিশিষ্ট ব্যক্তির দেখাশোনা করতে আসলেন আর তখন শুধু খোলা হয়।

 

তিনি আরো বলেন, এই কক্ষটি লাইব্রেরির অংশ করে লাইব্রেরিয়ানকে দায়িত্ব দিয়ে ভাবে সংরক্ষণ করা যায় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা যায় সেটিকে নিয়ে চিন্তাভাবনা করছি। এছাড়া চিহ্নিত করার জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার সেটি আমরা করব। যদিও সাল তারিখ সেভাবে পাওয়া যাবে না তবে যতটুক সম্ভব ততটুকু আমরা আইডেন্টিফাই করার চেষ্টা করব। করে যে কোন মানুষ এসে বুঝতে পারে যে, এটি রাজশাহী কলেজের ঐতিহ্যের স্থান এটা ধারণা করতে পারে।

 

কলেজ অধ্যক্ষ বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীরা বা আমরা যে বিভিন্ন যাদুঘর বা সংগ্রহশালা যায়, সেখানে আমরা দেখি বিভিন্ন সময়ের বই পুস্তক বা বিভিন্ন আসবাবপত্র। ঠিক তেমনি রাজশাহী কলেজের চেয়ে একটি সার্ধশত বছরের ইতিহাস রয়েছে, কখন কি ঘটেছে কখন কোন শিক্ষক ছিলেন এ সম্পর্কে ধারণা পাবে। আমাদের কাছে হয়তোবা সেগুলো অনেক কিছু লিখিত রয়েছে কিন্তু প্র্যাকটিক্যাল যেটা ধারণা পাওয়া দরকার সেটা কলেজের ঐতিহ্যের এই ঘরটিতে গিয়ে দেখলে সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী হবে শিক্ষার্থীরা। অনেক সময় এরকম হয় যে লিখিত চেয়ে কাউকে দেখলে তাকে জানার আগ্রহ বেশি যাবে সেখান থেকেই আমরা লেখার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের এসব দেখানোর চেষ্টা করব। এতে শিক্ষার্থীদের মাঝে জানার আগ্রহ বাড়বে ও ভালোবাসা তৈরি হবে।