ঢাকা, ৩০ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার, ২০২৫ || ১৭ মাঘ ১৪৩১
good-food
২০

সাইফ আলি খানের ১৫ হাজার কোটি রুপির সম্পদের কী হবে?

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৮:১০ ২৯ জানুয়ারি ২০২৫  

ভোপালের নবাবের ১৫ হাজার কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তির উত্তরাধিকার সাইফ আলি খান ও তার পরিবারের সদস্যরা পাবেন? নাকি এই বিপুল সম্পত্তি ভারত সরকারের কাছে চলে যাবে? গত কয়েকদিন ধরে এই প্রশ্নগুলোই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।

 

এই মুহূর্তে ভোপালের আহমেদাবাদ প্যালেস, ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউজ, হাজার হাজার একর জমি এবং চারপাশের ঐতিহাসিক ভবনগুলো একটা বড়সড় বিতর্কের অংশ হয়ে উঠেছে। সাইফ আলি খানের শৈশব কেটেছে এই ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউজে।

 

ভোপালের নবাবের এই বিপুল সম্পত্তিকে ঘিরে বিতর্কের কারণ হলো–এগুলোকে 'এনিমি প্রপার্টি' বা 'শত্রু সম্পত্তি' বলে ঘোষণা করার প্রক্রিয়া কেন্দ্রীয় সরকার ইতোমধ্যে শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো কেন? 'কাস্টডিয়ান অফ এনিমি প্রপার্টি ফর ইন্ডিয়া'-এর ২০১৫ সালের এক নথি অনুযায়ী, ভোপালের নবাব হামিদুল্লাহ খানের বড় মেয়ে আবিদা সুলতান ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন।

 

নয়াদিল্লি সরকারের দাবি, ফলে নবাবের সম্পত্তি 'এনিমি প্রপার্টি অ্যাক্ট' বা 'শত্রু সম্পত্তি আইন' আওতায় চলে এসেছে। আবিদা সুলতান ছিলেন সাইফ আলী খানের দাদি সাজিদা সুলতানের বড় বোন। কেন্দ্র সরকারের এই দাবিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন সাইফ আলি খান ও তার পরিবার। মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্টে একটা পিটিশন দায়ের করেছিলেন তারা।

 

গত বছর ১৩ ডিসেম্বর হাইকোর্ট জানিয়েছিলেন, 'শত্রু সম্পত্তি' সংক্রান্ত বিরোধের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য অ্যাপিলেট অথরিটি গঠন করা হয়েছে। এই অথরিটির কাছে কেন্দ্র সরকারের দাবির বিরুদ্ধে আবেদন জানাতে পারেন সাইফ আলি খান ও তার পরিবার।

 

জেলা কালেক্টর কী বলছেন?
এই বিষয়ে ভোপালের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কৌশলেন্দ্র বিক্রম সিংয়ের সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি হিন্দি। তিনি বলেন, আমি এইমাত্র হাইকোর্টের নির্দেশের বিষয়ে জানতে পেরেছি। সেটা (আদালতের নির্দেশ) পর্যবেক্ষণ করার পর আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

 

ভোপালে যে সমস্ত সম্পত্তি 'শত্রু সম্পত্তি' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলোর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, এর আগেও একটা সমীক্ষা করা হয়েছিল, সেখানে শত্রু সম্পত্তি সম্পর্কে বিবরণ দেয়া হয়েছিল। যদি বিশেষভাবে এই মামলা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন, তাহলে বলব এখনও এই নিয়ে কোনো তথ্য নেই। এই বিষয়ে দফতর থেকে একবার খোঁজ নিতে হবে, তারপরই আমরা বিস্তারিত জানাতে পারব।

 

ভোপালবাসীর 'গৌরব'
মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভোপালের কোহে ফিজা এলাকার বাসিন্দা আব্দুল্লাহ খান। তার কাছে কেন্দ্র সরকারের পক্ষ থেকে নবাবের সম্পত্তিকে 'শত্রু সম্পত্তি' হিসেবে ঘোষণা করার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি হেসে ফেলেন।
আব্দুল্লাহ খান বলেন, মিয়া, যখন বিষয়টা ভোপালীদের আন, বান ও শানের (সম্মান ও গৌরবের) ওপর চলে আসে, তখন ভোপালীরা পিছু হটে না।

 

বর্তমানে তিনি ও তার পরিবার যে এলাকায় বাস করছেন সেটা একসময় ভোপালের নবাবের রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল।আব্দুল্লাহ খান বলেন, স্বাধীনতার পর সার্বভৌম ভোপাল রাজ্য ভারতের সঙ্গে এক হয়ে যায়। তারপর নবাব হামিদুল্লাহ খানের দ্বিতীয় কন্যাকে ভোপালের নবাব হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। বাবা (নবাব হামিদুল্লাহ খান) জীবিত থাকাকালীনই বড় মেয়ে আবিদা সুলতান পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। এখানে তার নামে কোনো সম্পত্তি নেই।

 

ভোপালের নবাব হামিদুল্লাহ খান
ভোপালের নবাব হিসেবে ১৯২৬ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করেন হামিদুল্লাহ খান। বড় দুই ভাইয়ের মৃত্যুর পর এই দায়িত্ব তার কাছে আসে। রাজনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে নবাব হামিদুল্লাহ খানের রাজত্বকাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নবাবের তিন কন্যা ছিলেন–আবিদা সুলতান, সাজিদা সুলতান ও রাবিয়া সুলতান। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর নবাব হামিদুল্লাহ খান ভারতে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

 

১৯৫০ সালে আবিদা সুলতান তার ছেলে শাহরিয়ার খানকে নিয়ে পাকিস্তানে চলে যান। প্রসঙ্গত, এই শাহরিয়ার খানই পরবর্তীকালে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব সামলেছেন। শুধু তাই নয়, পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের চেয়ারম্যানও ছিলেন তিনি।

 

আবিদা সুলতানের পাকিস্তানে চলে যাওয়ার পর ভারত সরকার ১৯৬২ সালের জানুয়ারিতে নবাব হামিদুল্লাহ খানের দ্বিতীয় কন্যা সাজিদা সুলতানকে ভোপালের নবাব হিসেবে ঘোষণা করে। ইতিহাসবিদ সিকান্দার মালিক ভোপালের নবাবদের বিষয়ে অধ্যয়ন করেছেন। তার কথায়, নবাব হামিদুল্লাহ খান ১৯২৬ সালে ভোপালের নবাব হন। তার দুই বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পরই তিনি এই ক্ষমতা পান। তাই উত্তরসূরি নিয়ে বিতর্ক এই পরিবারের জন্য নতুন কিছু নয়।

 

ভোপালের নবাবের উত্তরাধিকারী
সাজিদা সুলতানের বিয়ে হয়েছিল পতৌদির নবাব ইফতিখার আলি খানের সঙ্গে। এই দম্পতির তিনজন সন্তান– মনসুর আলি খান পতৌদি, সালেহা সুলতান ও সাবিহা সুলতান। সাজিদা সুলতানের মৃত্যু হয় ১৯৯৫ সালে। তারপর মুসলিম পারিবারিক আইন মেনে তার সম্পত্তি তিন সন্তানের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়। আবার মনসুর আলী খান পতৌদি নিজের অংশের সম্পত্তি তার তিনজন সন্তান–সাইফ আলী খান, সোহা আলী খান ও সাবা আলী খানকে ভাগ করে দেন।

 

এভাবে সাইফ আলী খান ও তার বোনেরা ভোপালের নবাবের উত্তরাধিকারী হন। প্রসঙ্গত, নবাবের বিপুল সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে ভোপালের ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউজ, আহমেদাবাদ প্যালেস, নূর-উস-সাবাহ প্যালেস এবং প্রায় পাঁচ হাচার ৮০০ একর জমি। এই সম্পত্তি ছাড়া সেহোর ও রাইসেন জেলায় প্রায় এক হাজার ৪০০ একর জমিও রয়েছে।

