ঢাকা, ২৩ নভেম্বর শনিবার, ২০২৪ || ৯ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
১০৭১

শিশুকে টাকা-পয়সা খরচের শিক্ষা দিন

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২৩:৩৩ ১২ জুন ২০২১  

শিশুদেরকে অর্থনৈতিক ব্যাপারে প্রাথমিক ধারনা দেয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা যে প্যারেন্টিং (শিশুদের ভবিষ্যৎ গঠনে পিতা-মাতার ভূমিকা) একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়- তা আমরা অনেকেই জানি না। আপনি সঠিকভাবে প্রতিপালন করলেও সন্তান যদি অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের প্রাথমিক জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হয়, ভবিষ্যতে তাকে নির্মম ও রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে। 


বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশুরা গণমাধ্যম, বিজ্ঞাপণ এবং বন্ধুবান্ধব দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। অর্থ বিষয়ক ব্যাবস্থাপনা যদি ছোটবেলায় শেখানো না হয়, তাহলে হয় সে বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পড়ে অর্থ অপব্যয় করবে অথবা বিজ্ঞাপণ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কনজিউমারিজমে (পণ্য কেনায় আশক্তি) আক্রান্ত হবে। 


এ ছাড়া যেসব শিশুরা ছোটবেলায় অর্থনৈতিক সমস্যার মধ্য দিয়ে বড় হয়, তাদের মধ্যে সাধারণত অর্থের প্রতি আগ্রহ বেশি থাকে। এদের কারো কারো মধ্যে কখনও কখনও অসততা ও প্রতারণা দেখা দিতে পারে। তাই ছোটবেলা থেকেই শিশুকে দৈনন্দিন অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে পরিচয় ঘটিয়ে দিতে হবে। 

তবে কীভাবে এই পাঠ শুরু করবেন- সেটা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সাধারণত পাঁচ বছরের আগে শিশুদের হাতে কোনভাবেই টাকা পয়সা দিবেন না। ছয় বছর থেকে শিশুর হাতে সীমিত পরিমাণ টাকা দেয়া শুরু করবেন। এক্ষেত্রে অবশ্যই দিকনির্দেশনা এবং নজরদারি দুটোই থাকতে হবে। তারপর বয়সের সাথে সঙ্গতি রেখে আস্তে আস্তে টাকার পরিমাণ বাড়াবেন। 


তবে কোন প্রক্রিয়ায় দেবেন এবং কীভাবে এই অর্থের সুষম ব্যবহার নিশ্চিত করবেন? – এটা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। টাকা হাতে দেয়ার আগেই শিশুকে সঞ্চয়, দান এবং প্রয়োজনীয় খরচ- এই তিনটি বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা অবশ্যই দিয়ে দিবেন। তাকে হাতে কলমে অভ্যস্থ করানোর জন্য তিনটি স্বচ্ছ  জার বা পাত্র দিয়ে শুরু করতে পারেন। 


তিনটি কাগজে সঞ্চয়, দান, প্রয়োজনীয় ব্যয় লিখে তিনটি জার চিহ্নিত করে দিন। ধরুন শিশুকে আপনি পাঁচ টাকা দিলেন। সেখান থেকে তাকে ২ টাকা সঞ্চয় পাত্রে জমা রাখতে বলুন, আরও ২ টাকা দান পাত্রে এবং বাকী ১ টা প্রয়োজনীয় খরচ পাত্রে রাখতে বলুন। সন্তানকে হাত খরচ হিসেবে যে টাকাটা দিবেন, সেটা থেকে প্রথমেই একটি অংশ সঞ্চয় করতে উদ্বুদ্ধ করুন। 


অর্থাৎ ছোট বেলা থেকেই সঞ্চয়ে অভ্যস্ত করে তুলুন। একটি অংশ যেন সে অন্যের জন্য ব্যয় করে সেই শিক্ষাও দিন। সেটা হতে পারে ছোট ভাই-বোনের জন্য বিস্কুট কিনে দেয়া অথবা অভাবী বিপন্ন মানুষকে সহায়তা করা। এর মধ্য দিয়ে তার মধ্যে দানের মানসিকতা গড়ে উঠবে। বাকী অংশটা তাকে নিজের মতো খরচ করতে দিন। শুধু খেয়াল রাখবেন অনৈতিক কিছু যেন না করে। 


বয়স দশ বছর হলে, প্রতি সপ্তাহের হাত খরচ একবারে দিয়ে দিবেন। কোন খাতে কত দিচ্ছেন- তা একটি কাগজে লিখে দিবেন। অর্থাৎ কত টাকা সঞ্চয় করবে, কত টাকা দান করবে, কত টাকা টিফিনে ব্যয় করবে, কত টাকা যানবাহনে ব্যয় করবে, কত টাকায় সে তার পছন্দসই কোন জিনিস কিনতে পারবে ইত্যাদি। 

প্রতি সপ্তাহে দেয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে- বেশি টাকায় কীভাবে বাজেট করতে হয়, সেটা শিশুকে শেখানো। প্রতি সপ্তাহে তার খরচের হিসাব লিখে রাখতে উৎসাহিত করুন। প্রথম কয়েক মাস নজরদারিতে রাখবেন কিন্তু হস্তক্ষেপ করতে যাবে না। 


সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে সে কী করবে- এই ব্যাপারটিও তাকে ঠিক করতে দিন। প্রয়োজনে তাকে সহযোগিতা করতে পারেন। যেমন সেটা হতে পারে- সাইকেল কেনা, উৎসবের আগে জামা কেনা, বই কেনা অথবা পরিবারের কাউকে কোন কিছু উপহার দেয়া ইত্যাদি। 
 

১২ বছর বয়স থেকে, হাত খরচ প্রতি মাসে একবারেই দিয়ে দিবেন। বেশি টাকায় কীভাবে আর্থিক ব্যবস্থাপনা করতে হয়, সেই শিক্ষা দেয়া। এবার হাত খরচের সাথে তার যাবতীয় খরচ দিয়ে দিন। অর্থাৎ তার পোশাক পরিচ্ছদ, পড়াশোনার খরচ, পাঠ্য বহির্ভূত বই,  বিনোদন, ইত্যাদি। 


এক্ষেত্রে কোন খাতে সে কত খরচ করবে- এ ব্যাপারে তাকে পুরোপুরি স্বাধীনতা এবং সিদ্ধান্ত নিতে দিন। ভুল করলে ধরিয়ে দিন। যদি সে বেশি খরচ করে ফেলে, এক্ষেত্রে কখনো তাকে ছাড় দিবেন না। রাগারাগি বা শোরগোল না করে, পরের মাসের হাত খরচ থেকে বাড়তি টাকাটা কেটে রাখুন। 


অর্থাৎ জরুরী প্রয়োজন ব্যাতিত মাসিক বাজেটের বাইরে যাওয়া যাবে না- এই শিক্ষাটুকু তাকে হাতে কলমে দেয়া। সে যদি টিফিন না কিনে বাসার খাবার খেতে চায় অর্থাৎ টিফিনের টাকাটা সঞ্চয় করতে চায়, এ ব্যাপারে তাকে সহযোগিতা করুন। 

একইভাবে সে যদি হেটে অথবা অন্য কোন সহজ মাধ্যমে যাওয়া আসা করে যাতায়াত ভাড়া থেকে সঞ্চয় করতে চায়, এ ব্যাপারে তাকে উৎসাহিত করুন। যাতায়াতের ক্ষেত্রে অবশ্যই গণপরিবহনের ভাড়া দিবেন। এক্ষেত্রে অবশ্যই স্থান কাল পরিস্থিতি বিবেচনায় রাখবেন। 


তবে যে কাজটি কখনোই করতে যাবেন না, তা হলো প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা দিতে যাবেন না। এতে করে শিশুর মধ্যে বিলাসিতা ও অপব্যয়ের অভ্যাস গড়ে উঠতে পারে। এছাড়াও সীমিত সম্পদ ব্যবহার করে কীভাবে সর্বোচ্চ উপযোগ পাওয়া যায়- এই দক্ষতাটিও তার মধ্যে তৈরি হবে না। 


আপনার পরিবারের আয় ও ব্যয়ের বিস্তারিত ১৪ বছরের ছোট সন্তানকে জানানোর দরকার নেই। সংসারে অভাব থাকলেও তা সন্তানের সামনে প্রকাশ করতে যাবেন না। সন্তানের জন্য আপনারা কষ্ট করছেন- একথা কখনো বলতে যাবেন না। এর ফলে সন্তান বাড়তি একটি চাপ অনুভব করবে এবং হীনমন্যতায় ভোগবে। ১৪ বছরের পর থেকে সন্তানকে পরিবারের আয় ও ব্যায়ের টুকিটাকি আস্তে আস্তে জানাতে শুরু করবেন। 


১৪ বছরের পর ধীরে ধীরে তাকে বড়দের মতোই স্বীকৃতি দিতে শুরু করবেন। পারিবারিক খরচের খাতসমূহ সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিবেন। তাকে দিয়ে বাজার করানো, গ্যাস-বিদ্যুত-পানি-পৌর কর ইত্যাদি বিল পরিশোধ করাবেন। পারিবারিক উপার্জনের উৎস সম্পর্কে পুরোপুরি না হলেও প্রাথমিক কিছু ধারণা দিবেন। 


মানসিক স্তর বুঝে ধীরে ধীরে পরিবারের পুরো অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সম্পর্কে (আয়, ব্যয় ও সঞ্চয়) বিস্তারিত জানাবেন। পরিবারের জন্য কোন জিনিস কিনলে সেটা কেন কিনছেন-সেটা তাকে খুলে বলুন। কোন ধরনের ব্যবসা বা বিনিয়োগে গেলে তাকে সাথে নিয়ে পরিকল্পনা, বাজেট এবং কাঙ্খিত লক্ষ্য ঠিক করবেন। 


ভুল সঠিক যাই বলুক না কেন, গুরুত্বপূর্ণ পারিবারিক ব্যয় অথবা বিনিয়োগে তার মতামত নিবেন। কোন কৌশলে আপনি এগুতে চাচ্ছেন, তা তাকে জানাবেন। তবে আপনি কতটুকু জানাবেন তার পুরোটাই নির্ভর করছে সন্তানের মানসিক স্তর বা বুদ্ধিমত্তার উপর। যদি মনে হয়, সন্তান এই মূহুর্তে এসব ব্যাপার হজম করতে পারবে না, প্রয়োজনে আরো কিছু দিন পর্যবেক্ষণ করুণ। 


এই সময়ে সন্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক প্রজ্ঞা সঞ্চারের চেষ্টা করবেন। মানুষের জীবনে কেন সঞ্চয় প্রয়োজন- সেটা তাকে বুঝিয়ে বলুন। ভবিষ্যতে পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে অথবা দূর্ঘটনা ঘটলে অথবা অন্য কোন অতীব জরুরী প্রয়োজনে অর্থের প্রয়োজন হলে, তখন সঞ্চয়ই একমাত্র ভরসা। 


পারতপক্ষে কারো কাছে যেন হাত পাততে না হয়- এই আত্মমর্যদাবোধ সন্তানের মধ্যে সঞ্চারিত করবেন। সঞ্চয়ের অভ্যাসকে আরো বৃহত্তর পরিসরে নিয়ে যাওয়ার জন্য, যেকোন স্বীকৃত ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে উদ্বুদ্ধ করুন। 


কলেজে উঠার পর থেকেই অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে স্বাভলম্বী হতে শিখে- এ ব্যাপারে শিশুদেরকে উৎসাহিত করবেন। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে খন্ডকালীন কাজ করতে উৎসাহিত করুন। এর ফলে সে পরিশ্রমলদ্ধ অর্থ উপার্জনের অভিজ্ঞতা অর্জন করবে, যা তার ভবিষ্যত জীবনকে অনেক বেশি সমৃদ্ধ করবে।  


অর্থনৈতিক ব্যাপারে আপনাকে যতেষ্ট বাস্তববাদী হতে হবে। অর্থের প্রয়োজন নেই এই ধরনের শিক্ষা শিশুকে দিবেন না আবার অর্থের বিনিময়ে সব কিছু কেনা যায় না- এটাও শিশুকে বুঝিয়ে দিন। আপনার দৃষ্টিভঙ্গি-ই শিশুকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করবে। আপনি নিজে মিতব্যায়ী হোন। 


আপনি উড়নচণ্ডি হলে আপনার শিশুও অর্থকে মূল্যায়ন করতে শিখবে না, অপচয় করবে। বাকী বা ঋণ করে কেনাকাটাকে পুরোপুরি বর্জন করবেন এবং শিশুদেরকে নিরুৎসাহিত করবেন। ক্রেডিট কার্ডের ফাঁদ সম্পর্কে শিশুদেরকে আগেই সতর্ক করবেন। 


আপনার আশেপাশে পরিচিত মানুষজন ঋণগ্রস্থ হয়ে কীভাবে নিঃস্ব হয়েছে, কেন হয়েছে- সেই উদাহরণ শিশুর সামনে তুলে ধরুন। যাতে সে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। সন্তান যেন লটারি, গুপ্তধন কিম্বা অন্যের আশায় যেন বসে না থাকে- এ বিষয়ে সন্তানকে আগে থেকেই সতর্ক করবেন। 


পরিশ্রম ছাড়া যারা টাকা অর্জন করতে চায় এবং যারা বেশি লোভ করে, তারাই প্রতারণার ফাঁদে পড়ে। শিশুকে সব সময় অপচয়, বাহুল্য, ফুটানি ও বিলাসী জীবনযাপনকে নিরুৎসাহিত করবেন। সব সময় আয়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে দান ও সঞ্চয় করাকে উৎসাহিত করবেন। 
লেখক- শিক্ষা বিষয়ক গবেষক
[email protected]
আরকে//

শিশু বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর