ঢাকা, ২২ নভেম্বর শুক্রবার, ২০২৪ || ৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
১৭৯

সালাম দিন- সুস্থ থাকবেন

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২৩:৩০ ৩ জানুয়ারি ২০২৪  

পাশ্চাত্যে ও পাশ্চাত্যের অনুকরণে গড়ে ওঠা নগরীগুলোর বাসিন্দারা প্রতিনিয়ত এক নীরব ঘাতকের শিকার হচ্ছে, যার নাম একাকিত্ব। কোলরিজের কবিতায় সমুদ্রের অসীম জলরাশির বুকে ভাসমান বুড়ো নাবিক যেমন তৃষ্ণা মেটানোর জন্যে একফোঁটা পানি পায় নি, নাগরিক মানুষও তেমনি জনসমুদ্রে আপন কোনো মুখ খুঁজে পায় না।

 

১৯৮৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা ও ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক ১,৫৩১ জন মানুষের ওপর একটি জরিপ করেন। দেখা গেল, গড়পড়তা মার্কিন নাগরিক মনে করে, সুখ-দুঃখের আলাপ করার জন্যে তার অন্তত তিন জন কাছের মানুষ রয়েছে। ২০ বছরের ব্যবধানে জরিপটি পুনরায় করা হলো। এবার অংশগ্রহণকারীরা জানাল, আমার একজনও কাছের মানুষ নেই। (আমেরিকান সোশিওলজিক্যাল রিভিউ, জুন ২০০৬)

 

স্যাটেলাইট সংস্কৃতি, স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের সুবাদে মার্কিন এই অসুখ গত কয়েক দশকে পুরো পৃথিবীকে সংক্রমিত করেছে। সর্বান্তকরণে সামাজিক ও যূথবদ্ধ একটি প্রাণী ক্রমশ অসামাজিক হয়ে যাচ্ছে। অচেনা মানুষ তো দূরের কথা, প্রতিবেশীর সাথেও তার কোনো সামাজিক সম্পর্ক নেই। 

 

বাংলাদেশেও শহরগুলোতে লাখ লাখ মানুষকে পাওয়া যাবে, যারা একই বিল্ডিংয়ে বছরের পর বছর বাস করছে কিন্তু পরস্পরকে চেনে না। লিফট বা সিঁড়িতে দেখা হলে কুশল বিনিময় না করে দ্রুত পাশ কাটিয়ে চলে যায়। সামাজিক পরিমণ্ডলে কারো সাথে আলাপের বদলে মুঠোফোনে ঘাড় গুঁজে স্ক্রল করতে পারলে মানুষ যেন বেশি স্বস্তি পায়!

 

কিন্তু মার্কিনিদের অভিজ্ঞতাই বলে দিচ্ছে, যারা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন নিঃসঙ্গ তারা হতাশ অবসাদগ্রস্ত ও বাতিল মানুষ। সাম্প্রতিককালে চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী আরেকটি মেটা-অ্যানালিসিসের ফলাফল অনুযায়ী, দৈনিক ১৫টি সিগারেট টানার চেয়েও বেশি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও নিঃসঙ্গতা। (নিউ সায়েন্টিস্ট, ১২ আগস্ট ২০২০)

 

ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া সান ফ্রান্সিসকো-র গবেষণা অনুযায়ী, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা একজন মানুষের কর্মদক্ষতা ও চিন্তাশক্তি কমিয়ে দেয়। সিঁড়ি বেয়ে ওঠা বা হাঁটার মতো অনায়াস কাজটিও তখন কঠিন মনে হয়। ১৪৮টি গবেষণার এক মেটা-অ্যানালিসিসে উঠে এসেছে—নিঃসঙ্গতা অকালমৃত্যুর ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। (প্লস মেডিসিন; ২৭ জুলাই ২০১০) পরিস্থিতির ভয়াবহতা বিবেচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একাকিত্বকে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য অগ্রাধিকার ঘোষণা করেছে।

 

নিঃসঙ্গতার প্রতিষেধক ভিটামিন এস

তাহলে নিঃসঙ্গতার মহামারি থেকে আত্মরক্ষার দাওয়াই কী? সমস্যাটি যেহেতু পাশ্চাত্যকে বেশি আক্রান্ত করেছে, সেখানে এ নিয়ে জোরদার গবেষণা চলছে। বিজ্ঞানীরা বিস্তর পরীক্ষা চালিয়ে নাগরিকদের আপাতত পরামর্শ দিচ্ছেন, যদি সুখী ও সফল হতে চাও, পরিচিত-অপরিচিতদের হ্যালো বলার অভ্যাস বাড়াও। প্রতিদিন যাদের সাথে দেখা হয়, তাদের সালাম বা হ্যালো বলতে পয়সা খরচ হয় না কিন্তু এর উপকারিতা এত ব্যাপক যে, বিজ্ঞানীরা একে বলছেন ভিটামিন এস বা সোশ্যাল কন্ট্যাক্ট।

 

বিখ্যাত মার্কিন জরিপকারী প্রতিষ্ঠান গ্যালাপ ৪,৫৫৬ জনের ওপর জরিপ করে জানাচ্ছে, প্রতিবেশীদের নিয়মিত ‘হ্যালো’ বলেন যারা, অন্যদের তুলনায় তারা বেশি ভালো থাকেন। ছোট্ট এই অভ্যাস সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়ায়। সেইসাথে সুস্থতা, আর্থিক সমৃদ্ধি এবং পেশায় সাফল্যের পরিমাণও বাড়িয়ে দেয়। (সিএনএন, ১৫ আগস্ট ২০২৩)

 

আরো বড় পরিসরে সমীক্ষা চালিয়েছেন যুক্তরাজ্যের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয় ও তুরস্কের একদল গবেষক। ৬০ হাজার মানুষের আচরণ পর্যালোচনা করে তারা জানাচ্ছেন, যারা পরিচিতদের গুড মর্নিং বলে দিন শুরু করে, জীবন নিয়ে তারা বেশি তৃপ্ত। (সোশ্যাল সাইকোলজিক্যাল অ্যান্ড পার্সোনালিটি সায়েন্স)

 

জ্ঞান অর্জন থেকে প্রাণ বাঁচানো, সালাম প্রয়োজন সর্বত্র

শ্রেণিকক্ষে চঞ্চলমতি শিশুদের মনোযোগ ধরে রাখা নিঃসন্দেহে চ্যালেঞ্জিং। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ক্লাসের শুরুতে শিক্ষকরা যদি শিশুদের গুড মর্নিং বা হ্যালো বলে স্বাগত জানান, শিক্ষার্থীদের অস্থিরতা ও দুষ্টুমির পরিমাণ কমে এবং পড়ার প্রতি মনোযোগ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ে। (জার্নাল অব পজিটিভ বিহেভিয়ার)

 

কারো সাথে প্রথম পরিচয়ের জড়তা ভাঙতে সালাম বা নমস্কার বলাটা সাহায্য করে, একথা সবাই জানে। নতুন আবিষ্কার হলো, ডাক্তারদের সালাম বা হ্যালো বলার অভ্যাস থাকলে আপনি প্রাণে বাঁচতে পারেন! গবেষণায় জানা গেছে, সার্জারির আগে ডাক্তাররা যদি নিজেদের মধ্যে কুশল বিনিময় করেন, অপারেশন-পরবর্তী জটিলতা ও প্রাণহানির সংখ্যা কমে ৩৫ শতাংশ। (হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ; ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১০)

 

অতএব পরিচিত ও স্বল্প পরিচিতদের সালাম দেয়ার গুরুত্ব ধর্মশাস্ত্রের সাথে গলা মিলিয়ে বিজ্ঞানও এখন প্রচার করছে। ঘর হতে একটি পা-ও না ফেলিয়া স্বজন-বন্ধুদের সাথে আপনি হয়তো ভার্চুয়ালি আলাপ সেরে ফেলছেন কিংবা অনলাইন অ্যাপের মাধ্যমে পছন্দের খাবার বা পণ্য পেয়ে যাচ্ছেন। বিনিময়ে সূক্ষ্ম খেসারতও কিন্তু আপনি দিচ্ছেন। দোকানে গেলে বিক্রেতার সাথে আপনার দু-চারটে কথা হতো, যার মনোদৈহিক এবং সামাজিক উপকারিতা অপরিসীম।

 

তাই সকালে ঘুম থেকে উঠে শোকর আলহামদুলিল্লাহ/ হরি ওম/ থ্যাংকস গড বলার পর প্রথম যাকে দেখছেন তাকেই সালাম দিন। ঘর থেকে বেরিয়ে প্রতিবেশী, সহকর্মী, সহযাত্রী, মহল্লার মুদি দোকানদার যার সাথেই দেখা হবে, সবাইকে আগে সালাম দিন। দিন শুরু হোক শান্তির বার্তা ছড়িয়ে। আপনার জীবন উজ্জ্বল হোক কল্যাণ ও নিরাপত্তাবোধে।