 

ভোপালের বাসিন্দাদের মধ্যে একজন হলেন সুমের খান। তার পূর্বপুরুষরা তৎকালীন নবাবের রাজত্বে বাস করেছেন। সুমের খানের কথায়, ভোপালের নবাবের বড় মেয়ে পাকিস্তানে চলে যাওয়ার পরেও নবাব সাহেব বেঁচে ছিলেন। মৃত্যুর পর তার ছোট মেয়ে সাজিদা সুলতান, পরে মনসুর আলী খান এবং তার মৃত্যুর পর ছেলে সাইফ আলি খানকে ভোপালের নবাব হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এখন সরকার কীভাবে এটাকে শত্রু সম্পত্তি বলে ঘোষণা করছে, সেটা বোঝা মুশকিল।

 

'শত্রু সম্পত্তি' নিয়ে বিতর্ক
ভারতে 'এনিমি প্রপার্টি অ্যাক্ট' চালু হয় ১৯৬৮ সালে। এর আওতায় যে সমস্ত ব্যক্তিরা পাকিস্তান বা চীনের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছিলেন, তাদের ভারতে থাকা সম্পত্তিকে 'এনিমি প্রপার্টি' বা 'শত্রু সম্পত্তি' হিসেবে ঘোষণা করা হয়।'শত্রু সম্পত্তি' চিহ্নিত করা নিয়ে বিতর্ক কিন্তু নতুন নয়। উত্তরপ্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডের মাহমুদাবাদের রাজার যে সম্পত্তি ছিল, সেগুলো 'শত্রু সম্পত্তি' বলে ঘোষণা করা হয়েছিল।

 

সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। বিস্তর আলোচনাও হয়েছিল এই মামলা নিয়ে। রাজা মোহাম্মদ আমির আহমেদ খান ১৯৭৫ সালে পাকিস্তানের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে তাদের সম্পত্তিগুলোও 'শত্রু সম্পত্তি' হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সরকারের এই দাবিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয় তার পরিবার। ২০০৫ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে 'শত্রু সম্পত্তির' মালিকানা সংশ্লিষ্ট পরিবারের কাছেই থাকবে। পরে সরকার একটা অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে এই সিদ্ধান্ত বদলের চেষ্টা চালায়।

 

ভারত সরকারের 'দ্য কাস্টডিয়ান অব এনিমি প্রপার্টি ফর ইন্ডিয়া' দপ্তর ২০১৫ সালে দাবি করে, ভোপালের নবাবের সমস্ত সম্পত্তি আবিদা সুলতানের। যেহেতু তিনি পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন তাই এই সম্পত্তিগুলো এখন 'শত্রু সম্পত্তির' আওতায় চলে আসবে। এরপরই এই দাবিকে চ্যালেঞ্জ জানান সাইফ আলি খান ও তার পরিবার। আপাতত মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্ট 'শত্রু সম্পত্তির' সংক্রান্ত মামলার নিষ্পত্তির জন্য তৈরি অ্যাপিলেট অথরিটি গঠন করা হয়েছে।

 

আবিদা সুলতানের পাকিস্তান যাওয়া

আবিদা সুলতানের জীবন ভোপালের রাজনীতি ও সংস্কৃতির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। ঐতিহাসিকদের মতে, ১৯২৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে ভোপালের নবাবের উত্তরসূরি হিসেবে মনোনীত করা হয়। তাই বাবার সঙ্গে তিনি প্রশাসনিক কাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতেন।

 

কুরওয়াইয়ের নবাব সারওয়ার আলি খানের সঙ্গে ১৯২৬ সালে আবিদা সুলতানের বিয়ে হয়। আবিদা সুলতানের আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, ১৯৩৪ সালের ২৯ এপ্রিল তার একমাত্র পুত্র শাহরিয়ার মোহাম্মদ খান জন্মগ্রহণ করেন। তবে আবিদা সুলতান ও নবাব সারওয়ার আলি খানের দাম্পত্য জীবন বেশিদিন টেকেনি। একসময় ভোপালে ফিরে আসেন তিনি।

 

ইতিহাসবিদ সিকান্দার মালিক বলেন, দেশভাগ ও স্বাধীনতার সময় অনেক কিছুই বদলে যাচ্ছিল। রাজনৈতিক পালাবদল ছাড়াও নবাব সাহেবের (হামিদুল্লাহ খান) জীবনে অনেক ঝড় ঝাপটা আসে। ১৯৪৬ সালে হামিদুল্লাহ খান দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। একে কেন্দ্র করে পরিবারে কলহ বেড়ে যায়। এদিকে আবিদা সুলতান লক্ষ্য করেন ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, বাড়ির পরিস্থিতিও তার পক্ষে ছিল না। তাই ১৬ বছরের ছেলেকে নিয়ে পাকিস্তানে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।

 

এখন প্রশ্ন হলো ভোপালের নবাবের সম্পত্তিকে 'শত্রু সম্পত্তি' বলে ঘোষণা করা হলে সেখানকার বাসিন্দাদের জীবনেও কী এর প্রভাব পড়বে? এর উত্তর হলো, হ্যাঁ। ভোপালের নবাবের সম্পত্তি 'শত্রু সম্পত্তি' হলে এই সিদ্ধান্ত শুধু সাইফ আলি খান ও তার পরিবারকেই নয়, ভোপালের লক্ষ লক্ষ বাসিন্দাদেরও প্রভাবিত করবে।

 

নবাবের সম্পত্তির মধ্যে এমন অনেক সম্পত্তি রয়েছে যেখানে এখন স্থানীয় মানুষ বসবাস করেন। ভোপালের বাসিন্দা সুমের খান বলেন, এই সম্পত্তিগুলো বাজেয়াপ্ত করা হলে ১০ থেকে ১৫ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

 

ভোপালের খানুগাঁও এলাকার বাসিন্দা মহম্মদ নাসিমের সম্পত্তিও একসময় নবাবের ছিল। তিনি বলেন, আমাদের দাদা-বাবা ভোপালের নবাবদের কাছে কাজ করতেন। আজ আমরা যেখানে বাস করি সেটা আমাদের পূর্বপুরুষদের বসবাস ও চাষের জন্য দিয়েছিলেন নবাব হামিদুল্লাহ খান।

 

ভোপালের রাজকীয় সম্পত্তিগুলোর অন্তর্ভুক্ত সম্পত্তিতে এখন লাখ লাখ মানুষ বসবাস করেন। শুধু তাই নয়, বর্তমানের অনেক বাজারও নবাবের রাজত্বের অংশ। কোহে ফিজা প্রপার্টির, মোটরস গ্যারেজ, নিউ কলোনি কোয়ার্টার, কটেজ নাইন, ডেইরি ফার্ম কোয়ার্টার, ফরেস্ট স্টোর, পুলিশ গার্ড রুম-সহ অনেক কিছুই নবাবের সম্পত্তির তালিকায় রয়েছে।

এরপর কী হতে পারে?
সাইফ আলি খান এবং তার পরিবার চলতি মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটা আবেদন জানিয়েছিলেন। সেখানে জানানো হয়েছে, বাবা হামিদুল্লাহ খান জীবিত থাকাকালীন আবিদা সুলতান রাজত্বের ওপর তার সমস্ত অধিকার ছেড়ে দিয়েছিলেন। অতএব, এই সম্পত্তিগুলো 'শত্রু সম্পত্তি'র আওতায় পড়ে না।

 

মজার বিষয় হলো, এর আগে ভোপালের নবাব হামিদুল্লাহ খানের দ্বিতীয় কন্যাকে নবাব হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল ভারত সরকার। কিন্তু এখন কেন্দ্র সরকারই ভোপালের তৎকালীন নবাবের বড় মেয়ে আবিদা সুলতানকেই উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচনা করছে।

বিনোদন বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর